নিউ মার্কেটের সামনে বাস থেকে নেমে আমি একটু থমকে গেলাম। নীল শাড়ি পরা যে মেয়েটা হাসতে হাসতে ভিতরে ঢুকছে তাকে চিনতে আমার এক মুহূর্তও দেরি হল না। মিলি। ছোট বোনের হাত ধরে কী চমৎকারভাবে হেঁটে যাচ্ছে। কয়েক মাসেই ঢাকা শহরটা অনেক বদলে গেছে। গত বছরের এই দিনেও মেয়েরা এভাবে একা একা শহরে বের হবে তা ভাবাও যেত না। ছুটির দিন দেখে মার্কেটেও যথেষ্ট ভিড়। এই শহরের মানুষজন খুব সহজেই দুঃস্বপ্ন থেকে বের হয়ে আসতে পারছে। কে বলবে দশ মাস আগেও দরজায় কড়া শুনলেই মানুষ আতঙ্কে জমে যেত। সবসময় কাজ করত একটা চাপা অনিশ্চয়তা। না, আবার সেইসব দুঃস্বপ্নের কথা মাথায় চলে আসছে। এমন একটা চমৎকার বিকালকে এসব কথা মনে করে নষ্ট করা ঠিক না।
ছোট বোন নিশ্চয়ই মজার কোনো কথা বলেছে। মিলি হাসতে হাসতে একদম গড়িয়ে পড়ছে। আঁচল চাপা দিয়ে হাসি আটকানোর চেষ্টা করেও পারছে না। এভাবে ওদের পিছে পিছে ঘোরাও ঠিক হচ্ছে না নিশ্চয়ই। আগের সেই দিন আর নেই। একটা যুদ্ধ শুধু একটা দেশকেই না, দেশের মানুষগুলোকেও অনেক দূরে সরিয়ে দিয়ে গেছে। আমার এই পোড়া গায়ের রঙ, মুখ ভর্তি দাঁড়ি গোফের জঙ্গল দেখে মিলি নিশ্চয়ই আমাকে চিনতে পারবে না। জানুয়ারীর তিন তারিখে আমি যখন শান্তিনগরে ছোট মামার বাসায় ফিরে এলাম তখন দরজা খুলে মামাও আমাকে দেখে চিনতে পারে নি। মিলি তো সেখানে আরো কত দূরের মানুষ।
ছোট ছোট বাচ্চারা বাবা মায়ের হাত ধরে ঘুরছে। দেখতে চমৎকার লাগছে। এরকম জায়গায় আমার মত একটা মানুষ নিশ্চয় বেমানান। কেউ কেউ আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আগে ছুটির দিনে বিকালে আড্ডা দিতে দিতে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে যেত টেরও পেতাম না। একটা যুদ্ধ সেই সুন্দর সময়গুলোকে কী নিষ্ঠুরভাবেই না বদলে দিয়ে গেল। তৌফিক মারা গেছে কাঁচপুর অপারেশনে। সাব্বির ধরা পড়ল নভেম্বরের শেষে। শফিক, মামুন, শওকত সবাই চলে গেল একে একে.....................
"সেলিম ভাই, আপনি?"
অন্যমনস্কভাবে কখন মিলির কাছাকাছি এসে গেছি টের পাই নি। এবং আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে মিলি আমাকে চিনতে পারছে। কোনো কোনো মেয়ের হয়তো বাইরের চোখ দুটোর পিছনেও তৃতীয় কোনো চোখ থাকে। যে চোখ দিয়ে তারা ভিতরের মানুষটাকেও খুব সহজেই দেখতে পারে।
আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম।
"কেমন আছ মিলি?"
"আমি আর কেমন থাকব। আগের মতই আছি। আপনাদের মত যুদ্ধ করতে গিয়ে হারিয়ে যাই নি।"
"ইচ্ছা করে হারিয়ে যাই নি মিলি। বাধ্য হয়েছি। যুদ্ধ করতে গেলে সবাইকেই হয়তো হারিয়ে যেতে হয়।"
"কিন্তু যুদ্ধ শেষে সবাই আবার ফিরেও আসে সেলিম ভাই।"
এসব কথা আমার আর বলতে ইচ্ছা করে না।
"এসব কথা থাক মিলি। তোমার বোনকে দেখ আমার দিকে কেমন ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে।"
"শুধু শিউলি না, রাস্তা দিয়ে যারা যাচ্ছে তারাই আপনার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে। নিজেকে একবার আয়নায় দেখছেন?"
"দেখে লাভ কী? চিনতে তো পারব না। যেদিন থেকে যুদ্ধে গেলাম সেদিন থেকেই নিজেকে আর চিনতে পারি না। আমার কথা থাক। তোমাদের কথা বল বরং।"
মিলি হঠাৎ কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবল। তারপর বলল,
"সেলিম ভাই, বাইরে গাড়ি আছে। চলুন গাড়িতে করে কিছুক্ষণ ঘুরে আসি। অনেক কথা এখনো শোনার বাকি আছে আপনার কাছ থেকে।"
আমি হাসলাম। "তোমাদের ড্রাইভার আমাকে গাড়িতে উঠতেই দেবে না। নির্ঘাত রাস্তার কোনো মাস্তান মনে করবে।"
"অজুহাত দেবেন না সেলিম ভাই। অজুহাত আমার একদম পছন্দ না। অবশ্য আমাদের গাড়িতে বসতে যদি আপনার আপত্তি থাকে তাহলে থাক।"
আপত্তি থাকলেও এর পর আর আপত্তি করা চলে না। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
"তুমি একটুও বদলাওনি মিলি। এখনো সেই আগের মত বাচ্চাদের মত অভিমান করছ।"
গাড়ি চলতে শুরু করলে মিলি আস্তে আস্তে বলল, "সাব্বির ভাই আর বেঁচে নেই, তাই না?"
হঠাৎ করে সেদিন বিকালটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। মালিবাগ ক্রসিঙের কাছে একটা মিলিটারি জিপ সব গাড়ি থামিয়ে চেক করছে। রফিক ফিস ফিস করে বলল, "সর্বনাশ, এখন কী হবে? একটা কুইক টার্ন নেব নাকি সাব্বির ভাই?"
সাব্বির মুহূর্তের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিল। ঠোঁটে চেপে থাকা জ্বলন্ত সিগারেটটাতে লম্বা টান দিয়ে শান্ত করল তার ইস্পাতের মত শক্ত স্নায়ুটাকে। তারপর সেটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে বলল, "না, আমরা যথেষ্ট মানুষ আছি। ওদেরকে ফেস করব। গাড়ি নিয়ে পালানোর জন্য আমরা যুদ্ধে আসিনি।"
সাব্বিরের যুক্তিতে হয়তো কিছু ভুল ছিল। মাঝে মাঝে পিছু হঠাও যুদ্ধেরই অংশ। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত প্রবীণ কোনো জেনারেলের মুখে মানায়, তরুণ কোনো যোদ্ধার মুখে নয়। সেই মুহূর্তে সাব্বিরের চেহারা এখনো আমার চোখের সামনে ভাসে। কী কঠিন, দৃঢ় চেহারা, আর কী ইস্পাতের মত শক্ত নার্ভ। অথচ যুদ্ধের আগে আমরা যখন কলাভবনের বারান্দায় আড্ডা দিতাম, তখন এই সাব্বিরই ছিল সবচেয়ে মুখচোরা। আমরা কথা বলতাম, ও শুধু শুনত। কিন্তু হলদিয়ার যুদ্ধে কমাণ্ডার আকবর ভাই মারা যাওয়ার পর থেকে প্রতিটা অপারেশনে সাব্বিরই ছিল আমাদের লিডার। ওর নিখুঁত প্ল্যান আর প্রচণ্ড দুঃসাহস দেখে আমরাও মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যেতাম। নীলগঞ্জ যুদ্ধের পর ও নিজের হাতে ছয়জন মিলিটারিকে গুলি করে নদীতে ফেলে দিয়েছিল। একটুও হাত কাঁপে নি। আমরা ভেবে পেতাম না, যুদ্ধই কি ওকে এতটা বদলে দিয়েছে? নাকি ও আগে থেকেই এরকম ছিল। আমরাই বুঝতে পারি নি।
"কী হল সেলিম ভাই, সহজ উত্তরটা দিতে এত সময় নিচ্ছেন কেন?"
আমি একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। "জানি না। নভেম্বরের শেষে ও ধরা পড়ে। তারপর আর কোনো খবর পাই নি।"
মিলি হয়তো উত্তরটা জানত। তারপরও অন্যমনস্ক হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। মিলিকে আমাদের আড্ডায় এনেছিল মিজান। আমাদের মধ্যে মেয়েদের সাথে সবচেয়ে বেশি মিশতে পারত মিজানই। মাঝে মাঝেই অপরিচিত কোনো মেয়েকে নিয়ে এসে বলত, "পরিচয় করিয়ে দেই। এ হল শারমিন। কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হয়েছে এবার। ওর সাথে আমার পরিচয়ের সূত্রটা হল............"
অনেক সূত্র থাকত মিজানের। আমরা আড়ালে ওকে ঈর্ষাও করতাম কিছুটা। সেই মিজান একটা পা হারিয়ে ওদের টিকাটুলির বাসায় পড়ে আছে। বাসা থেকে বের হয় না ছয় মাস। সোনাহারা অপারেশনের সময় কমাণ্ডার আকবর ভাই বলেছিল, "একজনকে সামনে গিয়ে চার্জ করতে হবে। ব্রিজের কাছে দুজন পাঞ্জাবি সিপাহী থাকে। একজন গিয়ে ওদের শেষ করে সিগন্যাল দিতে হবে। একজনকেই যেতে হবে কারণ ভুল হলে যেন রিস্ক একজনেরই থাকে। কে যাবেন?"
মিজান এগিয়ে গিয়েছিল।
সেই অন্ধকার রাতে ও নির্বিকারভাবে বলেছিল, "আকবর ভাই, আমি যাব।"
সেই রাতের পর থেকে ওকে আমার আরো বেশি ঈর্ষা হয়।
আবার সেই দুঃস্বপ্নের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। না, সেইসব ভয়ঙ্কর রাতের কথা আর মনে করতে চাই না। তার চেয়ে আগের সেই সুন্দর দিনগুলোর কথা মনে করা যাক। একদিন মিজান এসে বলল, "গুলিস্তানে একটা নতুন সিনেমা এসেছে, হেলেন অব ট্রয়, দেখতে যাবি?"
তৌফিক একটু আপত্তি করেছিল। কিন্তু মিজানের উৎসাহের কাছে সে আপত্তি টিকলো না। ও সেদিন কোথা থেকে যেন মিলিকেও ধরে এনেছিল। সবাই মিলে হৈ চৈ করতে করতে যাওয়া হল। কিন্তু ফেরার সময় একটা সমস্যা হল। মিলিদের বাসা যাত্রাবাড়ি। মিজান ওকে কিছুতেই একা যেতে দেবে না। হঠাৎ ও সাব্বিরকে বলল, "সাব্বির তুই একটু মিলিকে রিকশায় করে পৌঁছে দিয়ে আয় না। আমার আবার একটু কাজ আছে শাহবাগের দিকে।"
কাজটাজ আসলে কিছু ছিল না। কলাভবনের বারান্দায় আড্ডা না দিলে আমাদের বিকালটাই নষ্ট হত। আমাদের আড্ডায় মুখচোরা সাব্বিরের অনুপস্থিটাই চোখে পড়ত সবচেয়ে কম। মিজানের এই হঠাৎ প্রস্তাবে ও কী বলবে তাই বুঝতে পারল না। মিজান অবশ্য আর দেরি করে নি, একটা রিকশা ডেকে ওদেরকে তুলে দিয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম বেচারা পুরা রাস্তা মনে হয় জড়সড় হয়ে বসে ছিল। আমরা আর এ নিয়ে ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করি নি। অনেকদিন পর, ঢাকা থেকে বহু দূরে নীলগঞ্জ নামের একটা ছোট্ট গ্রামে বসে সাব্বির সেই বিকালের কথা তুলেছিল। সেদিন রাতে আমাদের নীলগঞ্জ হাই স্কুলের মিলিটারি ক্যাম্প আক্রমণ করার কথা ছিল। একটা ছোট্ট কুঁড়েঘরে বসে আমরা কয়েকজন রাত আরো গভীর হওয়ার অপেক্ষা করছিলাম। সেইসময় সাব্বির হঠাৎ ফিসফিস করে বলেছিল,
"আমি কেন যুদ্ধে এসেছি জানিস?"
"কেন?"
সাব্বির হঠাৎ কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। অনেকদিন পর সেদিন সিগারেটের ধোঁয়া দিয়ে রিং বানিয়েছিল ও, নিজের বানানো রিঙের দিকে নিজেই তাকিয়েছিল মুগ্ধ হয়ে। দীর্ঘসময় চুপচাপ কী যেন ভাবার পর ও বলেছিল, "তোর সেই বিকালটার কথা মনে আছে? সেই যে আমি আর মিলি একসাথে রিকশায় উঠেছিলাম।"
আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, "আছে। কেন?"
"আসলে মেয়েটা খুব ছটফটে ধরণের ছিল। রিকশায় উঠেই একটানা কথা বলা শুরু করল। একসময় কী বলে জানিস?"
আমি তেমন কোনো আগ্রহ পাচ্ছিলাম না। দীর্ঘদিন মৃত্যুর সাথে বাস করার পর জীবনের গল্পে আর আগ্রহ থাকে না। তবুও আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "কী বলে?"
"বলে ওর বাবা নাকি ওর জন্য ছেলে খুঁজছে। ওকে জিজ্ঞাসা করেছিল কী ধরণের ছেলে ওর পছন্দ। এখন ওর ইচ্ছা করছে ওর বাবাকে গিয়ে বলে সেদিনের সিনেমাটা দেখতে আর এমন একজন ছেলে খুঁজে বের করতে যার সাহস ঐ সিনেমার একিলিসের মত। ওর ধারণা বেশিরভাগ বাঙালি ছেলেরাই নাকি ভীতু হয়।"
"তাই বলেছিল মিলি?"
"সিরিয়াসলি তো আর বলে নি। তবুও......। আসলে ওর খুব ভালো লেগেছিল একিলিসকে। কী গ্রেট যোদ্ধা ছিল একিলিস দেখিসনি? আর কী সাহস! একিলিস যখন মারা যায় তখন নাকি ওর চোখে পানি চলে এসেছিল।"
"আপা সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। গাড়ি ঘোরাব?"
ড্রাইভারের কথায় আমাদের সম্বিৎ ফিরে এল। শহর ছাড়িয়ে অনেকদূর চলে এসেছি আমরা, কল্যাণপুরের কাছাকাছি। মিলি বলল,
"হ্যাঁ ঘোরাও।"
আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল। মিলি বদলায় নি এটা ভুল, মিলিও অনেক বদলে গেছে। যে মিলি কথা না বলে এক মুহূর্ত থাকতে পারত না, সেই মিলি দীর্ঘ সময় কথা না বলে অন্যমনস্ককভাবে বাইরে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে ঢাকা শহরটা যখন রহস্যে ডুবে যাচ্ছে তখন মিলি মুখ খুলল। আমার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল,
"সেলিম ভাই, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।"
"বাহ, ভালো তো।" কৃত্রিম উচ্ছ্বাস ফুটে উঠল আমার গলায়। "ছেলে কী করে?"
"ইঞ্জিনিয়ার। আমেরিকায় থাকে। বিয়ের পর আমিও চলে যাব। ভিসা, পাসপোর্ট সব হয়ে গেছে।"
আমার একবার ইচ্ছা হল বলি, "মিলি সাব্বির তোমাকে এই দেশটা উপহার দিয়ে গেছে।"
কিন্তু আমি কিছুই বললাম না। পকেট থেকে কে-টু সিগারেটের প্যাকেট বের করে খুলে দিলাম গাড়ির বন্ধ জানালা।
নিকোটিনের তৃষ্ণা পেয়েছে খুব।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে অনেক যুবককে উদ্ধার করা হয়। ওরা আমাদের কাছে সাব্বিরের গল্প করত। মিলিটারীরা সব রকম টর্চার করেছিল ওর উপর। ঠাণ্ডা পানিতে মাথা ডুবানো থেকে শুরু করে প্লায়ার্স দিয়ে একে একে সবগুলো আঙুল তুলে ফেলা পর্যন্ত। তবুও ও একটা কথাও বলে নি। আমার চোখের সামনে মাঝে মাঝেই একটা দৃশ্য কল্পনায় ভেসে ওঠে। ছোট্ট একটা টেবিলের একপাশে বসে আছে কালো সানগ্লাস পরা মিলিটারি ক্যাপ্টেন, এপাশে সাব্বির। সানগ্লাসের আড়ালে ক্যাপ্টেন সাহেবের চোখ ঢাকা, কিন্তু সে চোখে নিশ্চিত বিস্ময়। সামনে বসে থাকা এই বাঙালি যুবকের সাহস দেখে বিস্ময়। সমস্ত শরীর রক্তে ভেজা, হাতের আঙুলগুলো সব টেনে টেনে তুলে ফেলা হয়েছে, তারপরেও চোখের দৃষ্টি কী তীব্র। ক্যাপ্টেন সাহেব শেষবারের মত প্রশ্ন করতে চান, "তুমি তোমার বন্ধুদের ঠিকানা বলবে কিনা?" কিন্তু জানেন প্রশ্ন করে কোনো লাভ হবে না। তার সামনে বসে থাকা এই যুবক পরাজয়ের চেয়ে মৃত্যুকে অনেক বেশি ভালোবাসে।
ক্যাপ্টেন সাহেব বুঝতে পারেন যে পরাজয় খুব কাছে চলে এসেছে। এইসব অদম্য যুবকদের বেশিদিন আটকে রাখা যায় না।
পৃথিবীর মানুষ, তোমরা আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। রূপকথার একিলিস কি সাব্বিরের চেয়েও বেশি সাহসী ছিল?
যুদ্ধের সময় সাব্বিরের কাছে সবসময় একটা বই থাকত। গুলিস্তানে ফুটপাত থেকে কেনা চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাস, 'এ টেল অভ টু সিটিজ'। সাব্বিরের শেষ স্মৃতি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বইটা আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি। কিন্তু আজকের এই রহস্যময় সন্ধ্যায় মিলিদের সাদা গাড়িতে বসে আমি হঠাৎ বুঝতে পারলাম যে শেষ স্মৃতিটাকেও মুছে ফেলার সময় হয়ে গেছে। পৃথিবীর মানুষের সাব্বিরকে ভুলে যাওয়ার সময় চলে এসেছে। গভীর রাতে বইটা হাতে নিয়ে আমি একা একা ছাদে এসে দাঁড়ালাম। যুদ্ধের সময় সাব্বির মাঝে মাঝে আমাকে শেষ লাইনগুলো পড়ে শোনাত, "এক মা তার ছেলেকে রূপকথার গল্প বলছে, দুঃসাহসী এক বীরের গল্প। সেই বীরের নাম সিডনি কার্টন।" এই গভীর রাতে আকাশের লক্ষ তারার নিচে দাঁড়িয়ে আমার চোখের সামনে হঠাৎ ভেসে উঠল সিডনি কার্টন নয়, সাব্বিরের নাম। এক মা তার ছেলেকে রূপকথার গল্প বলছে, দুঃসাহসী এক বীরের গল্প। সেই বীরের নাম সাব্বির।
একটা ঘুমন্ত পৃথিবী আর আকাশের লক্ষ লক্ষ তারাকে সাক্ষী রেখে আমি একটা জ্বলন্ত ম্যাচকাঠি ছুঁড়ে দিলাম বইটার উপরে।
পৃথিবীর মানুষ, তোমরা নতুন করে বাঁচতে শেখ।
ভুলে যাও ওদেরকে।
(সমাপ্ত)
ছোট বোন নিশ্চয়ই মজার কোনো কথা বলেছে। মিলি হাসতে হাসতে একদম গড়িয়ে পড়ছে। আঁচল চাপা দিয়ে হাসি আটকানোর চেষ্টা করেও পারছে না। এভাবে ওদের পিছে পিছে ঘোরাও ঠিক হচ্ছে না নিশ্চয়ই। আগের সেই দিন আর নেই। একটা যুদ্ধ শুধু একটা দেশকেই না, দেশের মানুষগুলোকেও অনেক দূরে সরিয়ে দিয়ে গেছে। আমার এই পোড়া গায়ের রঙ, মুখ ভর্তি দাঁড়ি গোফের জঙ্গল দেখে মিলি নিশ্চয়ই আমাকে চিনতে পারবে না। জানুয়ারীর তিন তারিখে আমি যখন শান্তিনগরে ছোট মামার বাসায় ফিরে এলাম তখন দরজা খুলে মামাও আমাকে দেখে চিনতে পারে নি। মিলি তো সেখানে আরো কত দূরের মানুষ।
ছোট ছোট বাচ্চারা বাবা মায়ের হাত ধরে ঘুরছে। দেখতে চমৎকার লাগছে। এরকম জায়গায় আমার মত একটা মানুষ নিশ্চয় বেমানান। কেউ কেউ আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আগে ছুটির দিনে বিকালে আড্ডা দিতে দিতে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে যেত টেরও পেতাম না। একটা যুদ্ধ সেই সুন্দর সময়গুলোকে কী নিষ্ঠুরভাবেই না বদলে দিয়ে গেল। তৌফিক মারা গেছে কাঁচপুর অপারেশনে। সাব্বির ধরা পড়ল নভেম্বরের শেষে। শফিক, মামুন, শওকত সবাই চলে গেল একে একে.....................
"সেলিম ভাই, আপনি?"
অন্যমনস্কভাবে কখন মিলির কাছাকাছি এসে গেছি টের পাই নি। এবং আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে মিলি আমাকে চিনতে পারছে। কোনো কোনো মেয়ের হয়তো বাইরের চোখ দুটোর পিছনেও তৃতীয় কোনো চোখ থাকে। যে চোখ দিয়ে তারা ভিতরের মানুষটাকেও খুব সহজেই দেখতে পারে।
আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম।
"কেমন আছ মিলি?"
"আমি আর কেমন থাকব। আগের মতই আছি। আপনাদের মত যুদ্ধ করতে গিয়ে হারিয়ে যাই নি।"
"ইচ্ছা করে হারিয়ে যাই নি মিলি। বাধ্য হয়েছি। যুদ্ধ করতে গেলে সবাইকেই হয়তো হারিয়ে যেতে হয়।"
"কিন্তু যুদ্ধ শেষে সবাই আবার ফিরেও আসে সেলিম ভাই।"
এসব কথা আমার আর বলতে ইচ্ছা করে না।
"এসব কথা থাক মিলি। তোমার বোনকে দেখ আমার দিকে কেমন ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে।"
"শুধু শিউলি না, রাস্তা দিয়ে যারা যাচ্ছে তারাই আপনার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে। নিজেকে একবার আয়নায় দেখছেন?"
"দেখে লাভ কী? চিনতে তো পারব না। যেদিন থেকে যুদ্ধে গেলাম সেদিন থেকেই নিজেকে আর চিনতে পারি না। আমার কথা থাক। তোমাদের কথা বল বরং।"
মিলি হঠাৎ কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবল। তারপর বলল,
"সেলিম ভাই, বাইরে গাড়ি আছে। চলুন গাড়িতে করে কিছুক্ষণ ঘুরে আসি। অনেক কথা এখনো শোনার বাকি আছে আপনার কাছ থেকে।"
আমি হাসলাম। "তোমাদের ড্রাইভার আমাকে গাড়িতে উঠতেই দেবে না। নির্ঘাত রাস্তার কোনো মাস্তান মনে করবে।"
"অজুহাত দেবেন না সেলিম ভাই। অজুহাত আমার একদম পছন্দ না। অবশ্য আমাদের গাড়িতে বসতে যদি আপনার আপত্তি থাকে তাহলে থাক।"
আপত্তি থাকলেও এর পর আর আপত্তি করা চলে না। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
"তুমি একটুও বদলাওনি মিলি। এখনো সেই আগের মত বাচ্চাদের মত অভিমান করছ।"
গাড়ি চলতে শুরু করলে মিলি আস্তে আস্তে বলল, "সাব্বির ভাই আর বেঁচে নেই, তাই না?"
হঠাৎ করে সেদিন বিকালটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। মালিবাগ ক্রসিঙের কাছে একটা মিলিটারি জিপ সব গাড়ি থামিয়ে চেক করছে। রফিক ফিস ফিস করে বলল, "সর্বনাশ, এখন কী হবে? একটা কুইক টার্ন নেব নাকি সাব্বির ভাই?"
সাব্বির মুহূর্তের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিল। ঠোঁটে চেপে থাকা জ্বলন্ত সিগারেটটাতে লম্বা টান দিয়ে শান্ত করল তার ইস্পাতের মত শক্ত স্নায়ুটাকে। তারপর সেটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে বলল, "না, আমরা যথেষ্ট মানুষ আছি। ওদেরকে ফেস করব। গাড়ি নিয়ে পালানোর জন্য আমরা যুদ্ধে আসিনি।"
সাব্বিরের যুক্তিতে হয়তো কিছু ভুল ছিল। মাঝে মাঝে পিছু হঠাও যুদ্ধেরই অংশ। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত প্রবীণ কোনো জেনারেলের মুখে মানায়, তরুণ কোনো যোদ্ধার মুখে নয়। সেই মুহূর্তে সাব্বিরের চেহারা এখনো আমার চোখের সামনে ভাসে। কী কঠিন, দৃঢ় চেহারা, আর কী ইস্পাতের মত শক্ত নার্ভ। অথচ যুদ্ধের আগে আমরা যখন কলাভবনের বারান্দায় আড্ডা দিতাম, তখন এই সাব্বিরই ছিল সবচেয়ে মুখচোরা। আমরা কথা বলতাম, ও শুধু শুনত। কিন্তু হলদিয়ার যুদ্ধে কমাণ্ডার আকবর ভাই মারা যাওয়ার পর থেকে প্রতিটা অপারেশনে সাব্বিরই ছিল আমাদের লিডার। ওর নিখুঁত প্ল্যান আর প্রচণ্ড দুঃসাহস দেখে আমরাও মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যেতাম। নীলগঞ্জ যুদ্ধের পর ও নিজের হাতে ছয়জন মিলিটারিকে গুলি করে নদীতে ফেলে দিয়েছিল। একটুও হাত কাঁপে নি। আমরা ভেবে পেতাম না, যুদ্ধই কি ওকে এতটা বদলে দিয়েছে? নাকি ও আগে থেকেই এরকম ছিল। আমরাই বুঝতে পারি নি।
"কী হল সেলিম ভাই, সহজ উত্তরটা দিতে এত সময় নিচ্ছেন কেন?"
আমি একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। "জানি না। নভেম্বরের শেষে ও ধরা পড়ে। তারপর আর কোনো খবর পাই নি।"
মিলি হয়তো উত্তরটা জানত। তারপরও অন্যমনস্ক হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। মিলিকে আমাদের আড্ডায় এনেছিল মিজান। আমাদের মধ্যে মেয়েদের সাথে সবচেয়ে বেশি মিশতে পারত মিজানই। মাঝে মাঝেই অপরিচিত কোনো মেয়েকে নিয়ে এসে বলত, "পরিচয় করিয়ে দেই। এ হল শারমিন। কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হয়েছে এবার। ওর সাথে আমার পরিচয়ের সূত্রটা হল............"
অনেক সূত্র থাকত মিজানের। আমরা আড়ালে ওকে ঈর্ষাও করতাম কিছুটা। সেই মিজান একটা পা হারিয়ে ওদের টিকাটুলির বাসায় পড়ে আছে। বাসা থেকে বের হয় না ছয় মাস। সোনাহারা অপারেশনের সময় কমাণ্ডার আকবর ভাই বলেছিল, "একজনকে সামনে গিয়ে চার্জ করতে হবে। ব্রিজের কাছে দুজন পাঞ্জাবি সিপাহী থাকে। একজন গিয়ে ওদের শেষ করে সিগন্যাল দিতে হবে। একজনকেই যেতে হবে কারণ ভুল হলে যেন রিস্ক একজনেরই থাকে। কে যাবেন?"
মিজান এগিয়ে গিয়েছিল।
সেই অন্ধকার রাতে ও নির্বিকারভাবে বলেছিল, "আকবর ভাই, আমি যাব।"
সেই রাতের পর থেকে ওকে আমার আরো বেশি ঈর্ষা হয়।
আবার সেই দুঃস্বপ্নের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। না, সেইসব ভয়ঙ্কর রাতের কথা আর মনে করতে চাই না। তার চেয়ে আগের সেই সুন্দর দিনগুলোর কথা মনে করা যাক। একদিন মিজান এসে বলল, "গুলিস্তানে একটা নতুন সিনেমা এসেছে, হেলেন অব ট্রয়, দেখতে যাবি?"
তৌফিক একটু আপত্তি করেছিল। কিন্তু মিজানের উৎসাহের কাছে সে আপত্তি টিকলো না। ও সেদিন কোথা থেকে যেন মিলিকেও ধরে এনেছিল। সবাই মিলে হৈ চৈ করতে করতে যাওয়া হল। কিন্তু ফেরার সময় একটা সমস্যা হল। মিলিদের বাসা যাত্রাবাড়ি। মিজান ওকে কিছুতেই একা যেতে দেবে না। হঠাৎ ও সাব্বিরকে বলল, "সাব্বির তুই একটু মিলিকে রিকশায় করে পৌঁছে দিয়ে আয় না। আমার আবার একটু কাজ আছে শাহবাগের দিকে।"
কাজটাজ আসলে কিছু ছিল না। কলাভবনের বারান্দায় আড্ডা না দিলে আমাদের বিকালটাই নষ্ট হত। আমাদের আড্ডায় মুখচোরা সাব্বিরের অনুপস্থিটাই চোখে পড়ত সবচেয়ে কম। মিজানের এই হঠাৎ প্রস্তাবে ও কী বলবে তাই বুঝতে পারল না। মিজান অবশ্য আর দেরি করে নি, একটা রিকশা ডেকে ওদেরকে তুলে দিয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম বেচারা পুরা রাস্তা মনে হয় জড়সড় হয়ে বসে ছিল। আমরা আর এ নিয়ে ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করি নি। অনেকদিন পর, ঢাকা থেকে বহু দূরে নীলগঞ্জ নামের একটা ছোট্ট গ্রামে বসে সাব্বির সেই বিকালের কথা তুলেছিল। সেদিন রাতে আমাদের নীলগঞ্জ হাই স্কুলের মিলিটারি ক্যাম্প আক্রমণ করার কথা ছিল। একটা ছোট্ট কুঁড়েঘরে বসে আমরা কয়েকজন রাত আরো গভীর হওয়ার অপেক্ষা করছিলাম। সেইসময় সাব্বির হঠাৎ ফিসফিস করে বলেছিল,
"আমি কেন যুদ্ধে এসেছি জানিস?"
"কেন?"
সাব্বির হঠাৎ কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। অনেকদিন পর সেদিন সিগারেটের ধোঁয়া দিয়ে রিং বানিয়েছিল ও, নিজের বানানো রিঙের দিকে নিজেই তাকিয়েছিল মুগ্ধ হয়ে। দীর্ঘসময় চুপচাপ কী যেন ভাবার পর ও বলেছিল, "তোর সেই বিকালটার কথা মনে আছে? সেই যে আমি আর মিলি একসাথে রিকশায় উঠেছিলাম।"
আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, "আছে। কেন?"
"আসলে মেয়েটা খুব ছটফটে ধরণের ছিল। রিকশায় উঠেই একটানা কথা বলা শুরু করল। একসময় কী বলে জানিস?"
আমি তেমন কোনো আগ্রহ পাচ্ছিলাম না। দীর্ঘদিন মৃত্যুর সাথে বাস করার পর জীবনের গল্পে আর আগ্রহ থাকে না। তবুও আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "কী বলে?"
"বলে ওর বাবা নাকি ওর জন্য ছেলে খুঁজছে। ওকে জিজ্ঞাসা করেছিল কী ধরণের ছেলে ওর পছন্দ। এখন ওর ইচ্ছা করছে ওর বাবাকে গিয়ে বলে সেদিনের সিনেমাটা দেখতে আর এমন একজন ছেলে খুঁজে বের করতে যার সাহস ঐ সিনেমার একিলিসের মত। ওর ধারণা বেশিরভাগ বাঙালি ছেলেরাই নাকি ভীতু হয়।"
"তাই বলেছিল মিলি?"
"সিরিয়াসলি তো আর বলে নি। তবুও......। আসলে ওর খুব ভালো লেগেছিল একিলিসকে। কী গ্রেট যোদ্ধা ছিল একিলিস দেখিসনি? আর কী সাহস! একিলিস যখন মারা যায় তখন নাকি ওর চোখে পানি চলে এসেছিল।"
"আপা সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। গাড়ি ঘোরাব?"
ড্রাইভারের কথায় আমাদের সম্বিৎ ফিরে এল। শহর ছাড়িয়ে অনেকদূর চলে এসেছি আমরা, কল্যাণপুরের কাছাকাছি। মিলি বলল,
"হ্যাঁ ঘোরাও।"
আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল। মিলি বদলায় নি এটা ভুল, মিলিও অনেক বদলে গেছে। যে মিলি কথা না বলে এক মুহূর্ত থাকতে পারত না, সেই মিলি দীর্ঘ সময় কথা না বলে অন্যমনস্ককভাবে বাইরে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে ঢাকা শহরটা যখন রহস্যে ডুবে যাচ্ছে তখন মিলি মুখ খুলল। আমার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল,
"সেলিম ভাই, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।"
"বাহ, ভালো তো।" কৃত্রিম উচ্ছ্বাস ফুটে উঠল আমার গলায়। "ছেলে কী করে?"
"ইঞ্জিনিয়ার। আমেরিকায় থাকে। বিয়ের পর আমিও চলে যাব। ভিসা, পাসপোর্ট সব হয়ে গেছে।"
আমার একবার ইচ্ছা হল বলি, "মিলি সাব্বির তোমাকে এই দেশটা উপহার দিয়ে গেছে।"
কিন্তু আমি কিছুই বললাম না। পকেট থেকে কে-টু সিগারেটের প্যাকেট বের করে খুলে দিলাম গাড়ির বন্ধ জানালা।
নিকোটিনের তৃষ্ণা পেয়েছে খুব।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে অনেক যুবককে উদ্ধার করা হয়। ওরা আমাদের কাছে সাব্বিরের গল্প করত। মিলিটারীরা সব রকম টর্চার করেছিল ওর উপর। ঠাণ্ডা পানিতে মাথা ডুবানো থেকে শুরু করে প্লায়ার্স দিয়ে একে একে সবগুলো আঙুল তুলে ফেলা পর্যন্ত। তবুও ও একটা কথাও বলে নি। আমার চোখের সামনে মাঝে মাঝেই একটা দৃশ্য কল্পনায় ভেসে ওঠে। ছোট্ট একটা টেবিলের একপাশে বসে আছে কালো সানগ্লাস পরা মিলিটারি ক্যাপ্টেন, এপাশে সাব্বির। সানগ্লাসের আড়ালে ক্যাপ্টেন সাহেবের চোখ ঢাকা, কিন্তু সে চোখে নিশ্চিত বিস্ময়। সামনে বসে থাকা এই বাঙালি যুবকের সাহস দেখে বিস্ময়। সমস্ত শরীর রক্তে ভেজা, হাতের আঙুলগুলো সব টেনে টেনে তুলে ফেলা হয়েছে, তারপরেও চোখের দৃষ্টি কী তীব্র। ক্যাপ্টেন সাহেব শেষবারের মত প্রশ্ন করতে চান, "তুমি তোমার বন্ধুদের ঠিকানা বলবে কিনা?" কিন্তু জানেন প্রশ্ন করে কোনো লাভ হবে না। তার সামনে বসে থাকা এই যুবক পরাজয়ের চেয়ে মৃত্যুকে অনেক বেশি ভালোবাসে।
ক্যাপ্টেন সাহেব বুঝতে পারেন যে পরাজয় খুব কাছে চলে এসেছে। এইসব অদম্য যুবকদের বেশিদিন আটকে রাখা যায় না।
পৃথিবীর মানুষ, তোমরা আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। রূপকথার একিলিস কি সাব্বিরের চেয়েও বেশি সাহসী ছিল?
যুদ্ধের সময় সাব্বিরের কাছে সবসময় একটা বই থাকত। গুলিস্তানে ফুটপাত থেকে কেনা চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাস, 'এ টেল অভ টু সিটিজ'। সাব্বিরের শেষ স্মৃতি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বইটা আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি। কিন্তু আজকের এই রহস্যময় সন্ধ্যায় মিলিদের সাদা গাড়িতে বসে আমি হঠাৎ বুঝতে পারলাম যে শেষ স্মৃতিটাকেও মুছে ফেলার সময় হয়ে গেছে। পৃথিবীর মানুষের সাব্বিরকে ভুলে যাওয়ার সময় চলে এসেছে। গভীর রাতে বইটা হাতে নিয়ে আমি একা একা ছাদে এসে দাঁড়ালাম। যুদ্ধের সময় সাব্বির মাঝে মাঝে আমাকে শেষ লাইনগুলো পড়ে শোনাত, "এক মা তার ছেলেকে রূপকথার গল্প বলছে, দুঃসাহসী এক বীরের গল্প। সেই বীরের নাম সিডনি কার্টন।" এই গভীর রাতে আকাশের লক্ষ তারার নিচে দাঁড়িয়ে আমার চোখের সামনে হঠাৎ ভেসে উঠল সিডনি কার্টন নয়, সাব্বিরের নাম। এক মা তার ছেলেকে রূপকথার গল্প বলছে, দুঃসাহসী এক বীরের গল্প। সেই বীরের নাম সাব্বির।
একটা ঘুমন্ত পৃথিবী আর আকাশের লক্ষ লক্ষ তারাকে সাক্ষী রেখে আমি একটা জ্বলন্ত ম্যাচকাঠি ছুঁড়ে দিলাম বইটার উপরে।
পৃথিবীর মানুষ, তোমরা নতুন করে বাঁচতে শেখ।
ভুলে যাও ওদেরকে।
(সমাপ্ত)