আব্বার কালো কোটটা আজ ধোয়া হয়েছে। আব্বার একটাই কোট। ত্রিশ বছর আগে আব্বার বিয়েতে নানাজান এই কোট বানিয়ে দিয়েছিলেন। ত্রিশ বছর ধরে আব্বা নিজ হাতে এই কোট ধোয়ার কাজটি করেন। শীতের শুরুতেই আব্বা এই ধোয়ার কাজটি সেরে ফেলেন। তবে মাঝের এক বছর হুট করে আব্বার জন্ডিস ধরা পড়ে। ভীষণ খারাপ রকমের জন্ডিস। জন্ডিস ভালো হতে হতে পুরো শীত এসে গেল বলে আব্বা সেই কোট ধোয়ার কাজটি আর করতে পারলেন না। এই নিয়ে আব্বার সেই কি আক্ষেপ।
আমি বলি, এভাবে বুঝি কেউ কোট ধোয়?
আব্বা বললেন, আরে ব্যাটা এই সাবান দিয়ে ধোয়ার চেয়ে আর কোন ভালো ধোয়া আছে? লন্ড্রিতে এক কোট ধুয়ে পঞ্চাশ টাকা রেখে দেয়। তার চেয়ে আমার এই সাবান দিয়ে এক ধোয়ায় বছর পার। পঞ্চাশ টাকার কাজ এক তিব্বত সাবানেই শেষ।
হ্যাঁ, ত্রিশ বছর হতে চললো আব্বা এই কোট আগলে রেখেছেন। বিয়ের সময় নানাজানের কাছ থেকে এই কোট উপহার পেয়ে আব্বা ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। তখন নতুন জামাইকে সাফারি স্যুট দেওয়ার একটা রেওয়াজ ছিলো। আব্বা নাকি সাফারি স্যুটের বদলে এই কোট নিয়েছিলেন। আব্বা করেন সরকারি কেরানির চাকরি। আম্মাও সুযোগ পেলেই আব্বার এই কোটের গল্প জুড়ে দেন। আম্মা হাসতে হাসতে বলেন, প্রথম প্রথম গরমেও তোর আব্বা মাঝে মাঝে এই কোট পরে অফিসে যেতেন।
আব্বার বিয়ের বছর তিনেক পর আমাদের এলাকার এক ছোট চাচা আসলেন আব্বার এই কোট ধার চাইতে। উনি নাকি বিসিএসের ভাইভা দিবেন। আব্বা শুনে মহাখুশি। পারলে এই কোট আবার নতুন করে ধুয়ে দেন। কোটের তিন বোতামের একটা ছেঁড়া ছিল। সেই বোতাম আব্বা তুলে রেখেছিলেন আলমারিতে। আব্বা আলমারি থেকে বোতাম খুঁজে বের করে কোটে লাগিয়ে দিলেন। সেই কোট পরে ঐ চাচা ভাইভা দিলেন এবং চাকরিও হয়ে গেল। সেই থেকে এই কোটের প্রতি আব্বার নাকি মায়া আরো বেড়ে গেল। আব্বা আরও বেশি যত্ন নেয়া শুরু করলেন।
একবার হলো কি, আব্বার এই কোটের হাতায় কে যেন নেইল পলিশ লাগিয়েছে। এই দেখে আব্বা ভীষণ মন খারাপ করলেন। মন খারাপ করেই অফিস গেলেন। অফিসের কেউ একজন বুদ্ধি দিলো কেরোসিন দিলে নেইল পলিশের দাগ উঠবে। ঐদিন আব্বা সকাল সকাল অফিস থেকে বাসায় ফিরলেন। বাসায় এসে কেরোসিনের বোতল খুঁজে দেখে বোতলে তেল নেই। আব্বা এই বোতল নিয়ে দোকানে গেলেন। তেল নিয়ে এসে এই নেইল পলিশের দাগ তুললেন।
চৈত্র মাসের শেষের দিক। আমি একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাব। আব্বা কোটটা বের করে আমাকে পরিয়ে দিলেন। আমাকে হিসফিস করতে দেখে বললো, গরম লাগছে বুঝি?
আমি কিছু একটা বলার আগেই আব্বা বললো, ব্যাটা একটু গরম লাগলে লাগুক। এই কোট বিসিএস জেতা কোট। হেলাফেলা করিস না। এটা পরে ইন্টারভিউ দিয়ে দেখ কেমন লাগে।
ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি শীতের সময় আব্বা এই কোট ছাড়া তেমন একটা ভারী জামা কাপড় পরেন না। বছরের পর বছর শীতের কাপড় উনি এই এক কোট দিয়েই পার করে দিলেন। এমনও হয়েছে আব্বা প্রায় লুঙ্গির সাথে এই কোট পরে বাজারে গিয়েছেন।
হ্যাঁ, আমি বড় হয়েছি। খুব ভালো চাকরি বাকরি করি। ভালো আয় রোজগার করি। এখন অনেককিছু বুঝতে পারি। বুঝতে পারি বলেই একদিন আব্বাকে বললাম, আব্বা এবার নতুন একটা কোট বানিয়ে দেই?
আব্বা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলেন, এটা দেখতে বুঝি খুব খারাপ লাগে রে?
আমি আমতা আমতা করে বললাম, এটা অনেক পুরনো হয়ে গেল তাই বলছিলাম…
আব্বার তার গায়ে থাকা সেই পুরনো কোটটার পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা বড় নিঃশ্বাস নিলেন। তারপর সেই নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বললেন, ব্যাটা, পুরনো অনেক কিছু চাইলেও পাল্টানো যায় না। এই পুরনোর মাঝে অনেক কিছু আটকে আছে। বলতে পারিস এটা আমাদের একটা অবলম্বন। আমাদের মত নিম্ন মধ্যবিত্তরা এই অবলম্বন এড়াতে পারে না। আমিতো খুব ছোট একটা কেরানীর চাকরি করতাম। শার্ট প্যান্ট হাতে গোনা। দুটো শার্ট মাত্র। তাও আবার অনেক পুরনো। কোটটা পরে এই পুরনো জামা এড়াতে চাইতাম। আমি জানিনা আর কারো এমন হয় কিনা। এই কোটে আমার খুব সাহস হয়। এই কোট পরলে নতুন একটা শার্ট কিনতে না পারার, অনেক দিনের পুরনো শার্ট পরার কষ্টটা কেমনজানি লুকিয়ে রাখতে পারতাম। রোজ দিন একই শার্ট পরে অফিস যাওয়ায় কেমন একটা অস্বস্তি হতো। শার্টের উপর এই কোট পরলে সেই অস্বস্তিটা কমে যেত।
কথাগুলো বলে আব্বা কিছুক্ষণ থেমে আবার বলা শুরু করলেন। আব্বা বললেন, হ্যাঁ এই জিনিসিটা শুরুতে আমার খুব শখেরই ছিলো তা বলতে পারিস। সময়ের সাথে সাথে আস্তে আস্তে এটা আমার নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবনের অবলম্বন হয়ে গেল। প্রতি বছর টাকা খরচ করে শীতের জামা কেনার সাহস আমার কখনও ছিলনা। তাছাড়া তোদের তখন বাড়ন্ত শরীর। প্রতি বছরই শীতের জামা নতুন করে কেনা লাগে। এছাড়াও আমার যে আরও অনেককিছু প্রয়োজন। সেই প্রয়োজন ভুলে নিজেরটা আমি কখনোই চাইনি। সময় পেরুতে থাকে। মধ্যবিত্ত জীবনের নানাবিদ চাওয়া পাওয়ার তাগিদ দিন দিন বেড়েই গেল। তখন এই কালো কোটটা এড়িয়ে অন্যকিছু কেনা বিলাসিতা হয়ে যায়। আমাদের বিলাসিতা করার সাহস কোথায়। প্রতি বছর এক জিনিস ব্যবহার করতে করতে এই কোট কেমনজানি খুব আপন আপন লাগে। এখন হয়তো একটু আধটু বিলাসিতার সুযোগ আছে কিন্তু ঐ যে, আপন করে নেয়া অবলম্বন কি ছুঁড়ে ফেলতে পারি। মানুষ কি চাইলে তার অবলম্বন ছুঁড়ে ফেলতে পারে? প্রতিটা অবলম্বনের কাছে আমাদের কিছু দায় থাকে। মায়ার দায়, ভালোবাসার দায়। এই দায় এড়িয়ে যাওয়া ভীষণ কঠিন। কষ্ট হয়, সত্যিই ভীষণ কষ্ট হয়। থাকুক না আপন হয়ে। এই অবলম্বনের মাঝে যে আমার সীমাবদ্ধতার অনেক, অনেককিছু জড়িয়ে আছে।
আমি আব্বাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি। কেন কাঁদছি জানিনা। আব্বার গায়ে থাকা কালো কোটটা থেকে একটা গন্ধ আমার নাকে এসে লাগছে। এই গন্ধ আমার কেনজানি ভীষণ চেনা। আমার শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের প্রতিটি অধ্যায়ের গন্ধ যেন এই কোটের গায়ে মিশে আছে। এই কোটের গায়ে মিশে থাকা গন্ধ আমার কাছে ভালোবাসার দায়। আমিও এই দায় আগলে রাখতে চাই অনন্তকাল।
(সমাপ্ত)
আমি বলি, এভাবে বুঝি কেউ কোট ধোয়?
আব্বা বললেন, আরে ব্যাটা এই সাবান দিয়ে ধোয়ার চেয়ে আর কোন ভালো ধোয়া আছে? লন্ড্রিতে এক কোট ধুয়ে পঞ্চাশ টাকা রেখে দেয়। তার চেয়ে আমার এই সাবান দিয়ে এক ধোয়ায় বছর পার। পঞ্চাশ টাকার কাজ এক তিব্বত সাবানেই শেষ।
হ্যাঁ, ত্রিশ বছর হতে চললো আব্বা এই কোট আগলে রেখেছেন। বিয়ের সময় নানাজানের কাছ থেকে এই কোট উপহার পেয়ে আব্বা ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। তখন নতুন জামাইকে সাফারি স্যুট দেওয়ার একটা রেওয়াজ ছিলো। আব্বা নাকি সাফারি স্যুটের বদলে এই কোট নিয়েছিলেন। আব্বা করেন সরকারি কেরানির চাকরি। আম্মাও সুযোগ পেলেই আব্বার এই কোটের গল্প জুড়ে দেন। আম্মা হাসতে হাসতে বলেন, প্রথম প্রথম গরমেও তোর আব্বা মাঝে মাঝে এই কোট পরে অফিসে যেতেন।
আব্বার বিয়ের বছর তিনেক পর আমাদের এলাকার এক ছোট চাচা আসলেন আব্বার এই কোট ধার চাইতে। উনি নাকি বিসিএসের ভাইভা দিবেন। আব্বা শুনে মহাখুশি। পারলে এই কোট আবার নতুন করে ধুয়ে দেন। কোটের তিন বোতামের একটা ছেঁড়া ছিল। সেই বোতাম আব্বা তুলে রেখেছিলেন আলমারিতে। আব্বা আলমারি থেকে বোতাম খুঁজে বের করে কোটে লাগিয়ে দিলেন। সেই কোট পরে ঐ চাচা ভাইভা দিলেন এবং চাকরিও হয়ে গেল। সেই থেকে এই কোটের প্রতি আব্বার নাকি মায়া আরো বেড়ে গেল। আব্বা আরও বেশি যত্ন নেয়া শুরু করলেন।
একবার হলো কি, আব্বার এই কোটের হাতায় কে যেন নেইল পলিশ লাগিয়েছে। এই দেখে আব্বা ভীষণ মন খারাপ করলেন। মন খারাপ করেই অফিস গেলেন। অফিসের কেউ একজন বুদ্ধি দিলো কেরোসিন দিলে নেইল পলিশের দাগ উঠবে। ঐদিন আব্বা সকাল সকাল অফিস থেকে বাসায় ফিরলেন। বাসায় এসে কেরোসিনের বোতল খুঁজে দেখে বোতলে তেল নেই। আব্বা এই বোতল নিয়ে দোকানে গেলেন। তেল নিয়ে এসে এই নেইল পলিশের দাগ তুললেন।
চৈত্র মাসের শেষের দিক। আমি একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাব। আব্বা কোটটা বের করে আমাকে পরিয়ে দিলেন। আমাকে হিসফিস করতে দেখে বললো, গরম লাগছে বুঝি?
আমি কিছু একটা বলার আগেই আব্বা বললো, ব্যাটা একটু গরম লাগলে লাগুক। এই কোট বিসিএস জেতা কোট। হেলাফেলা করিস না। এটা পরে ইন্টারভিউ দিয়ে দেখ কেমন লাগে।
ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি শীতের সময় আব্বা এই কোট ছাড়া তেমন একটা ভারী জামা কাপড় পরেন না। বছরের পর বছর শীতের কাপড় উনি এই এক কোট দিয়েই পার করে দিলেন। এমনও হয়েছে আব্বা প্রায় লুঙ্গির সাথে এই কোট পরে বাজারে গিয়েছেন।
হ্যাঁ, আমি বড় হয়েছি। খুব ভালো চাকরি বাকরি করি। ভালো আয় রোজগার করি। এখন অনেককিছু বুঝতে পারি। বুঝতে পারি বলেই একদিন আব্বাকে বললাম, আব্বা এবার নতুন একটা কোট বানিয়ে দেই?
আব্বা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলেন, এটা দেখতে বুঝি খুব খারাপ লাগে রে?
আমি আমতা আমতা করে বললাম, এটা অনেক পুরনো হয়ে গেল তাই বলছিলাম…
আব্বার তার গায়ে থাকা সেই পুরনো কোটটার পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা বড় নিঃশ্বাস নিলেন। তারপর সেই নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বললেন, ব্যাটা, পুরনো অনেক কিছু চাইলেও পাল্টানো যায় না। এই পুরনোর মাঝে অনেক কিছু আটকে আছে। বলতে পারিস এটা আমাদের একটা অবলম্বন। আমাদের মত নিম্ন মধ্যবিত্তরা এই অবলম্বন এড়াতে পারে না। আমিতো খুব ছোট একটা কেরানীর চাকরি করতাম। শার্ট প্যান্ট হাতে গোনা। দুটো শার্ট মাত্র। তাও আবার অনেক পুরনো। কোটটা পরে এই পুরনো জামা এড়াতে চাইতাম। আমি জানিনা আর কারো এমন হয় কিনা। এই কোটে আমার খুব সাহস হয়। এই কোট পরলে নতুন একটা শার্ট কিনতে না পারার, অনেক দিনের পুরনো শার্ট পরার কষ্টটা কেমনজানি লুকিয়ে রাখতে পারতাম। রোজ দিন একই শার্ট পরে অফিস যাওয়ায় কেমন একটা অস্বস্তি হতো। শার্টের উপর এই কোট পরলে সেই অস্বস্তিটা কমে যেত।
কথাগুলো বলে আব্বা কিছুক্ষণ থেমে আবার বলা শুরু করলেন। আব্বা বললেন, হ্যাঁ এই জিনিসিটা শুরুতে আমার খুব শখেরই ছিলো তা বলতে পারিস। সময়ের সাথে সাথে আস্তে আস্তে এটা আমার নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবনের অবলম্বন হয়ে গেল। প্রতি বছর টাকা খরচ করে শীতের জামা কেনার সাহস আমার কখনও ছিলনা। তাছাড়া তোদের তখন বাড়ন্ত শরীর। প্রতি বছরই শীতের জামা নতুন করে কেনা লাগে। এছাড়াও আমার যে আরও অনেককিছু প্রয়োজন। সেই প্রয়োজন ভুলে নিজেরটা আমি কখনোই চাইনি। সময় পেরুতে থাকে। মধ্যবিত্ত জীবনের নানাবিদ চাওয়া পাওয়ার তাগিদ দিন দিন বেড়েই গেল। তখন এই কালো কোটটা এড়িয়ে অন্যকিছু কেনা বিলাসিতা হয়ে যায়। আমাদের বিলাসিতা করার সাহস কোথায়। প্রতি বছর এক জিনিস ব্যবহার করতে করতে এই কোট কেমনজানি খুব আপন আপন লাগে। এখন হয়তো একটু আধটু বিলাসিতার সুযোগ আছে কিন্তু ঐ যে, আপন করে নেয়া অবলম্বন কি ছুঁড়ে ফেলতে পারি। মানুষ কি চাইলে তার অবলম্বন ছুঁড়ে ফেলতে পারে? প্রতিটা অবলম্বনের কাছে আমাদের কিছু দায় থাকে। মায়ার দায়, ভালোবাসার দায়। এই দায় এড়িয়ে যাওয়া ভীষণ কঠিন। কষ্ট হয়, সত্যিই ভীষণ কষ্ট হয়। থাকুক না আপন হয়ে। এই অবলম্বনের মাঝে যে আমার সীমাবদ্ধতার অনেক, অনেককিছু জড়িয়ে আছে।
আমি আব্বাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি। কেন কাঁদছি জানিনা। আব্বার গায়ে থাকা কালো কোটটা থেকে একটা গন্ধ আমার নাকে এসে লাগছে। এই গন্ধ আমার কেনজানি ভীষণ চেনা। আমার শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের প্রতিটি অধ্যায়ের গন্ধ যেন এই কোটের গায়ে মিশে আছে। এই কোটের গায়ে মিশে থাকা গন্ধ আমার কাছে ভালোবাসার দায়। আমিও এই দায় আগলে রাখতে চাই অনন্তকাল।
(সমাপ্ত)