ফোনটা রেখে কিছুক্ষন চুপ করে বিছানায়ই বসে থাকলেন মিসেস শায়লা। তার স্বামী রোডস এন্ড হাইওয়ের একজন ইন্জিনিয়ার। কিছুক্ষণ আগে তার একমাত্র মেয়ের স্বামীর মৃত্যু সংবাদ এসেছে। ব্যাপারটা নিয়ে তাকে খুব একটা বিচলিত মনে হলো না, ভাবলেশহীন ভাবেই রান্নাঘরের টুকিটাকি কাজ সারতে গেলেন।
আজ থেকে প্রায় আট বছর আগে তার একমাত্র মেয়ে সুমি তাদেরকে ছেড়ে চলে যায়। আচ্ছা, আট বছরই তো, নাকি, নয় ? সুমির বয়স এখন কতো তাহলে? পঁচিশ নাকি ছাব্বিশ -- নাহ কিছু মনে পড়ছে না! গত কয়েক বছর ধরে এই সমস্যা শুরু হয়েছে, সংখ্যা, সাল, হিসাব কিছুই মনে থাকে না!
গোলগাল ফর্সা আর গালে টোল পরা সুমি দাদাবাড়ি আর নানাবাড়ি দুই বাড়িতেই ছিলো প্রথম বাচ্চা, তাই সে ছিলো সকলের চোখের মনি ।
বাবারা বোধহয় মেয়েদের একটু বেশিই আদর করে তবে সুমির বাবা আজমল সাহেবের ব্যাপারটা ছিলো বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। সারাক্ষন শুধু আম্মুসোনা, আম্মুসোনা..তাই ইংল্যান্ড থেকে পিএইচডি করার লেটার যখন কনফার্ম হলো তখন থেকেই বাপ মেয়ের কি কান্না! এক পর্যায়ে শায়লা বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলে, কাজ নেই পিএইচডি করে, দেশেই থাকো আর মেয়ের সাথে বসে লুডু খেলো, যত্তসব ঢং!
আজমল সাহেব যখন ইংল্যান্ড গেলেন তখন সুমি ক্লাস সেভেনে আর ছোট ভাইটা ক্লাস ফাইভে পড়ে। ঢাকা শহরে একা একজন মহিলা দুই বাচ্চা নিয়ে কিভাবে দুই- তিন বছর সংসার সামলাবে, তা নিয়ে আজমল সাহেব ভীষন চিন্তায় পড়েন। ঢাকায় তাদের কোনো আত্মীয় স্বজনও নেই। মফস্বলে বেড়ে ওঠা শায়লার কাছে ঢাকা তখনও নিতান্তই অচেনা শহর। তাই সিদ্ধান্ত হলো শায়লারা জামালপুর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে থাকবে। শ্বশুরবাড়ি - বাপের বাড়ি দুটোই জামালপুর হওয়ায় সবাই খুব খুশি, আজমল সাহেবও বেশ নিশ্চিন্ত মনে ইংল্যান্ড গেলেন তার কোর্স শেষ করতে।
সুমি আর সায়ান হঠাৎ করে ঢাকা থেকে এসে মফস্বলের এই পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারবে কিনা, তা নিয়ে শায়লা প্রথমে সংশয়ে থাকলেও দেখা গেল তার ছেলেমেয়েরা খুব সহজেই মানিয়ে নিয়েছে। নিয়মিত লোডসেডিং, মশার কামড়, বাইরে বাথরুম বা চাপকল - কোনো কিছুতেই তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না, ঢাকা শহরের চার রুমের ফ্ল্যাটে বন্দী থাকতে থাকতে ওরাও বোধহয় হাপিয়ে গিয়েছিল। স্কুলেও খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাদের রেজাল্ট ভালো হওয়াতে শিক্ষকদেরও প্রিয় হয়ে ওঠে। স্বামী বড় ইঞ্জিনিয়ার, ছেলেমেয়েরা ভালো, ভদ্র, ট্যালেন্ট- সব কিছু মিলেই শায়লারও একটু গর্ব হয় বৈকি! দাদাবাড়ি, নানাবাড়ির আদর আর শিক্ষকসহ সকলের প্রশংসায় আহ্লাদে আনন্দে তাদের দিন কাটতে থাকে।
সুমি যখন ক্লাস টেনে, তখন আজমল সাহেব পোস্ট ডক্টরেট করার জন্য আরো কিছুদিন থেকে যেতে চাইলেন ইংল্যান্ড, তবে শায়লার এতে ঠিক মত ছিলোনা। মেয়ের এসএসসির পর একটা ভালো কলেজে দিতে হবে যা জামালপুর থেকে প্রায় অসম্ভব। মেয়েকে একা ঢাকায় যেতে দিবে, তাও মন সায় দেয় না, তবে স্বামীর পোস্টডকের প্রতি অত্যাধিক আগ্রহ এবং ভালো একটা কলেজে ভর্তি করার পুনঃপুনঃ আশ্বাসে শেষ পর্যন্ত রাজী হয় শায়লা।
সুমি মেয়ে হিসাবে অসাধারন। ক্লাস টেনে ওঠার পর মা, ভাই, দাদী সবার প্রতি ভীষন কেয়ারিং হয়ে উঠেছে। ভাইয়ের কখন কি লাগবে, বই- খাতা কলম, ফোনে টাকা ফ্লেক্সি করা বা দাদীর পান-ঔষধ, বলার আগেই সব হাজির। দেখতে দেখতে সারা ঘর বিভিন্ন রকমের মগ, কার্ড, সোপিস- পুতুল এগুলোতে ভরে ওঠে। এই সব কিছুই নাকি সে তার মা, ভাই আর দাদীর জন্য কিনে আনে, তার বৃত্তির টাকা দিয়ে! এইটে বৃত্তি পাওয়া উপলক্ষে তার বাবা দেশে একটা ভালো মোবাইল পাঠিয়েছেন, যেটা বেশির ভাগ সময় সুমির দখলেই থাকে। সায়ানকে মোবাইল দেয়া যাবে না মা, ও সারাদিন গেম খেলবে - শায়লার মনে হয়, এই না হলে বড়বোন ?
সুমি রাতে দাদীর সাথে ঘুমায়। দাদীর যাতে অসুবিধা না হয় তাই দাদী শুয়ে পড়লে সে ড্রইং রুমে এসে পড়ে। এসএসসি পরীক্ষার আগে আগে একদিন সুমির দাদী চিন্তিত মুখে শায়লাকে জানালেন যে, অনেক রাতে সুমি ফোনে কার সাথে যেন কথা বলে, তিনি বেশ কয়েকরাত ধরে খেয়াল করছেন। সুমিকে জিজ্ঞেস করাতে সুমিও অকপটে স্বীকার করে যে, তার বান্ধবী রুমার সাথে পড়াশোনা নিয়ে কথা বলে। রুমা তাদের ফার্স্ট গার্ল, খুবই ভালো মেয়ে। তবু নিশ্চিত হবার জন্য সেই নাম্বারে ফোন করে দেখে রুমাই ফোন ধরেছে। এরপর সুমির দাদী আবার অভিযোগ করেন যে, সুমি সবসময় বাথরুমে ফোন নিয়ে যায়, সুমিরও তড়িৎ জবাব যদি কারেন্ট চলে যায় আর পা পিছলে হাত ভেঙে যায়, সেটা কেমন হবে? তারপরও শায়লা কয়েকদিন মেয়েকে নজরদারি করলো, স্কুলে সাথে যাওয়া- আসা করলো, কিন্তু কিছুই চোখে পড়লো না। সুমি জাস্ট প্রচন্ড কেয়ারিং, উচ্ছ্বল এক কিশোরী ছাড়া আর কিছুই নয়। সারাক্ষণই হাসছে, মজার মজার কথা বলছে, মাকে জড়িয়ে ধরছে, ভাইয়ের সাথে খুনসুটি করছে আবার কখনো বা বাবার সাথে কথা বলতে গিয়ে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদছে। আহা, খুবই নরম তার মেয়েটা! অহেতুক সন্দেহ করায় বরং সে তার শ্বাশুড়ির উপরই বিরক্ত হলো, গ্রামের মানুষদের এই এক সমস্যা। কোনো কিছুই সহজ ভাবে ভাবতে পারে না, সব কিছুতেই কিন্তু খোঁজে, শায়লার বিরক্তি বুঝতে পেরে সুমির দাদীও আর কোনো কথা বাড়ালেন না।
এসএসসিতে মেয়ে জিপিএ ৫ পাওয়ায় সবাই ভীষন খুশি। কিন্তু সমস্যা শুরু হলো যখন ঢাকায় ভালো একটা কলেজে চান্স পেলো। বাবা দেশে নেই, ছোট ভাই আর মাকে রেখে সে কিভাবে ঢাকা যাবে, তার কি কোনো দায়িত্ব নেই? এতটা স্বার্থপর সে হতে পারবে না কিছুতেই। তাদেরকে ছেড়ে সে কিছুতেই থাকতে পারবে না, ইনিয়ে বিনিয়ে কত কথা ! কাঁদতে কাঁদতে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দেবার মতো অবস্হা সুমির। শেষে ঠিক হলো আপাতত এখানেই ভর্তি হোক, ছয়মাস পরে বাবা দেশে আসলে দেখা যাবে কি করা যায়।
কলেজে উঠে সুমি যেন আকাশে উড়ছে। সেই সকাল বেলা বাসা থেকে বের হয়ে বিকেল বেলা বাড়ি ফিরে আসে। আর বাসায় এসেই সারাদিন কি কি করলো, কেন এত দেরী হলো তার লম্বা ফিরিস্তি। আজ এই প্র্যাকটিক্যাল তো কাল ওই এক্সট্রা ক্লাস! স্যার ম্যাডামরা খালি বেশি বেশি পড়াতে চায়! শায়লাও তার মেয়ের সব কথা বিশ্বাস করে, সোনার টুকরো মেয়ে তার! মাঝে মাঝে বান্ধবীদের বাসায় নিয়ে আসে, আবার সেও বিভিন্ন বাসায় বেড়াতে যায়। প্রায়ই জড়িয়ে ধরে বলবে, মা তুমিও চলো, তোমাকে ছাড়া ভালো লাগে না। শায়লা হেসে মেয়েকে আদর করে দেয়। মনে মনে ভাবে, আহা, কোথায় না কোথায় মেয়ের বিয়ে হবে, কতদিন পরপর দেখা হবে কে জানে? ভাবতে ভাবতে চোখে পানি আসে শায়লার!
এর কিছুদিন পর আজমল সাহেব পিএইচডি এবং পোস্ট ডক্টরেট কমপ্লিট করে দেশে ফিরে আসেন। দীর্ঘদিন পরে দেশে ফিরছেন তাই যথাসম্ভব সকলের জন্য অল্পবেশি গিফ্ট নিয়ে এসেছেন। সুমি ছোট বাচ্চাদের মতো খুশিতে লাফঝাপ দিচ্ছে, বাবা এসেছে, বাবা এসেছে…! বাবা নিজ হাতে মেয়ের গলায় একটা স্বর্নের চেইন পরিয়ে দেন, বিদেশ থেকে এনেছেন, মেয়ের খুশি আর ধরে না। শায়লা অবশ্য চেইনটা খুলে রাখলো, দেশ গ্রামের ব্যাপার, সাবধানে থাকাই ভালো।
দেশে আসার সাত দিনের মাঝেই আজমল সাহেব সবাইকে ঢাকায় নেওয়ার বন্দোবস্ত করে ফেললেন। সুমি কোন কলেজে ভর্তি হবে, আর নাইনে সায়ানও কোথায় ভর্তি হবে এগুলো ঠিকঠাক করতে গিয়ে তার কালঘাম ছুটে গেল। যেদিন ঢাকায় রওনা দেবার কথা, ঠিক তার আগের দিন দুপুর বেলা, সুমির ফোন থেকে তার বাবার ফোনে মেসেজ আসলো, "আমি চলে যাচ্ছি। আমাকে খুঁজো না, আর খুঁজে পেলেও আমি আর কখনোই ফিরবো না। "
সুমি চলে যাবার পরের ঘটনা শায়লা তেমন কিছু মনে করতে পারে না, সে অনেক দিন পর্যন্ত কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা স্বাভাবিক ভাবেই তাকে দায়ী করে, সে কোনো শাসন করে নি, কোনো খেয়াল রাখেনি, জামাই বিদেশ থেকে টাকা পাঠিয়েছে, আর সে বসে বসে খেয়েছে, ছেলেমেয়ে নিয়ে আদ্যিখেতার শেষ নেই, আরো কত শত দোষ তার! বাড়ির বড় বউ হিসাবে তার যে একটা মর্যাদা ছিলো তা নিমেষেই বাষ্পীভূত হয়ে গেলো, যে নিজের মেয়েকে ঠিকমতো মানুষ করতে পারলো না, সে আবার কেমন মা? শায়লা অবাক হয়ে দেখলো, সবাই তাকেই দোষ দিচ্ছে, সব দায়ভার তার! আসলেই সে দোষী। তার দোষ, সে তার বাচ্চাদের সব কথা চোখ বুঝে বিশ্বাস করেছে, তার দোষ বাবার অবর্তমানে বাচ্চাদের যেন কোন কষ্ট না হয় সেই খেয়াল রেখেছে, সারাক্ষণ মেয়ের পিছে লেগে থাকে নি, মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাওয়া আসা করেনি ! তার নিজের মেয়ের নিখুঁত অভিনয় সে এতটুকু বুঝতে পারে নি, অভিযোগ অপমান তো তাকে সইতেই হবে!
সুমি যে ছেলেটির সাথে চলে গিয়েছিল তার নাম সুমন। সুমিদের স্কুলের পাশে ছেলেদের একটা স্টেশনারি দোকান আছে। এসএসসি ফেল করার পর থেকে দোকানেই বসে। দুই বছর ধরে রিলেশন ছিলো, বান্ধবীরা অনেকেই জানতো, সুমি তাদের বিভিন্ন সময় দাওয়াত দিয়ে বা বিদেশী চকোলেট বা ছোট খাট গিফ্ট দিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছিলো। তাছাড়া কেউ তো আর ভাবেনি সুমি এমন একটা কাজ করবে? সুমির মামা কাকারা কয়েকবার ছেলেদের বাসায় গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছেন। থানা পুলিশ করেও লাভ হয়নি। সুমি আসবেনা কিছুতেই। যে ফেরার নয়, তাকে কিভাবে ফেরানো যাবে?
সুমি চলে যাবার সাত দিন পর শায়লা নিজের রুম থেকে প্রথম বের হলো। সে এই কয়েক দিন ঘোরের মধ্যে ছিল নাকি সেন্সলেস ছিলো, কিছুই বলতে পারে না! আজমল সাহেবও একদম চুপ, একটা কথাও বলছেন না কারো সাথে। তাদের কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না সুমি স্বেচ্ছায় চলে গেছে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হলো, শায়লা আর আজমল সাহেব নিজে যাবেন সুমিকে আনতে। বাবা-মা কে দেখলে মেয়ে ঠিকই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এই বয়সে মানুষ অনেক ভুল করে। ভুল ভাঙিয়ে কাছে টেনে নিতে হয়।
সুমনদের বাসায় গিয়ে দেখা গেলো সুমি শাড়ি পরে নতুন বউ সেজে ঘুরছে। বাবা মা কে দেখে তার কোনো ভাবান্তর হলো না। তিন রুমের আধাপাকা একটা বাড়িতে তারা বসে আছে। ভিতর থেকে ফিসফাস শোনা যাচ্ছে, তবে কেউ সামনে আসছে না। হঠাৎ করে আসায় সুমনরা কি করবে বুঝতে পারছে না, ছেলেটা বোধহয় একটু ভয়ও পেয়েছে।
অনেকক্ষন পরে সুমি হাসিমুখে তার নতুন আম্মু - আব্বু আর দেবর ননদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। সুমির শ্বাশুড়ি বললেন, বউমাকে মাশাল্লা, আমাদের খুব পছন্দ হইছে। আপনারা নতুন কুটুম, দুপুরে খেয়ে যাবেন। শায়লার কেমন একটা অস্বস্তি লাগছে আসার পর থেকেই। সে বলে, সুমি তোমার সাথে আমাদের একটু একা কথা বলা দরকার ছিলো, তবে সুমির কথাটা ঠিক পছন্দ হয়না। এবার আজমল সাহেব, বলেন, তুমি কি আমাদের সাথে যাবে ? সুমির উত্তর -- "দাওয়াত দিলে সবাইকে নিয়ে এক সাথে যাবো।" এবার শায়লা ধীরে ধীরে বলে, আমরা ঢাকা চলে যাচ্ছ, তুমি যাবে না? সুমি সাবলীল ভাবে বলে, "আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে, এখন থেকে শ্বশুরবাড়ি থাকবো। যখন তোমাদের দেখতে ইচ্ছে হবে তখন যাবো।" আজমল সাহেব হতভম্ব হয়ে বসে থাকেন। শায়লার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে, খুব ঘামতে থাকে সে। এই মেয়ে কি তার? এই মেয়েই কি দুই দিন আগে বাবা বলতে অজ্ঞান হয়ে যেত! তাকে জড়িয়ে ধরতো, তার হাতে লোকমা খেত? আচ্ছা, ওকে কি কোনো যাদুটোনা করা হয়েছে, অনেকেই বলছিলো, এখন তো তাই মনে হচ্ছে! শায়লার হঠাৎ মুখ ভরে বমি শুরু হয়, আজমল সাহেব সেখান থেকেই তাকে হসপিটাল নিয়ে যান। কিন্তু, তাদের সাথে সুমি হসপিটাল পর্যন্তও যাবার প্রয়োজন বোধ করেনি।
আজমল সাহেব ঢাকা চলে গেলেও শায়লা আরো দুইমাস জামালপুর ছিল। তার সারাক্ষন মনে হতো, এই বুঝি মেয়ে ফিরে এলো, পেছন থেকে মা বলে জড়িয়ে ধরলো! সে সুমির নানী- দাদীদের নিয়ে আরো কয়েকবার চেষ্টা করে, আশ্বাস দেয় একটা সমাধানের। সুমির একটাই কথা- রিসিপশন অনুষ্ঠান না করা হলে সে আসবে না কিছুতেই!
পৃথিবীর চোখে শায়লা একজন ব্যর্থ মা। সুমি তাদের প্রথম সন্তান, তাদের জীবনে পূর্ণতা এনেছে সুমি ! কত আদর, কত ভালোবাসা, কত কষ্ট করে, ঝড় ঝাপটা সামলে তাদের বড় করেছে । আর আজ, তার নিজের মেয়ের কাছেই তাদের কোনো মূল্য নেই!
শায়লার প্রেসার বেড়ে যায় - রাতের পর রাত ঘুমাতে না পারায় চোখের নিচে গাঢ় কালি, আজমল সাহেবের হার্টে সমস্যা- ডায়াবেটিস, সায়ানের ক্লাস নাইনে ভর্তি এক বছর পিছিয়ে গেল, তাদের জীবন থেকে হাসি, আনন্দ, বিশ্বাস,ভালোবাসা সব নাই হয়ে গেলো, তবু সুমি ফিরে এলো না কিছুতেই!
আজ থেকে প্রায় আট বছর আগে তার একমাত্র মেয়ে সুমি তাদেরকে ছেড়ে চলে যায়। আচ্ছা, আট বছরই তো, নাকি, নয় ? সুমির বয়স এখন কতো তাহলে? পঁচিশ নাকি ছাব্বিশ -- নাহ কিছু মনে পড়ছে না! গত কয়েক বছর ধরে এই সমস্যা শুরু হয়েছে, সংখ্যা, সাল, হিসাব কিছুই মনে থাকে না!
গোলগাল ফর্সা আর গালে টোল পরা সুমি দাদাবাড়ি আর নানাবাড়ি দুই বাড়িতেই ছিলো প্রথম বাচ্চা, তাই সে ছিলো সকলের চোখের মনি ।
বাবারা বোধহয় মেয়েদের একটু বেশিই আদর করে তবে সুমির বাবা আজমল সাহেবের ব্যাপারটা ছিলো বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। সারাক্ষন শুধু আম্মুসোনা, আম্মুসোনা..তাই ইংল্যান্ড থেকে পিএইচডি করার লেটার যখন কনফার্ম হলো তখন থেকেই বাপ মেয়ের কি কান্না! এক পর্যায়ে শায়লা বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলে, কাজ নেই পিএইচডি করে, দেশেই থাকো আর মেয়ের সাথে বসে লুডু খেলো, যত্তসব ঢং!
আজমল সাহেব যখন ইংল্যান্ড গেলেন তখন সুমি ক্লাস সেভেনে আর ছোট ভাইটা ক্লাস ফাইভে পড়ে। ঢাকা শহরে একা একজন মহিলা দুই বাচ্চা নিয়ে কিভাবে দুই- তিন বছর সংসার সামলাবে, তা নিয়ে আজমল সাহেব ভীষন চিন্তায় পড়েন। ঢাকায় তাদের কোনো আত্মীয় স্বজনও নেই। মফস্বলে বেড়ে ওঠা শায়লার কাছে ঢাকা তখনও নিতান্তই অচেনা শহর। তাই সিদ্ধান্ত হলো শায়লারা জামালপুর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে থাকবে। শ্বশুরবাড়ি - বাপের বাড়ি দুটোই জামালপুর হওয়ায় সবাই খুব খুশি, আজমল সাহেবও বেশ নিশ্চিন্ত মনে ইংল্যান্ড গেলেন তার কোর্স শেষ করতে।
সুমি আর সায়ান হঠাৎ করে ঢাকা থেকে এসে মফস্বলের এই পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারবে কিনা, তা নিয়ে শায়লা প্রথমে সংশয়ে থাকলেও দেখা গেল তার ছেলেমেয়েরা খুব সহজেই মানিয়ে নিয়েছে। নিয়মিত লোডসেডিং, মশার কামড়, বাইরে বাথরুম বা চাপকল - কোনো কিছুতেই তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না, ঢাকা শহরের চার রুমের ফ্ল্যাটে বন্দী থাকতে থাকতে ওরাও বোধহয় হাপিয়ে গিয়েছিল। স্কুলেও খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাদের রেজাল্ট ভালো হওয়াতে শিক্ষকদেরও প্রিয় হয়ে ওঠে। স্বামী বড় ইঞ্জিনিয়ার, ছেলেমেয়েরা ভালো, ভদ্র, ট্যালেন্ট- সব কিছু মিলেই শায়লারও একটু গর্ব হয় বৈকি! দাদাবাড়ি, নানাবাড়ির আদর আর শিক্ষকসহ সকলের প্রশংসায় আহ্লাদে আনন্দে তাদের দিন কাটতে থাকে।
সুমি যখন ক্লাস টেনে, তখন আজমল সাহেব পোস্ট ডক্টরেট করার জন্য আরো কিছুদিন থেকে যেতে চাইলেন ইংল্যান্ড, তবে শায়লার এতে ঠিক মত ছিলোনা। মেয়ের এসএসসির পর একটা ভালো কলেজে দিতে হবে যা জামালপুর থেকে প্রায় অসম্ভব। মেয়েকে একা ঢাকায় যেতে দিবে, তাও মন সায় দেয় না, তবে স্বামীর পোস্টডকের প্রতি অত্যাধিক আগ্রহ এবং ভালো একটা কলেজে ভর্তি করার পুনঃপুনঃ আশ্বাসে শেষ পর্যন্ত রাজী হয় শায়লা।
সুমি মেয়ে হিসাবে অসাধারন। ক্লাস টেনে ওঠার পর মা, ভাই, দাদী সবার প্রতি ভীষন কেয়ারিং হয়ে উঠেছে। ভাইয়ের কখন কি লাগবে, বই- খাতা কলম, ফোনে টাকা ফ্লেক্সি করা বা দাদীর পান-ঔষধ, বলার আগেই সব হাজির। দেখতে দেখতে সারা ঘর বিভিন্ন রকমের মগ, কার্ড, সোপিস- পুতুল এগুলোতে ভরে ওঠে। এই সব কিছুই নাকি সে তার মা, ভাই আর দাদীর জন্য কিনে আনে, তার বৃত্তির টাকা দিয়ে! এইটে বৃত্তি পাওয়া উপলক্ষে তার বাবা দেশে একটা ভালো মোবাইল পাঠিয়েছেন, যেটা বেশির ভাগ সময় সুমির দখলেই থাকে। সায়ানকে মোবাইল দেয়া যাবে না মা, ও সারাদিন গেম খেলবে - শায়লার মনে হয়, এই না হলে বড়বোন ?
সুমি রাতে দাদীর সাথে ঘুমায়। দাদীর যাতে অসুবিধা না হয় তাই দাদী শুয়ে পড়লে সে ড্রইং রুমে এসে পড়ে। এসএসসি পরীক্ষার আগে আগে একদিন সুমির দাদী চিন্তিত মুখে শায়লাকে জানালেন যে, অনেক রাতে সুমি ফোনে কার সাথে যেন কথা বলে, তিনি বেশ কয়েকরাত ধরে খেয়াল করছেন। সুমিকে জিজ্ঞেস করাতে সুমিও অকপটে স্বীকার করে যে, তার বান্ধবী রুমার সাথে পড়াশোনা নিয়ে কথা বলে। রুমা তাদের ফার্স্ট গার্ল, খুবই ভালো মেয়ে। তবু নিশ্চিত হবার জন্য সেই নাম্বারে ফোন করে দেখে রুমাই ফোন ধরেছে। এরপর সুমির দাদী আবার অভিযোগ করেন যে, সুমি সবসময় বাথরুমে ফোন নিয়ে যায়, সুমিরও তড়িৎ জবাব যদি কারেন্ট চলে যায় আর পা পিছলে হাত ভেঙে যায়, সেটা কেমন হবে? তারপরও শায়লা কয়েকদিন মেয়েকে নজরদারি করলো, স্কুলে সাথে যাওয়া- আসা করলো, কিন্তু কিছুই চোখে পড়লো না। সুমি জাস্ট প্রচন্ড কেয়ারিং, উচ্ছ্বল এক কিশোরী ছাড়া আর কিছুই নয়। সারাক্ষণই হাসছে, মজার মজার কথা বলছে, মাকে জড়িয়ে ধরছে, ভাইয়ের সাথে খুনসুটি করছে আবার কখনো বা বাবার সাথে কথা বলতে গিয়ে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদছে। আহা, খুবই নরম তার মেয়েটা! অহেতুক সন্দেহ করায় বরং সে তার শ্বাশুড়ির উপরই বিরক্ত হলো, গ্রামের মানুষদের এই এক সমস্যা। কোনো কিছুই সহজ ভাবে ভাবতে পারে না, সব কিছুতেই কিন্তু খোঁজে, শায়লার বিরক্তি বুঝতে পেরে সুমির দাদীও আর কোনো কথা বাড়ালেন না।
এসএসসিতে মেয়ে জিপিএ ৫ পাওয়ায় সবাই ভীষন খুশি। কিন্তু সমস্যা শুরু হলো যখন ঢাকায় ভালো একটা কলেজে চান্স পেলো। বাবা দেশে নেই, ছোট ভাই আর মাকে রেখে সে কিভাবে ঢাকা যাবে, তার কি কোনো দায়িত্ব নেই? এতটা স্বার্থপর সে হতে পারবে না কিছুতেই। তাদেরকে ছেড়ে সে কিছুতেই থাকতে পারবে না, ইনিয়ে বিনিয়ে কত কথা ! কাঁদতে কাঁদতে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দেবার মতো অবস্হা সুমির। শেষে ঠিক হলো আপাতত এখানেই ভর্তি হোক, ছয়মাস পরে বাবা দেশে আসলে দেখা যাবে কি করা যায়।
কলেজে উঠে সুমি যেন আকাশে উড়ছে। সেই সকাল বেলা বাসা থেকে বের হয়ে বিকেল বেলা বাড়ি ফিরে আসে। আর বাসায় এসেই সারাদিন কি কি করলো, কেন এত দেরী হলো তার লম্বা ফিরিস্তি। আজ এই প্র্যাকটিক্যাল তো কাল ওই এক্সট্রা ক্লাস! স্যার ম্যাডামরা খালি বেশি বেশি পড়াতে চায়! শায়লাও তার মেয়ের সব কথা বিশ্বাস করে, সোনার টুকরো মেয়ে তার! মাঝে মাঝে বান্ধবীদের বাসায় নিয়ে আসে, আবার সেও বিভিন্ন বাসায় বেড়াতে যায়। প্রায়ই জড়িয়ে ধরে বলবে, মা তুমিও চলো, তোমাকে ছাড়া ভালো লাগে না। শায়লা হেসে মেয়েকে আদর করে দেয়। মনে মনে ভাবে, আহা, কোথায় না কোথায় মেয়ের বিয়ে হবে, কতদিন পরপর দেখা হবে কে জানে? ভাবতে ভাবতে চোখে পানি আসে শায়লার!
এর কিছুদিন পর আজমল সাহেব পিএইচডি এবং পোস্ট ডক্টরেট কমপ্লিট করে দেশে ফিরে আসেন। দীর্ঘদিন পরে দেশে ফিরছেন তাই যথাসম্ভব সকলের জন্য অল্পবেশি গিফ্ট নিয়ে এসেছেন। সুমি ছোট বাচ্চাদের মতো খুশিতে লাফঝাপ দিচ্ছে, বাবা এসেছে, বাবা এসেছে…! বাবা নিজ হাতে মেয়ের গলায় একটা স্বর্নের চেইন পরিয়ে দেন, বিদেশ থেকে এনেছেন, মেয়ের খুশি আর ধরে না। শায়লা অবশ্য চেইনটা খুলে রাখলো, দেশ গ্রামের ব্যাপার, সাবধানে থাকাই ভালো।
দেশে আসার সাত দিনের মাঝেই আজমল সাহেব সবাইকে ঢাকায় নেওয়ার বন্দোবস্ত করে ফেললেন। সুমি কোন কলেজে ভর্তি হবে, আর নাইনে সায়ানও কোথায় ভর্তি হবে এগুলো ঠিকঠাক করতে গিয়ে তার কালঘাম ছুটে গেল। যেদিন ঢাকায় রওনা দেবার কথা, ঠিক তার আগের দিন দুপুর বেলা, সুমির ফোন থেকে তার বাবার ফোনে মেসেজ আসলো, "আমি চলে যাচ্ছি। আমাকে খুঁজো না, আর খুঁজে পেলেও আমি আর কখনোই ফিরবো না। "
সুমি চলে যাবার পরের ঘটনা শায়লা তেমন কিছু মনে করতে পারে না, সে অনেক দিন পর্যন্ত কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা স্বাভাবিক ভাবেই তাকে দায়ী করে, সে কোনো শাসন করে নি, কোনো খেয়াল রাখেনি, জামাই বিদেশ থেকে টাকা পাঠিয়েছে, আর সে বসে বসে খেয়েছে, ছেলেমেয়ে নিয়ে আদ্যিখেতার শেষ নেই, আরো কত শত দোষ তার! বাড়ির বড় বউ হিসাবে তার যে একটা মর্যাদা ছিলো তা নিমেষেই বাষ্পীভূত হয়ে গেলো, যে নিজের মেয়েকে ঠিকমতো মানুষ করতে পারলো না, সে আবার কেমন মা? শায়লা অবাক হয়ে দেখলো, সবাই তাকেই দোষ দিচ্ছে, সব দায়ভার তার! আসলেই সে দোষী। তার দোষ, সে তার বাচ্চাদের সব কথা চোখ বুঝে বিশ্বাস করেছে, তার দোষ বাবার অবর্তমানে বাচ্চাদের যেন কোন কষ্ট না হয় সেই খেয়াল রেখেছে, সারাক্ষণ মেয়ের পিছে লেগে থাকে নি, মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাওয়া আসা করেনি ! তার নিজের মেয়ের নিখুঁত অভিনয় সে এতটুকু বুঝতে পারে নি, অভিযোগ অপমান তো তাকে সইতেই হবে!
সুমি যে ছেলেটির সাথে চলে গিয়েছিল তার নাম সুমন। সুমিদের স্কুলের পাশে ছেলেদের একটা স্টেশনারি দোকান আছে। এসএসসি ফেল করার পর থেকে দোকানেই বসে। দুই বছর ধরে রিলেশন ছিলো, বান্ধবীরা অনেকেই জানতো, সুমি তাদের বিভিন্ন সময় দাওয়াত দিয়ে বা বিদেশী চকোলেট বা ছোট খাট গিফ্ট দিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছিলো। তাছাড়া কেউ তো আর ভাবেনি সুমি এমন একটা কাজ করবে? সুমির মামা কাকারা কয়েকবার ছেলেদের বাসায় গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছেন। থানা পুলিশ করেও লাভ হয়নি। সুমি আসবেনা কিছুতেই। যে ফেরার নয়, তাকে কিভাবে ফেরানো যাবে?
সুমি চলে যাবার সাত দিন পর শায়লা নিজের রুম থেকে প্রথম বের হলো। সে এই কয়েক দিন ঘোরের মধ্যে ছিল নাকি সেন্সলেস ছিলো, কিছুই বলতে পারে না! আজমল সাহেবও একদম চুপ, একটা কথাও বলছেন না কারো সাথে। তাদের কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না সুমি স্বেচ্ছায় চলে গেছে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হলো, শায়লা আর আজমল সাহেব নিজে যাবেন সুমিকে আনতে। বাবা-মা কে দেখলে মেয়ে ঠিকই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এই বয়সে মানুষ অনেক ভুল করে। ভুল ভাঙিয়ে কাছে টেনে নিতে হয়।
সুমনদের বাসায় গিয়ে দেখা গেলো সুমি শাড়ি পরে নতুন বউ সেজে ঘুরছে। বাবা মা কে দেখে তার কোনো ভাবান্তর হলো না। তিন রুমের আধাপাকা একটা বাড়িতে তারা বসে আছে। ভিতর থেকে ফিসফাস শোনা যাচ্ছে, তবে কেউ সামনে আসছে না। হঠাৎ করে আসায় সুমনরা কি করবে বুঝতে পারছে না, ছেলেটা বোধহয় একটু ভয়ও পেয়েছে।
অনেকক্ষন পরে সুমি হাসিমুখে তার নতুন আম্মু - আব্বু আর দেবর ননদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। সুমির শ্বাশুড়ি বললেন, বউমাকে মাশাল্লা, আমাদের খুব পছন্দ হইছে। আপনারা নতুন কুটুম, দুপুরে খেয়ে যাবেন। শায়লার কেমন একটা অস্বস্তি লাগছে আসার পর থেকেই। সে বলে, সুমি তোমার সাথে আমাদের একটু একা কথা বলা দরকার ছিলো, তবে সুমির কথাটা ঠিক পছন্দ হয়না। এবার আজমল সাহেব, বলেন, তুমি কি আমাদের সাথে যাবে ? সুমির উত্তর -- "দাওয়াত দিলে সবাইকে নিয়ে এক সাথে যাবো।" এবার শায়লা ধীরে ধীরে বলে, আমরা ঢাকা চলে যাচ্ছ, তুমি যাবে না? সুমি সাবলীল ভাবে বলে, "আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে, এখন থেকে শ্বশুরবাড়ি থাকবো। যখন তোমাদের দেখতে ইচ্ছে হবে তখন যাবো।" আজমল সাহেব হতভম্ব হয়ে বসে থাকেন। শায়লার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে, খুব ঘামতে থাকে সে। এই মেয়ে কি তার? এই মেয়েই কি দুই দিন আগে বাবা বলতে অজ্ঞান হয়ে যেত! তাকে জড়িয়ে ধরতো, তার হাতে লোকমা খেত? আচ্ছা, ওকে কি কোনো যাদুটোনা করা হয়েছে, অনেকেই বলছিলো, এখন তো তাই মনে হচ্ছে! শায়লার হঠাৎ মুখ ভরে বমি শুরু হয়, আজমল সাহেব সেখান থেকেই তাকে হসপিটাল নিয়ে যান। কিন্তু, তাদের সাথে সুমি হসপিটাল পর্যন্তও যাবার প্রয়োজন বোধ করেনি।
আজমল সাহেব ঢাকা চলে গেলেও শায়লা আরো দুইমাস জামালপুর ছিল। তার সারাক্ষন মনে হতো, এই বুঝি মেয়ে ফিরে এলো, পেছন থেকে মা বলে জড়িয়ে ধরলো! সে সুমির নানী- দাদীদের নিয়ে আরো কয়েকবার চেষ্টা করে, আশ্বাস দেয় একটা সমাধানের। সুমির একটাই কথা- রিসিপশন অনুষ্ঠান না করা হলে সে আসবে না কিছুতেই!
পৃথিবীর চোখে শায়লা একজন ব্যর্থ মা। সুমি তাদের প্রথম সন্তান, তাদের জীবনে পূর্ণতা এনেছে সুমি ! কত আদর, কত ভালোবাসা, কত কষ্ট করে, ঝড় ঝাপটা সামলে তাদের বড় করেছে । আর আজ, তার নিজের মেয়ের কাছেই তাদের কোনো মূল্য নেই!
শায়লার প্রেসার বেড়ে যায় - রাতের পর রাত ঘুমাতে না পারায় চোখের নিচে গাঢ় কালি, আজমল সাহেবের হার্টে সমস্যা- ডায়াবেটিস, সায়ানের ক্লাস নাইনে ভর্তি এক বছর পিছিয়ে গেল, তাদের জীবন থেকে হাসি, আনন্দ, বিশ্বাস,ভালোবাসা সব নাই হয়ে গেলো, তবু সুমি ফিরে এলো না কিছুতেই!