What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Self-Made মেঘের আড়ালে (1 Viewer)

Fahima

Senior Member
Joined
Apr 8, 2019
Threads
137
Messages
539
Credits
32,076
আমার বাবা যখন দ্বিতীয় বিয়ে করে আনলেন, আমি তখন নবম শ্রেনীর ছাত্রী। মা ঘরের দুয়ার বন্ধ করে আমাদের তিনবোনকে কাছে বসিয়ে একটু পরপর চুপিচুপি চোখের পানি মুছছিলেন। সেদিন মা পরাজিত হবার লজ্জায় প্রতিবাদের ভাষাটুকু হারিয়ে ফেলেছিলেন। সেই সাথে মিশে ছিল বিশ্বাস ভঙ্গ কিংবা পারিবারিক প্রতারনার প্রতি সুক্ষ ঘৃনা।

আমার অপরূপা সুন্দরী, গুনবতী মায়ের সব গুন ঢাকা পড়ে গিয়েছিল পরপর তিনটি কন্যা সন্তান প্রসব করার দোষে।

আমরা মফস্বল শহরে একটা যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। বাবা, চাচা একসাথে ব্যবসা করেন। বাজারে আমাদের মিষ্টির দোকান, একনামে সবাই চেনে ' জান্নাত মিষ্টান্ন'। আমার দাদীর নামে ব্যবসার নাম।দাদী আমাদের পরিবারের সব ক্ষমতার মধ্যমনি। দাদাজান বেঁচে নেই।

মায়ের মুখে কোনদিন আমার দাদী কিংবা পরিবার সম্পর্কে কোন নেগেটিভ কথা শুনিনি। যা বোঝার আমিই বড় হতে হতে বুঝে নিয়েছিলাম। আমার পরে যে বোনটির জন্ম হয় তখন আমার বয়স ছয় বছর। তখনকার সব কথা আমার স্মৃতিতে স্পষ্ট। সেদিন সদ্য জন্ম হওয়া শিশুর কান্নায় দাদী ঘরের বন্ধ দুয়ারের এপাশ থেকে উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়লেন, ছেলে হয়েছে তো রে?

আমি দাদীর হাত ধরে বারান্দায় বসে ছিলাম। সে হাত দাদী ছেড়ে দিলেন। হাউ মাউ করে কান্না ধরলেন, ছেলে না হবার খবরে। আবার মেয়ে!! কে বংশে বাতি জ্বালাবে?

দু'মাস পর আমার চাচীর কোল আলো করে আমাদের একটি ভাই এলো। দাদী খুশী! এতো খুশী দাদীকে আগে কোনদিন দেখিনি। বাড়ির সবাই খুশীর বন্যায় ভাসতে লাগলো। দাদী এক মন মিষ্টি নিজের হাতে বিলি করলেন।সেই মিষ্টির রস আমার ঠোটের পাশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো জামায়।সন্ধ্যা নাগাদ একটা স্টিলের ছোট বাটিতে চারটা মিষ্টি দিয়ে দাদী আমাকে পাঠালেন মা'র ঘরে দিয়ে আসতে। মা তখন আমাদের নতুন ভাইয়ের জন্য নিজ হাতে জামা বানাচ্ছেন। আমি নিজ হাতে মা'র মিষ্টি গালে মিষ্টি তুলে দিলাম।

একটি পুত্র সন্তানের আশায় মা যখন তৃতীয়বারের মত আরো একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিলেন, তখন আমাদের বাবাও আমাদের কাছে অপরিচিত হয়ে যেতে লাগলেন। মা সেই প্রতিকুল পরিবেশে আমাদেরকে পাখির মত বুকে আগলে রাখতেন। সামান্য উঁচু স্বরেও মা কোনদিন আমাদের তিনবোনের সাথে কথা বলেননি। বরং মাথা উঁচু করে কিভাবে বাঁচতে হবে তার প্রেরণা দিয়েছেন অবিরত।

এদিকে চাচীর ঘরে দুই ছেলে। দাদী তাকে রানীর মত সমাদর করেন। আমার অভিমানী, অবহেলিত মা নীরবে সারা দিনভর কাজ করে সন্ধ্যায় আমাদের পড়ালেখা দেখতেন। দাদী বলতেন, মেয়ে পড়ায়ে লাভ কী? যাবে তো পরের ঘরে ভাত রাঁধতে! আমার ছেলের ভিটা তো রক্ষা হবে না! ভালো ঘর পাইলে বিয়ে দিয়ে দাও, ঝামেলা কমে যাক।

আমরা নিজেদেরকে ঝামেলা মনে করিনি। মা আমাদের নিজেদেরকে মানুষ ভাবতে শিখিয়েছেন, মানুষ হতে শিখিয়েছেন। আমি আমার অন্য দুই বোনের চেয়ে আলাদা। একটু রাগী, একটু প্রতিবাদী। মাঝেমাঝে দাদী কিংবা বাবার অন্যায়ের প্রতিবাদ করে মা'র কাছে বকা খেতাম। আমিই প্রথম খেয়াল করলাম দাদী আমার বাবাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছেন, বংশ রক্ষার্থে। সেদিন আমি দাদীর ঘরে গিয়ে সামনে দাড়াই।
-দাদী, আপনি আমার বাবাকে বিয়ে দিতে চান কেন? আমার মা তো মরে নি!
-তোর মা মরা, বাঁচার কথা কি বলছি আমি? আমার সন্তানের ভিটা রক্ষার কথা ভাবছি। পুত্র সন্তান নাই যার, তার আবার কিসের জীবন!
-আমরাই আমার বাবার ভিটা রক্ষা করবো। আপনি আমাদের ঘরে অশান্তি আনবেন না।
-বিয়ে হোক, তারপর দেখিস বাপের ভিটায় কয়দিন আসতে পারিস! সংসার যখন করবি তখন আর এই তেজ থাকবে না, বুঝলি? আমার ছেলের খেয়েই তো তেজ এতো!
-আমি আমার বাবার খাই!
-বাবা পাইছিস কই? এই জান্নাত বেগমের পেটেই তো ছিল, নাকি আকাশ থেকে পড়ছে?

এরকম অপ্রত্যাশিত বাক্য বিনিময় তখন আমাদের বাড়িতে প্রায়ই চলতো। বাবা আমার এমন আচরনের জন্য মাকে দায়ী করে দশ কথা শোনাতেন। চাচী মা'র ঘরে এসে আক্ষেপের স্বরে বলতেন, ভাগ্যিস পেটে মেয়ে ধরি নাই! জীবন জ্বলে যেত!

সেই শীতে দাদী তাঁর ঘরের পাশে আরেকটি নতুন ঘর তুললেন। নতুন বউ আসবে, নতুন ঘরে। আমাদের বাবার নতুন বৌ। আমরা শীতের বিকেলের রোদের মত ম্লান হতে থাকি। মায়ের জন্য আমরা কষ্ট পাই, আমরা আমাদের জন্যও কষ্ট পাই। তিনটা বোন মুখে কিছু বলিনা, কেবল মায়ের গায়ের চাদরের তলে আরেকটু উষ্ণতা খুঁজি,মায়ের বুকের সাথে আরেকটু লেপ্টে থাকি।

বাবার বিয়ে হয়ে যায়। পরের বছর দাদীর মুখে বিজয়ের হাসি ছড়িয়ে পড়ে। আমার নতুন মা পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়ে বাবার ভিটে-মাটি রক্ষা করেন।

সময়ের ব্যবধানে আমরা বেড়ে উঠি। নতুন মা খুব ভালো মানুষদের একজন হওয়াতে পরিবারে খারাপের চেয়ে ভালোই হয়েছে বেশী। ছোট ছোট ভাঙ্গাচোরাগুলো নতুন মা বুদ্ধী আর মমতায় রিপু করে জোড়া দিয়ে ফেলেন। বয়সের ভারে দাদীও নতজানু। একই বাড়িতে বাস করে বাবা আর মা কেবল দুই গ্রহের বাসিন্দা হয়ে রইলেন।

অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে এসেছি গতকাল। আজ রাতে ফিরবো। বাসায় শাশুড়ী মা থাকায় বেশ নিশ্চিন্ত জীবন আমার। মেয়ে জয়ীতা দাদীর গা ঘেষে থাকে। জাহিদ, জয়ীতা, শাশুড়ী মা এই আমাদের চারজনের গোছানো সংসার। এখানে একটি কন্যা সন্তানকে কেবল সন্তানই ভাবা হয়, ঝামেলা কিংবা অনিশ্চয়তা নয়। এখানে বাবার ভিটে বা বংশের বাতি জ্বালানোর কোন প্রসঙ্গ ওঠে না। একজন দাদী তাঁর পাঁচ বছরের নাতনীর মাঝে নিজেকে হারিয়ে খোঁজেন।

সাত-পাঁচ ভাবনায় ছেদ পড়ে সেলফোনের রিং টোনে। বুকের ভেতর শূন্যতায় ভরে ওঠে, বাবা আর নেই! আধা ঘন্টা আগে বুকে ব্যথা নিয়ে বাড়ীর কাছের একটি ক্লিনিকে বাবার শেষ নিঃশ্বাস। যেতে হবে, খুব তাড়াতাড়ি।

বাড়ি ভর্তি মানুষ আর মানুষ। মাত্র কিছু সময়ের ব্যবধানে বাবাকে সবাই লাশ বলছেন। লাশ দাফনের জন্য সবাই তাড়াতাড়ি করছেন। আমরা তিন বোন মা আর ছোটমা বাবার লাশের পাশে বসে। চাচা ও চাচাতো ভাই দুটো ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। দখিনের ঘরে বিরাশি বছরের ডিমেনশিয়া আক্রান্ত দাদী পুত্রশোকে কাতর হওয়ার উর্ধে এখন। জাহিদ মেয়ে জয়ীতাকে পাশে নিয়ে বসে আছে। জয়ীতা তার বাবার বুকের সাথে মাথা রেখে অচেনা একটি অধ্যায়ের সাথে পরিচিত হচ্ছে। আমাদের একমাত্র ভাই রাজ দেশে নেই, তিন বছর হলো ইটালীতে আছে।

ছোটমা আমাকে আস্তে করে ঘরে ডেকে নিলেন। আমার হাত দুটো নিজের হাতের ভেতর নিয়ে অসহায়ের মত ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
-শিলু, তোমার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ন কথা বলতে হবে, মা।
-কী কথা, ছোটমা?
-তুমি তো জানো, তোমাদের ভাই রাজকে মানুষ করতে গিয়ে তোমাদের বাবার কতটা বেগ পেতে হয়েছে। তবুও যদি রাজ মানুষ হতো! পড়ালেখা ছেড়ে ব্যবসা বানিজ্যের নামে কত টাকা যে সে লোকসান করলো! দুইবার মালয়েশিয়া গিয়ে টাকা-পয়সা সব শেষ করে ফিরে এলো। শেষে ইটালী যাবার সময়ও বড় অংকের টাকা লাগলো।রাজের কারনে তোমার বাবা অনেক ধার দেনায় জড়িয়ে গেছেন। এসব নিয়ে তিনি খুবই চিন্তিত থাকতেন। এখন তো সবই শেষ! তবে পাওনাদাররা তো তোমার বাবার দেনা মাফ করবেন না। তোমার চাচা বলছিলেন, বৈঠকখানায় কানাঘুষো চলছে এসব নিয়ে। জায়গা, জমিও তো রাজ সবই প্রায় শেষ করে গেছে।
-আচ্ছা, আমি দেখছি।

জাহিদ শুধু আমার সন্তানের পিতা নয়, সে আমার বন্ধু তূল্য। আমি তার সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করলাম। ছোট বোন দুটোর সাথেও আলাপ করলাম। চাচাকে ডেকে বললাম, বাবার জানাজার আগে আমাকে বৈঠকখানায় নিয়ে চলেন।

আমার বাবাকে আমি আর কোনদিন, পৃথিবীর কোনখানে খুঁজে পাবো না। অভিমানে বাবার সাথে এক অদৃশ্য দূরত্ব তৈরী হয়েছিল। তবু মনে হচ্ছে যদি একবার বাবাকে ফিরে পেতাম, তবে বাবার বুকে মাথা রেখে বুক ভরে কাঁদতাম।

আমি ঝাপসা চোখে বৈঠকখানায় বসা সবার মুখ স্পষ্ট দেখতে পারছি না। তবু সবাইকে উদ্দেশ্য করে আমার বিনীত প্রার্থনা সবার কাছে।
-আমার বাবা, মরহুম আফজাল হাসানের বড় সন্তান আমি ফাহিমা হাসান। আজ আমার বাবা চিরদিনের জন্য আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন। আপনারা আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন। বাবা জেনে, না জেনে আপনাদের কাছে যদি কোন ভুল করে থাকেন তবে আপনারা মেহেরবানী করে তাঁকে মাফ করে দেবেন। আর আপনাদের কারো কাছে যদি আমার বাবার কোন আর্থিক ঋন থেকে থাকে, আমি তাঁর সন্তান হিসেবে সেই ঋনভারের দায়িত্ব গ্রহন করলাম। আমার একমাত্র চাচার মাধ্যমে আপনারা আমার সাথে যোগাযোগ করবেন।

আমার গলা ধরে এলো। আমাকে মায়ের কাছে যেতে হবে! সন্তান হারা জননী, আমার দাদীর কাছে বসতে হবে!


(সমাপ্ত)
 

Users who are viewing this thread

Back
Top