আনিস একদিন দুপুরে মাথা নিচু করে ভাত মাখাতে মাখাতে বলল, "রাবেয়া আপা, আপনার পরিচিত কোনো অনাথ, এতিম, দুঃখী মেয়ে যার বিয়ে হচ্ছেনা এরকম কেউ থাকলে আমাকে বলবেন।" শুনে মনটা খারাপ হল। বেচারা অনেকদিন ধরে বিয়ের চেষ্টা করছে। আনিসের সাথে কথা হচ্ছিলো অফিসের ক্যান্টিনে বসে।
আনিস আমাদের ব্রাঞ্চে জয়েন করেছে মাস খানেক আগে। শান্তশিষ্ট একটা ছেলে। ভালো ব্যবহার আর নিষ্ঠার সাথে কাজ করে ইতিমধ্যেই সবার মন জয় করে ফেলেছে। দুপুরে খাওয়ার সময় প্রায়ই দেখি পিয়নকে দিয়ে বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে খায় নয়তো বাইরে থেকে খেয়ে আসে। আমি বাসা থেকে প্রতিদিন খাবার আনি। মাঝেমধ্যে সহকর্মীদের জন্যও টুকটাক বাসায় তৈরি খাবার নিয়ে আসি। আনিস ও মাঝে মধ্যে ভাগ পায় সেই খাবারের। আমার হাতে বানানো সামান্য একটু টাকি মাছের ভর্তা বা আলুর চপ খেয়েই সে এত খুশি যে মন খুলে মনের যত কষ্ট সব আমার সাথে মাঝে মাঝে শেয়ার করে ফেলে খাবারের টেবিলে বসে।
কথায় কথায় জানলাম আনিস বহুবছর ধরেই মেসে থাকে। মেস আর হোটেলের খাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। এখন ভালো চাকরি করছে তাই ইচ্ছা ছোট একটা বাসা ভাড়া করবে, বিয়ে করে নিজের পরিবার নিয়ে সুখে-শান্তিতে থাকবে। এক জীবনে তার আর কোন চাওয়া নেই। শুধু নিজের একটা পরিবার চায় সে।
লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বাবা এবং ফুফুদের সে নিজেই বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে বলেছে কিন্তু কেউ বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায়নি এই ব্যাপারে। কাছের কিছু বন্ধু দুএকবার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু একটা তুচ্ছ কারনে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে চাইছেনা। সেই তুচ্ছ কারনটা হল আনিসের বাবা প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন এবং আনিস প্রথম ঘরের একমাত্র সন্তান। সৎ মায়ের ঘরে আনিস বেশিদিন টিকতে পারেননি। আনিসের আপন মাও আনিসকে ভুলে নতুন জীবন শুরু করেছেন। আনিসের দাদি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনিই আনিসকে আগলে রেখেছিলেন। দাদি মারা যাওয়ার পরে কেউ আর আনিসের খোঁজ খবর রাখেনি। না নিজের বাবা, না নিজের মা কেউই আনিসকে নিয়ে কখনো মাথা ঘামায়নি। দাদি মারা যাওয়ার পর থেকেই আনিস ঘরছাড়া। ঘর বাড়ির স্থায়ী ঠিকানা নেই যে ছেলের তার কাছে মেয়ে বিয়ে দিবে কে? অনেক কষ্টে আনিস নিজের চেষ্টায় আজ এই পর্যন্ত এসেছে। সেটা অন্য গল্প। আজ আনিসের বিয়ের গল্পটা শুধু বলবো।
আমরা বুঝে গিয়েছিলাম আনিসের পরিবারের লোকজন কখনো তার বিয়ে নিয়ে কিছুই করবেনা তাই আমরা কিছু সহকর্মী এবং আনিসের বন্ধুরা যে যেভাবে পেরেছি চেষ্টা করেছি। আমি নিজে বিভিন্ন ঘটকের কাছে আনিসের বায়োডাটা দিয়েছি কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ আনিসের পরিবারের খোজখবর নিয়ে পিছিয়ে যায়। যে ছেলের বাবা-মার ডিভোর্স হয়ে গেছে সেই ছেলে যে ভালো হতে পারে সেটা কেউ বিশ্বাস করতে রাজি না।
অবশেষে আনিসের এক বন্ধুর মধ্যস্থতায় একদিন বিয়ে ঠিকঠাক। মেয়ের নানা আনিসের সব কিছু জেনে শুনেই নিজের নাতনিকে আনিসের সাথে বিয়ে দিতে রাজী কারন মেয়ের ভাগ্যটাও অনেকটা আনিসের মতই। জন্মের সময় মা মারা যাওয়ার পরে মেয়ে নানা, নানির কাছেই মানুষ। মেয়ের নাম নাজমা।
খুব ছোটখাটো আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে এক শুক্রবার আনিস আর নাজমার বিয়ে হয়ে যায়। আমরা কেউ সেই বিয়েতে যেতে পারিনি কারন বেশি মানুষ দাওয়াত করা হয়নি। আনিসের বাবা, ফুফু আর দুজন বন্ধু বরযাত্রী। মেয়ের নানা বাড়িতে বিয়ে পড়ানো হল। নানা, নানী আর মামা, খালারা কনেপক্ষ।
বিয়ের দুদিন পরে আনিস অফিসে এলে জিজ্ঞেস করলাম, "সব ঠিকঠাক মতন হল?"
আনিসের মুখ অন্ধকার। মন খারাপ করে বলল, "এতিমের বিয়ে তার আবার ঠিকঠাক কি আপা? হয়েছে কোনরকম।"
আনিসের মুখে যা শুনলাম খুব বেশি অবাক হলাম না। এরকমি হয়, হয়ে আসছে যুগযুগ ধরে। বিয়ে সভ্য সমাজের একটা সামাজিকতা মাত্র হলেও সবচেয়ে বেশি অসামাজিকতা এবং অসভ্যতা এই বিয়ের অনুষ্ঠান ঘিরেই হয়। বরপক্ষ, কনেপক্ষ কারনে অকারনে একে অন্যকে ছোট করতে থাকে পুরোটা বিয়ের অনুষ্ঠানে।
আনিসের বিয়েতেও এর ব্যাতিক্রম হয়নি। বিয়ে পড়ানোর সময় কাবিনের টাকা আর উশুল নিয়ে হুলুস্থুল হল। আনিস আজ পর্যন্ত যত টাকা জমাতে পেরেছে তার এক টাকাও বেশি কাবিন করতে রাজি না। কিন্তু মেয়ে পক্ষ এত অল্প টাকা কাবিন করতে রাজি না। মেয়ের নানার মধ্যস্ততায় সেটা সমাধান করা গেলো। কিন্তু উশুল নিয়ে আবারো হইচই। কনেকে কি কি জিনিস দেয়া হয়েছে সেটার দাম হিসাব করা শুরু হল। জিনিস পত্রের খুঁত বের করতে লাগলো লোকজন। আনিসের বাবা, ফুফু শুধুমাত্র অতিথির মতন বিয়েতে যোগ দিয়েছেন। কনের জন্য যা যা প্রয়োজন আনিস নিজের পছন্দে কিনেছে। হতভম্ব আনিস কনেপক্ষকে শুধু এতটুকুই বলেছে, "এইসব আমার কেনা জিনিস, যদি আপনাদের পছন্দ না হয় অসুবিধা নাই। আমি আমার বউকে সব জিনিস আবার কিনে দিবো। আমারই তো বউ। ওর সব কিছুর দায়িত্ব আজকে থেকে আমার।"
বিয়ের পরের দিনই আনিসের ফুফু ফোন করে আনিসকে বলল, "আমরা কেউতো তোর পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করতে বাঁধা দেই নাই কিন্তু কেমন পরিবারের মেয়ে বিয়ে করতে গেলি তুই, মেয়ের জামাইকে একটা সুতাও দিলোনা! মেয়ে জামাইর জন্য ঘড়ি, চেইন আংটি দেয়াতো দূরের কথা, সালামি হিসেবে হাতে অন্তত পাঁচশো টাকার একটা নোটতো দিতে পারতো!"
আনিস তার ফুফুকে কোনো কথার জবাব না দিলেও আমাকে বলল, "রাবেয়া আপা, আপনি একটা ব্যাপার দেখেন। যেখানে কেউ আমার কাছে মেয়ে বিয়ে দিতেই রাজি হচ্ছিলো না সেখানে এই মেয়ের পরিবার নিজেদের আদরের মেয়ে আমার কাছে বিয়ে দিয়েছে, এটাইতো আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। আর কিছু কেন লাগবে? বাকি সব কিছু কেনার ক্ষমতা এখন আমার আছে। বিয়ের পরে সংসার গুছানোতো আমাদের দুজনের দায়িত্ব।" শুনে আমার মনটা ভালো হয়ে গেলো। আহা, সব পুরুষ যদি এভাবে ভাবতে পারতো তাহলে কোন মেয়ে আর বিয়ের পরে কষ্ট পেতোনা।
আনিসের ফুপাতো বোন নাকি আত্নীয় স্বজনকে বলে বেড়াচ্ছে, নিশ্চয়ই মেয়ের কোন ঘাপলা আছে, নাহলে এমন ছেলের কাছে এত তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দিলো কেন? দুই কান ঘুরে সেই কথা ঠিকই আনিসের কানে গেছে। আনিস বললো, "বিয়ে করতে মুরুব্বি প্রয়োজন তাই বাবা আর ফুফু কে নিয়ে বিয়ে করতে গিয়েছিলাম। কেন জানিনা কেউই খুশিনা। যেই বাবা আজ পর্যন্ত আমার কোনো খোঁজ রাখে নাই, সেই বাবা নাজমার নানাকে বিয়ের দিন বলে এসেছে ছেলে হিসেবে আমি নাকি কোনো দায়িত্বই পালন করিনা, নিজের বৃদ্ধ বাবা মা কে সাহায্য করিনা। অথচ আমি প্রতি মাসে বেতন পেয়ে কিছু টাকা বাবাকে পাঠাই, বিয়েতে আসার জন্য বাবার যাতায়াত ভাড়াটা পর্যন্ত আমি নিজে দিয়েছি বাবার হাতে। অথচ দাদি মারা যাওয়ার পর থেকে আমি কিভাবে ছোট থেকে বড় হয়েছি, কোথায় পড়াশুনা করেছি, কিভাবে মেসে মেসে জীবন কাটিয়েছি সেটার খোঁজ কিন্তু বাবা কোনদিনো করে নাই। আমি আজকের পরে আমার বউকে নিয়ে আর কারো বাড়ি যাবোনা, কারো সাথে যোগাযোগও করবোনা।"
প্রচন্ড মন খারাপ হল আনিসের জন্য যদিও এইসব দেখে দেখে আমরা সবাই কমবেশি অভ্যস্ত। একটা ছেলে আর মেয়ে বিয়ের পরে যখন নতুন জীবন শুরু করতে যাবে ঠিক তখন তাদের প্রয়োজন সবার শুভকামনা আর উৎসাহ। কিন্তু আমাদের সমাজে হয় সম্পুর্ন উল্টোটা। বিয়ের আগে, পরে কিছু মানুষ সেই নবদম্পতির কান ভারী করার জন্য তৈরি হয়ে বসে থাকে। আমার এক সহকর্মী ছিলো যে আমার বিয়ের আগে আগে আমাকে ভয় লাগাতো এই বলে, "ছয়মাস, মাত্র ছয়মাস, এরপরেই দেখবেন বিয়ের মজা শেষ! ছয়মাস পরে বিয়ে গলার কাঁটা হয়ে যাবে।" আমি আতংকিত হয়ে ভাবতাম বিয়ে না করেই তো বেশ আছি। কি দরকার শুধু শুধু ঝামেলার!
আমার আম্মার মুখে সবসময় একটা কথা শুনতাম। "একটা কালো ধাগার জন্যও বিয়ে ভেংগে যায় কখনো কখনো।" এরকম একটা ঘটনা আমার নিজের চোখে দেখা। বিয়ের কনের জন্য বিয়ের শাড়ির সাথে মাথায় দেয়ার জন্য আলাদা ম্যাচিং ওড়না কিনতে ভুলে গেছে বরপক্ষ। ওই নিয়ে বিয়ের আসরে দুইপক্ষের তর্কাতর্কি। বরের বড় বোন তক্ষুনি দৌড়ে গেল মার্কেটে ওড়না কিনতে। কিন্তু বর বেঁকে বসলো। সামান্য ওড়নার জন্য যেখানে তার মা বাবা বোনকে অপমান করা হয়েছে সেখানে সে বিয়ে করবেনা। কিছুতেই বিয়ে করবেনা। মেয়ের মামাও গরম দেখিয়ে বলে ফেললো, "ফকিরের ঘরে আমরাই মেয়ে দিবোনা।" ব্যাস, ওইখানেই সব শেষ! না, বিয়ে শেষ পর্যন্ত হয়েছে কিন্তু দুই পরিবারের সম্পর্ক সারাজীবনের জন্য শেষ।
বিয়েতে আসা অতিথিরা যাদের একমাত্র দায়িত্ব বরকনেকে নতুন জীবনের শুরুতে অভিনন্দন জানানো, তারা সেটা না করে দায়িত্বের সাথে যা যা করেন তা হল জানার চেষ্টা করেন বিয়েতে কে কাকে কি দিলো, বর কি কি পেলো, কনে কয় ভরি গয়না পেলো, কনের মা কয় ভরি দিলো, শাশুড়ি কয় ভরি দিলো, বরের মামি, চাচিদের কেমন শাড়ি দিয়েছে কনেপক্ষ, কনের শাড়িটার দাম কত, কনের জন্য কোথা থেকে শপিং করা হয়েছে, কোন গয়নাটা আসল আর কোনটা নকল, বিয়ের খাবারের মান এত খারাপ কেন, বরের চাচাতো, মামাতো, ফুপাতো, খালাতো সব ভাইদের প্লেটে দুরুস দেয়া হয়েছে নাকি, ডেজার্ট মাত্র একটা কেন, অমুকের বিয়েতে তিন রকম ডেজার্ট ছিলো, বরের মাথায় টাক কেন, বরকে ক্যাশ টাকা দিয়েছে নাকি স্যুট বানিয়ে দিয়েছে, ফার্নিচার কি শুধু বেডরুমের জন্য দিয়েছে নাকি এসি, ফ্রিজও দিয়েছে! এরকম হাজারো প্রশ্ন চোখে মুখে নিয়ে অতিথিরা ঘুরতে থাকেন এবং হাওয়ায় ভেসে ভেসে কিছু কিছু কথা বর কনের কানেও চলে আসে। আর এভাবেই ঠিক বিয়ের দিন থেকেই বর কনে হয়ে যায় প্রতিপক্ষ। অথচ তাদের হওয়ার কথা ছিলো একপক্ষ।
=============================
অফিস থেকে বের হওয়ার সময় আনিসের সাথে লিফটে দেখা। বললো, "দোয়া কইরেন আপা, বউকে নিয়ে মার্কেটে যাই। "
আমি বললাম, "বউয়ের পছন্দমত জিনিস কিনে দিয়েন, বেচারি জীবনে প্রথমবার বিয়ে করেছে। "
আনিস বললো, "বউয়ের পক্ষ নিলেন? আমিওতো জীবনে প্রথম বিয়ে করলাম, আমার পক্ষতো নিলেন না। "
আমি বললাম, "আপনার পক্ষইতো নিলাম, আনিস। বউতো আপনারই। বউ খুশি হলে কি আপনি খুশি হবেন না?"
আনিস লজ্জামাখা হাসি দিয়ে বললো, "জি আপা, তাতো ঠিকই। আমারই তো বউ।"
(সমাপ্ত)
আনিস আমাদের ব্রাঞ্চে জয়েন করেছে মাস খানেক আগে। শান্তশিষ্ট একটা ছেলে। ভালো ব্যবহার আর নিষ্ঠার সাথে কাজ করে ইতিমধ্যেই সবার মন জয় করে ফেলেছে। দুপুরে খাওয়ার সময় প্রায়ই দেখি পিয়নকে দিয়ে বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে খায় নয়তো বাইরে থেকে খেয়ে আসে। আমি বাসা থেকে প্রতিদিন খাবার আনি। মাঝেমধ্যে সহকর্মীদের জন্যও টুকটাক বাসায় তৈরি খাবার নিয়ে আসি। আনিস ও মাঝে মধ্যে ভাগ পায় সেই খাবারের। আমার হাতে বানানো সামান্য একটু টাকি মাছের ভর্তা বা আলুর চপ খেয়েই সে এত খুশি যে মন খুলে মনের যত কষ্ট সব আমার সাথে মাঝে মাঝে শেয়ার করে ফেলে খাবারের টেবিলে বসে।
কথায় কথায় জানলাম আনিস বহুবছর ধরেই মেসে থাকে। মেস আর হোটেলের খাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। এখন ভালো চাকরি করছে তাই ইচ্ছা ছোট একটা বাসা ভাড়া করবে, বিয়ে করে নিজের পরিবার নিয়ে সুখে-শান্তিতে থাকবে। এক জীবনে তার আর কোন চাওয়া নেই। শুধু নিজের একটা পরিবার চায় সে।
লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বাবা এবং ফুফুদের সে নিজেই বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে বলেছে কিন্তু কেউ বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায়নি এই ব্যাপারে। কাছের কিছু বন্ধু দুএকবার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু একটা তুচ্ছ কারনে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে চাইছেনা। সেই তুচ্ছ কারনটা হল আনিসের বাবা প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন এবং আনিস প্রথম ঘরের একমাত্র সন্তান। সৎ মায়ের ঘরে আনিস বেশিদিন টিকতে পারেননি। আনিসের আপন মাও আনিসকে ভুলে নতুন জীবন শুরু করেছেন। আনিসের দাদি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনিই আনিসকে আগলে রেখেছিলেন। দাদি মারা যাওয়ার পরে কেউ আর আনিসের খোঁজ খবর রাখেনি। না নিজের বাবা, না নিজের মা কেউই আনিসকে নিয়ে কখনো মাথা ঘামায়নি। দাদি মারা যাওয়ার পর থেকেই আনিস ঘরছাড়া। ঘর বাড়ির স্থায়ী ঠিকানা নেই যে ছেলের তার কাছে মেয়ে বিয়ে দিবে কে? অনেক কষ্টে আনিস নিজের চেষ্টায় আজ এই পর্যন্ত এসেছে। সেটা অন্য গল্প। আজ আনিসের বিয়ের গল্পটা শুধু বলবো।
আমরা বুঝে গিয়েছিলাম আনিসের পরিবারের লোকজন কখনো তার বিয়ে নিয়ে কিছুই করবেনা তাই আমরা কিছু সহকর্মী এবং আনিসের বন্ধুরা যে যেভাবে পেরেছি চেষ্টা করেছি। আমি নিজে বিভিন্ন ঘটকের কাছে আনিসের বায়োডাটা দিয়েছি কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ আনিসের পরিবারের খোজখবর নিয়ে পিছিয়ে যায়। যে ছেলের বাবা-মার ডিভোর্স হয়ে গেছে সেই ছেলে যে ভালো হতে পারে সেটা কেউ বিশ্বাস করতে রাজি না।
অবশেষে আনিসের এক বন্ধুর মধ্যস্থতায় একদিন বিয়ে ঠিকঠাক। মেয়ের নানা আনিসের সব কিছু জেনে শুনেই নিজের নাতনিকে আনিসের সাথে বিয়ে দিতে রাজী কারন মেয়ের ভাগ্যটাও অনেকটা আনিসের মতই। জন্মের সময় মা মারা যাওয়ার পরে মেয়ে নানা, নানির কাছেই মানুষ। মেয়ের নাম নাজমা।
খুব ছোটখাটো আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে এক শুক্রবার আনিস আর নাজমার বিয়ে হয়ে যায়। আমরা কেউ সেই বিয়েতে যেতে পারিনি কারন বেশি মানুষ দাওয়াত করা হয়নি। আনিসের বাবা, ফুফু আর দুজন বন্ধু বরযাত্রী। মেয়ের নানা বাড়িতে বিয়ে পড়ানো হল। নানা, নানী আর মামা, খালারা কনেপক্ষ।
বিয়ের দুদিন পরে আনিস অফিসে এলে জিজ্ঞেস করলাম, "সব ঠিকঠাক মতন হল?"
আনিসের মুখ অন্ধকার। মন খারাপ করে বলল, "এতিমের বিয়ে তার আবার ঠিকঠাক কি আপা? হয়েছে কোনরকম।"
আনিসের মুখে যা শুনলাম খুব বেশি অবাক হলাম না। এরকমি হয়, হয়ে আসছে যুগযুগ ধরে। বিয়ে সভ্য সমাজের একটা সামাজিকতা মাত্র হলেও সবচেয়ে বেশি অসামাজিকতা এবং অসভ্যতা এই বিয়ের অনুষ্ঠান ঘিরেই হয়। বরপক্ষ, কনেপক্ষ কারনে অকারনে একে অন্যকে ছোট করতে থাকে পুরোটা বিয়ের অনুষ্ঠানে।
আনিসের বিয়েতেও এর ব্যাতিক্রম হয়নি। বিয়ে পড়ানোর সময় কাবিনের টাকা আর উশুল নিয়ে হুলুস্থুল হল। আনিস আজ পর্যন্ত যত টাকা জমাতে পেরেছে তার এক টাকাও বেশি কাবিন করতে রাজি না। কিন্তু মেয়ে পক্ষ এত অল্প টাকা কাবিন করতে রাজি না। মেয়ের নানার মধ্যস্ততায় সেটা সমাধান করা গেলো। কিন্তু উশুল নিয়ে আবারো হইচই। কনেকে কি কি জিনিস দেয়া হয়েছে সেটার দাম হিসাব করা শুরু হল। জিনিস পত্রের খুঁত বের করতে লাগলো লোকজন। আনিসের বাবা, ফুফু শুধুমাত্র অতিথির মতন বিয়েতে যোগ দিয়েছেন। কনের জন্য যা যা প্রয়োজন আনিস নিজের পছন্দে কিনেছে। হতভম্ব আনিস কনেপক্ষকে শুধু এতটুকুই বলেছে, "এইসব আমার কেনা জিনিস, যদি আপনাদের পছন্দ না হয় অসুবিধা নাই। আমি আমার বউকে সব জিনিস আবার কিনে দিবো। আমারই তো বউ। ওর সব কিছুর দায়িত্ব আজকে থেকে আমার।"
বিয়ের পরের দিনই আনিসের ফুফু ফোন করে আনিসকে বলল, "আমরা কেউতো তোর পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করতে বাঁধা দেই নাই কিন্তু কেমন পরিবারের মেয়ে বিয়ে করতে গেলি তুই, মেয়ের জামাইকে একটা সুতাও দিলোনা! মেয়ে জামাইর জন্য ঘড়ি, চেইন আংটি দেয়াতো দূরের কথা, সালামি হিসেবে হাতে অন্তত পাঁচশো টাকার একটা নোটতো দিতে পারতো!"
আনিস তার ফুফুকে কোনো কথার জবাব না দিলেও আমাকে বলল, "রাবেয়া আপা, আপনি একটা ব্যাপার দেখেন। যেখানে কেউ আমার কাছে মেয়ে বিয়ে দিতেই রাজি হচ্ছিলো না সেখানে এই মেয়ের পরিবার নিজেদের আদরের মেয়ে আমার কাছে বিয়ে দিয়েছে, এটাইতো আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। আর কিছু কেন লাগবে? বাকি সব কিছু কেনার ক্ষমতা এখন আমার আছে। বিয়ের পরে সংসার গুছানোতো আমাদের দুজনের দায়িত্ব।" শুনে আমার মনটা ভালো হয়ে গেলো। আহা, সব পুরুষ যদি এভাবে ভাবতে পারতো তাহলে কোন মেয়ে আর বিয়ের পরে কষ্ট পেতোনা।
আনিসের ফুপাতো বোন নাকি আত্নীয় স্বজনকে বলে বেড়াচ্ছে, নিশ্চয়ই মেয়ের কোন ঘাপলা আছে, নাহলে এমন ছেলের কাছে এত তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দিলো কেন? দুই কান ঘুরে সেই কথা ঠিকই আনিসের কানে গেছে। আনিস বললো, "বিয়ে করতে মুরুব্বি প্রয়োজন তাই বাবা আর ফুফু কে নিয়ে বিয়ে করতে গিয়েছিলাম। কেন জানিনা কেউই খুশিনা। যেই বাবা আজ পর্যন্ত আমার কোনো খোঁজ রাখে নাই, সেই বাবা নাজমার নানাকে বিয়ের দিন বলে এসেছে ছেলে হিসেবে আমি নাকি কোনো দায়িত্বই পালন করিনা, নিজের বৃদ্ধ বাবা মা কে সাহায্য করিনা। অথচ আমি প্রতি মাসে বেতন পেয়ে কিছু টাকা বাবাকে পাঠাই, বিয়েতে আসার জন্য বাবার যাতায়াত ভাড়াটা পর্যন্ত আমি নিজে দিয়েছি বাবার হাতে। অথচ দাদি মারা যাওয়ার পর থেকে আমি কিভাবে ছোট থেকে বড় হয়েছি, কোথায় পড়াশুনা করেছি, কিভাবে মেসে মেসে জীবন কাটিয়েছি সেটার খোঁজ কিন্তু বাবা কোনদিনো করে নাই। আমি আজকের পরে আমার বউকে নিয়ে আর কারো বাড়ি যাবোনা, কারো সাথে যোগাযোগও করবোনা।"
প্রচন্ড মন খারাপ হল আনিসের জন্য যদিও এইসব দেখে দেখে আমরা সবাই কমবেশি অভ্যস্ত। একটা ছেলে আর মেয়ে বিয়ের পরে যখন নতুন জীবন শুরু করতে যাবে ঠিক তখন তাদের প্রয়োজন সবার শুভকামনা আর উৎসাহ। কিন্তু আমাদের সমাজে হয় সম্পুর্ন উল্টোটা। বিয়ের আগে, পরে কিছু মানুষ সেই নবদম্পতির কান ভারী করার জন্য তৈরি হয়ে বসে থাকে। আমার এক সহকর্মী ছিলো যে আমার বিয়ের আগে আগে আমাকে ভয় লাগাতো এই বলে, "ছয়মাস, মাত্র ছয়মাস, এরপরেই দেখবেন বিয়ের মজা শেষ! ছয়মাস পরে বিয়ে গলার কাঁটা হয়ে যাবে।" আমি আতংকিত হয়ে ভাবতাম বিয়ে না করেই তো বেশ আছি। কি দরকার শুধু শুধু ঝামেলার!
আমার আম্মার মুখে সবসময় একটা কথা শুনতাম। "একটা কালো ধাগার জন্যও বিয়ে ভেংগে যায় কখনো কখনো।" এরকম একটা ঘটনা আমার নিজের চোখে দেখা। বিয়ের কনের জন্য বিয়ের শাড়ির সাথে মাথায় দেয়ার জন্য আলাদা ম্যাচিং ওড়না কিনতে ভুলে গেছে বরপক্ষ। ওই নিয়ে বিয়ের আসরে দুইপক্ষের তর্কাতর্কি। বরের বড় বোন তক্ষুনি দৌড়ে গেল মার্কেটে ওড়না কিনতে। কিন্তু বর বেঁকে বসলো। সামান্য ওড়নার জন্য যেখানে তার মা বাবা বোনকে অপমান করা হয়েছে সেখানে সে বিয়ে করবেনা। কিছুতেই বিয়ে করবেনা। মেয়ের মামাও গরম দেখিয়ে বলে ফেললো, "ফকিরের ঘরে আমরাই মেয়ে দিবোনা।" ব্যাস, ওইখানেই সব শেষ! না, বিয়ে শেষ পর্যন্ত হয়েছে কিন্তু দুই পরিবারের সম্পর্ক সারাজীবনের জন্য শেষ।
বিয়েতে আসা অতিথিরা যাদের একমাত্র দায়িত্ব বরকনেকে নতুন জীবনের শুরুতে অভিনন্দন জানানো, তারা সেটা না করে দায়িত্বের সাথে যা যা করেন তা হল জানার চেষ্টা করেন বিয়েতে কে কাকে কি দিলো, বর কি কি পেলো, কনে কয় ভরি গয়না পেলো, কনের মা কয় ভরি দিলো, শাশুড়ি কয় ভরি দিলো, বরের মামি, চাচিদের কেমন শাড়ি দিয়েছে কনেপক্ষ, কনের শাড়িটার দাম কত, কনের জন্য কোথা থেকে শপিং করা হয়েছে, কোন গয়নাটা আসল আর কোনটা নকল, বিয়ের খাবারের মান এত খারাপ কেন, বরের চাচাতো, মামাতো, ফুপাতো, খালাতো সব ভাইদের প্লেটে দুরুস দেয়া হয়েছে নাকি, ডেজার্ট মাত্র একটা কেন, অমুকের বিয়েতে তিন রকম ডেজার্ট ছিলো, বরের মাথায় টাক কেন, বরকে ক্যাশ টাকা দিয়েছে নাকি স্যুট বানিয়ে দিয়েছে, ফার্নিচার কি শুধু বেডরুমের জন্য দিয়েছে নাকি এসি, ফ্রিজও দিয়েছে! এরকম হাজারো প্রশ্ন চোখে মুখে নিয়ে অতিথিরা ঘুরতে থাকেন এবং হাওয়ায় ভেসে ভেসে কিছু কিছু কথা বর কনের কানেও চলে আসে। আর এভাবেই ঠিক বিয়ের দিন থেকেই বর কনে হয়ে যায় প্রতিপক্ষ। অথচ তাদের হওয়ার কথা ছিলো একপক্ষ।
=============================
অফিস থেকে বের হওয়ার সময় আনিসের সাথে লিফটে দেখা। বললো, "দোয়া কইরেন আপা, বউকে নিয়ে মার্কেটে যাই। "
আমি বললাম, "বউয়ের পছন্দমত জিনিস কিনে দিয়েন, বেচারি জীবনে প্রথমবার বিয়ে করেছে। "
আনিস বললো, "বউয়ের পক্ষ নিলেন? আমিওতো জীবনে প্রথম বিয়ে করলাম, আমার পক্ষতো নিলেন না। "
আমি বললাম, "আপনার পক্ষইতো নিলাম, আনিস। বউতো আপনারই। বউ খুশি হলে কি আপনি খুশি হবেন না?"
আনিস লজ্জামাখা হাসি দিয়ে বললো, "জি আপা, তাতো ঠিকই। আমারই তো বউ।"
(সমাপ্ত)