What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Self-Made শেষ থেকে শুরু 🌅🌅🌅🌅🌅 (1 Viewer)

Fahima

Senior Member
Joined
Apr 8, 2019
Threads
137
Messages
539
Credits
32,076
বড় চাচার জোরাজুরিতে ঢাকা আসার পর আমরা ধানমন্ডিতে বড় চাচার বাসায় উঠেছিলাম । ঢাকায় না আসলেও আমাদের চলতো । খুলনায় আমরা ভালোই ছিলাম । চাচার ব্যাবসা তখন বাড়বাড়ন্ত । চাচা আব্বাকে বলেছিলেন -

তোরা চলে আয়, সাথে করে কিচ্ছু আনতে হবে না । সবকিছু নতুন করে শুরু করবি । আমি সব ব্যবস্থা করে দেবো । তুই শুধু ঢাকায় আয় ।

মা কিন্তু চাচার কথায় একদম ভরসা পায়নি কারণ বড় চাচী আমাদের পছন্দ করতেন না । এই পর্যন্ত যতোবারই ওনার সাথে আমাদের দেখা হয়েছে ততবারই আমার মনে হয়েছে আমরা যেন ফকির মিসকিন টাইপ কোনো কিছু । অথচ আমি যখন মা'র সাথে বড় চাচীকে মেলাতাম, আমার কাছে মনে হতো বড় চাচীর তুলনায় কম শিক্ষিত আমার মা অনেক বেশি জ্ঞানী, ভদ্র আর বিচক্ষণ মানুষ । শুধুমাত্র টাকার গরমের কারণে তিনি সুযোগ পেলেই আমাদের অপমান করতে ছাড়তেন না । তবে বড় চাচা ছিলেন পুরো উল্টো । তিনি সত্যিই চেয়েছিলেন ভাইয়ের সংসারটাকে দাঁড় করিয়ে দিতে । সেখানে ওনারও কিছুটা স্বার্থ তো ছিলোই । ব্যবসা দিনদিন বাড়ছে, সামাল দেয়ার জন্য বিশ্বস্ত লোক দরকার ।

আব্বা শেষ পর্যন্ত মা'কে রাজি করিয়েই ফেললেন ঢাকা আসার জন্য । পোস্ট অফিসের চাকরীটা ছেড়ে দিয়ে আমাদের নিয়ে ঢাকা যাওয়ার মনঃস্থির করলেন । আমাদের যা কিছু ছিলো সংসারে, সবকিছু অন্য চাচা ফুপুদের মাঝে ভাগ করে দিয়ে যেদিন আমরা ঢাকা পৌঁছালাম তখন আব্বা মা'র সাথে আমরা তিন ভাইবোন, আমি, কুমকুম আর সৌরভ , তিন সুটকেস কাপড়চোপড় আর মা'র অল্প কিছু গয়না আর হ্যাঁ চোখ ভরা স্বপ্ন, বুক ভরা আশা

চাচী প্রথমে বুঝতে পারেননি আমরা যে একেবারে চলে এসেছি তাদের বাসায় । বাড়িতে তখন চাচাতো বোন মায়া আপার বিয়ের আয়োজন চলছে । সেই উপলক্ষ্যে বাড়ি ভরা আত্মীয়স্বজন ।

মায়া আপাকে দেখে আমি বরাবরই মুগ্ধ হয়ে যেতাম । আপাকে আমার কাছে মনে হতো মোমের পুতুল একটা । এতো সুন্দর কোনো মানুষ আমি এর আগে দেখিনি । আপা যখন কথা বলতো, আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম । মনে মনে ভেবে খুব অবাক হতাম যে এমন মায়ের এরকম নিরহংকারী আর বিনয়ী মেয়ে হলো কী করে ! তবে মৃদুল আমাদের সাথে কখনো কথা বলতো না । চাচীর নিষেধ ছিলো কি-না জানি না কারণ মৃদুল আমাদের কাছাকাছি আসলেই চাচী কঠিন ধমক দিয়ে ওকে সরিয়ে দিতেন ।

বিয়ের আয়োজন শেষে মায়া আপা শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে ঘর একসময় ফাঁকা হয়ে গেলো । আত্মীয়স্বজনরা সবাই বাড়ি ফিরে গেলেন । আরো দু'চারদিন অপেক্ষার পর চাচী মুখ ফুটে বলেই ফেললেন -

কী ব্যাপার নিলু, তোমার বাচ্চাদের স্কুল মিস হচ্ছে না? ঢাকায় এতোদিন পড়ে আছো যে?

আব্বা মা খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন । কী বলবেন এমন প্রশ্নের উত্তরে! চাচা উদ্ধার করলেন অবশেষে । একেবারে ঢাকা চলে আসার কথা শুনে চাচীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো । শুরু হয়ে গেলো চাচীর চিৎকার চেঁচামেচি । আব্বা, মা হতবিহ্বল হয়ে পড়লো চাচীর অবস্থা দেখে । বড় চাচা ভ্যাবাচেকা অবস্থায় পড়ে শুধু বললেন -

ফরিদা, সাতটা দিন সময় দাও , ওদের একটা ব্যবস্থা এর মধ্যে হবেই ।

কোনো ব্যবস্থা হবে না । বিয়েতে এসেছে, বিয়ে শেষ, এখন ফিরে যাবে ।

আমি তো একা সব সামলাতে পারছি না তাই জুয়েলকে বলেছি সবাইকে নিয়ে ঢাকা চলে আসতে । আমারও উপকার হলো । বাচ্চারাও ভালো স্কুল কলেজে পড়তে পারলো ।

মানে কী এসবের ! ওরা থাকবে কোথায়? তোমার কী মাথা খারাপ হলো নাকি?

না, না এখানে ওরা থাকবে না। তাই তো বললাম, সাতটা দিন…

চাচী দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন, সাত দিন মানে সাত দিন ।

আব্বা পড়লেন উভয়সংকটে । আমাদের সমস্ত কিছু বিলিয়ে দিয়ে এসেছি, ফিরে যাওয়ার উপায় নেই তারপরও মা'কে বললেন -

চলো নিলু ফিরে যাই । সব ঠিক হয়ে যাবে ।

মা সময়ে সময়ে অসম্ভব জেদি হয়ে উঠতেন । পুরো পরিস্থিতিটা মা মুখ বুঁজে সহ্য করলেন । আব্বাকে শুধু বললেন -

সাত দিন পর তুমি কোথায় নিয়ে যাবে জানি না তবে মনে রেখো সাতদিন পর একদিনও আমি এ বাড়িতে থাকবো না, তবে খুলনা আমি এখন আর ফিরছি না

ছয়দিনের মাথায় আমাদের ঠিকানা বদল হয়ে গেলো । মিরপুরে দাদার একটা বাড়ি ছিলো । ভাড়া দেয়া ছিলো বাড়িটা । দুই ধারে তিনটা করে ঘর আর মাঝখানে যাওয়া-আসার পথ । একপাশে ভাড়াটে আছে আরেক পাশ খালি পড়েছিলো । ওখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো । আমরা পাঁচজন মানুষ আর তিন সুটকেস কাপড়, এই নিয়ে শুরু হলো নতুন জীবন । খাট-পালং, হাঁড়ি-বাসন কিচ্ছু নেই ।

যেহেতু বছরের অর্ধেক শেষ তাই স্কুল-কলেজগুলো ভর্তি নিতে চাইছিলো না । বাড়ির পাশেই ছিলো গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ । মা যেয়ে হেড স্যারের সাথে কথা বললেন । সবকিছু শুনে স্যার আমাদের দু'বোনকে ভর্তি করে নিলেন । শুধু বাকী মাসের বেতন দিলেই হবে । এটা আমাদের জন্য অনেক বড় সাহায্য ছিলো তখন । সৌরভের তখনো স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি ।

বড় চাচার অনুরোধে আব্বা ওনার ফ্যাক্টরিতে বসতে শুরু করলেন । মা ভালোমন্দ কিছুই বললেন না শুধু আমরা চাচার বাসায় যাওয়া বন্ধ করে দিলাম আর ওনাদের তো আমাদের এখানে আসার প্রশ্নই ওঠে না । আব্বা একবার আসতে বলায় চাচী একদম মুখের ওপর বলে দিয়েছিলেন -

মিরপুরে কী মানুষ থাকে না-কি ? ব্যাস তারপর থেকে যাওয়া-আসা বন্ধ ।

খুলনায় থাকতে আমরা বেশ স্বচ্ছল ছিলাম কিন্তু ঢাকায় এসে মোটামুটি অথৈজলে পড়ে গেলাম । বাজেটে কাটছাঁট শুরু হয়ে গেলো । সকালে রুটি-আলু ভাজি, দুপুরে ডিম আলুর তরকারী আর শাক, রাতে যে-কোনো দু'টো ভর্তার সাথে ভাত । ত্রিশ দিন এক ম্যেনু । তবে মা'র হাতের জাদুকরী রান্নায় প্রতি বেলায় আমরা তৃপ্তি নিয়ে খাবার খেতাম ।

আব্বা ভোরে বের হয়ে যান, ফিরে আসেন রাত দশটায়, একেবারে সব কাজ গুছিয়ে অফিসে তালা ঝুলিয়ে তারপর ছুটি । প্রথম মাসের বেতন এনে যখন মা'র হাতে তুলে দিলেন, মা বললেন -

এরচেয়ে তোমার পোস্ট অফিসের বেতন বেশি ছিলো ।

এরমধ্যেই চালিয়ে নাও নিলু । আমি জানি, তুমি পারবে । আসলে বেতন সেকশনটা তো ভাবির হাতে, ভাবিই ঠিক করে দেয় কার কতো বেতন হবে ।

মা আর কোনো কথা বললেন না । টাকাটা নিয়ে আলমারিতে রেখে দিলেন।

মা নিজের মতো করে কিছু একটা করতে চাচ্ছিলেন কিন্তু নতুন জায়গা, অচেনা পরিবেশে ঠিক কী করা যায় বুঝে উঠতে পারছিলেন না । আমাদের সামনের ঘরের ভাড়াটে সালমা খালা । ওনার ঘরে সারাদিন মেশিন চলার আওয়াজ আসে । লোকজন কাপড় নিয়ে যাওয়া-আসা করে । মা একদিন খালার কাছে জানতে চাইলেন -

এগুলো কীসের কাজ সালমা?

আপা আমি বুটিক শপ থেকে অর্ডার আনি তারপর লোক দিয়ে কাজগুলো করাই । আপা আপনাকে বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু কী মনে করেন তাই আর বলতে পারিনি ।

কী কথা বলো না?

আপা আপনার হাতের কাজ আমি দেখেছি । এত্তো সুন্দর, সুক্ষ আর পেটানো কাজ আমি আগে দেখিনি । আপনি কাজ করলে কিন্তু খুব ভালো করতে পারবেন আপা ।

মা হেসে বললেন , আচ্ছা দিও, দেখি চেষ্টা করে কিছু পারি কি-না ।

এরপর মা আমাদের দুই বোনকে নিয়ে কাজ শুরু করলেন । বেবী ফ্রক আর পাঞ্জাবিতে যতো হাতের কাজ, আমরা তিনজন মিলে করতে লাগলাম । অল্প, অল্প করে পয়সা জমতে লাগলো টানাটানির সংসারে । আমাদের ত্রিশ দিনের ম্যেনুতে সামান্য ভালোবাসার ছোঁয়া লাগলো । সৌরভের আবদারের কারণে সপ্তাহে একদিন মাছ তো পরের সপ্তাহে মাংস উঠতো আমাদের পাতে ।

এরমধ্যে হুট করে সালমা খালার বিদেশ যাওয়ার একটা সুযোগ চলে এলো । সালমা খালা মা'কে নিয়ে যেয়ে বুটিকের ম্যানেজার আপার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন । খালার কাজগুলো এখন থেকে মা করবেন । মা'র হাতের কাজ উনি আগেই দেখেছিলেন তাই কাজ পেতে মা'র অসুবিধা হলো না ।

সালমা খালা তার মেশিন আর ঘরের সব জিনিসপত্র রেখে গেলেন । বললেন, আপা যখন টাকা হবে তখন দিয়েন । আজকে আমি এর কোনো দাম নেবো না । আমরা খুব অবাক হয়েছিলাম । আপন মানুষ দুর দুর করে ঠেলে দিয়েছে আর অচেনা একজন আমাদের জীবন পাল্টানোর গল্পটা নিজ হাতে শুরু করে দিয়ে গেলেন ।

ঈদে কাজ খুব বেড়ে গেলো । মা কিস্তিতে আরো তিনটা সেলাই মেশিন কিনে ফেললেন । দিনরাত কাজ চলছে বাসায় । আমরা দুই বোনও লেখাপড়ার বাইরে কাজ নিয়েই মেতে থাকি । একদিন সকালে বড় চাচী এসে হাজির । আমরা খুব বেশি অবাক হয়ে গেলাম । এখানে এসেছি প্রায় এক বছর । এর মধ্যে কারো যাওয়া-আসা নেই । হঠাৎ কী মনে করে আসলেন ঠিক বুঝতে পারলাম না কেউই । চাচী এসে ঘুরে ঘুরে সব দেখলেন । মা'কে বললেন -

ভালোই তো সাজিয়ে নিয়েছো বাড়িঘর । আমাকে বললেন -

এই মুনমুন, যা তো ড্রাইভারকে গিয়ে বল তোদের জিনিসগুলো নামিয়ে দিতে ।

আমি আর কুমকুম যেয়ে ব্যাগগুলো নিয়ে এসে চাচীর সামনে রাখলাম । ব্যাগগুলো তুলে নিয়ে মা'র দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন -

কিছু মনে কেরো না নিলু । নিজের লোকের অবস্থা খারাপ থাকলে তো বাইরে দান-খয়রাত করে লাভ নেই । না মানে তোমাদের জন্য ভালো জিনিসই কিনেছি । যাকাতের টাকা দেখে মনে করো না যে তোমাদেরও চাকর, দারোয়ানের মতো জিনিস দিয়েছি ।

রাগে আমার হাত-পা কাঁপছিলো । চাচীর মুখের ওপর কিছু শুনিয়ে দিতে চাচ্ছিলাম । মা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন তাই হাতের ইশারায় আমাকে ডেকে ভেতরে যেতে বললেন নাস্তা আনার জন্য । তারপর চাচীর দিকে ফিরে বললেন -

ভাবি আপনি যা এনেছেন সেটাই আমাদের ভাগ্য । একটা কথা জানেন তো, নিয়ত গুনে বরকত হয় ।

চাচী আর কোনো কথা বললেন না, কিছু মুখেও দিলেন না । যাওয়ার আগে মা'কে বলে গেলেন -

ভালোই তো আছো মনে হচ্ছে । মায়া'র আব্বা কেন যে নাকে কাঁদে ভাইয়ের জন্য বুঝি না ! গোডাউন থেকে মনেহয় জুয়েলের ভালোই হাত সাফাই হয় ।

মা কোনো উত্তর দিলেন না । আমরা মা'র ওপর রাগ করলে উল্টো আমাদের বললেন -

ধৈর্য ধরো । ধৈর্য খুব বড় গুণ । ওপরে একজন আছেন যিনি সবকিছু দেখেন । সময়ে সবকিছু ফিরিয়ে দেন তিনি । রাতে আব্বা ফিরলে চাচীর বলে যাওয়া কথা আর কাপড় দেখিয়ে মা বললেন -

আগামীকাল বড় ভাইয়ের কাছে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে চাকরী ছেড়ে চলে আসবে ।

মা'র কথায় এমন কিছু ছিলো যে আব্বা আর কথা বাড়ালেন না । পরদিন থেকে আর কাজে গেলেন না । এরপর বড় চাচার সাথে আমাদের যোগাযোগ একেবারেই বন্ধ হয়ে গেলো ।

মা'র সাথে আব্বা এসে ব্যবসার হাল ধরায় তরতরিয়ে ব্যবসা বাড়তে লাগলো । কঠোর পরিশ্রম আর সততার পাশাপাশি ভাগ্যও বোধহয় সহায় ছিলো আমাদের । পাঁচ বছরের মাথায় সত্যিই আমরা ঘুরে দাঁড়ালাম । তবে আমাদের জীবনযাপনে খুব একটা হেরফের হলো না । মা কোনো একটা প্ল্যান মাথায় নিয়ে টাকা জমাচ্ছিলেন আর আব্বাসহ আমাদের সবার ভরসা ছিলো মা'র ওপর । একসময় বুটিক পড়ায় আমাদের নিজেদেরও একটা দোকান হলো আর বাড়ির পাশে দরদাম করে মা ছোট্ট এক টুকরো জায়গাও কিনে ফেললেন । আমাদের স্বপ্নগুলো ধীরে ধীরে আকার পাচ্ছিলো । নানাবাড়ির সম্পত্তি বিক্রি থেকে মা'র ভাগে কিছু টাকা এলো । এছাড়া জমানো টাকা আর ব্যাংক লোন নিয়ে ছিমছাম দোতলা একটা বাড়িও দাঁড়িয়ে গেলো ।

মাঝে মাঝে বড় চাচার খবর পাই । চাচা মাঝে কিছুদিন কঠিন অসুখে পড়েছিলেন । তখন চাচীর ভাইদের হাতে ব্যবসার দায়িত্ব যায় । ওনারা নিজেদের মতো করে সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে চাচার ব্যবসায় লাল-নীল বাত্তি জ্বালিয়ে দিয়েছেন । আব্বা মাঝে মাঝে যেয়ে চাচাকে দেখে আসতেন কিন্তু মা'র কঠিন নিষেধ ছিলো, ব্যবসায়িক বা অন্য কোনো বিষয়ে যেন আব্বা কোনো কথা না বলেন । আব্বা একদিন বাসায় এসে বললেন -

ভাবী মিরপুরের বাসায় চলে আসতে চাচ্ছেন । ধানমন্ডিতে এতো টাকা বাড়িভাড়া দিয়ে কুলাতে পারছেন না ।

আমরা তখন মাত্র নতুন বাসায় উঠেছি । পুরোনো বাড়িতে একপাশে কারখানা, আরেক পাশ খালি ছিলো । মা বললেন -

বাড়ি যেহেতু আব্বার নামে, একপাশে তো ওনারা থাকতেই পারেন । আরেক দিকে আমার কারখানা থাকবে ।

নিলু ওমন জায়গায় ভাবী কী করে থাকবে বলো তো? বলছিলাম যে আমাদের নিচতলা তো খালি আছে , ভাবীও তাই বলছিলেন….

মা এমন একটা চাহুনি দিলেন যে আমরা সবাই চুপ হয়ে গেলাম । তবে পরের ঘটনার জন্য আমরা একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না । একদিন বাদেই সক্কাল সক্কাল ট্রাক ভরা মালামাল নিয়ে বড় চাচার ফ্যামিলি হাজির । মা তখন সৌরভকে নিয়ে কাজের পেমেন্ট আনতে গেছেন আসাদগেটে আর আব্বা ইসলামপুরে কাপড় আনতে গেছেন । বাড়িতে আমরা দুই বোন । কী করবো বুঝতে পারছি না । নীচতলা তো খালিই ছিলো । লেবাররা সব মালপত্র ভেতরে রেখে চলে গেলো । বড় চাচী ওপরে এসে দুপুরে রান্নায় কী খাবেন তার ফর্দ ফাতেমার কাছে দিয়ে দিলেন ।

ঘন্টাখানেক পর মা ফিরে এসে কান্ড দেখে কিছুই বললেন না । যেন কিছুই হয়নি । বড় চাচী ছুটে এসে মা'কে জড়িয়ে ধরে বললেন -

ইশ, কত্তোদিন তোমাদের দেখি না নিলু ! তোমাদের সাথে থাকতেই চলে এলাম ।

খাওয়াদাওয়া করেন ভাবী, পরে কথা বলছি । মা'র আওয়াজে এমন কিছু ছিলো, চাচী আর কিছু বললেন না ।

বিকেলে ফাতেমা সবাইকে চা-নাস্তা দিয়ে গেলে মা কথা শুরু করলেন -

ভাবী এবার বলেন কী বলবেন ।

আরে বলবো আবার কী? আমি তো আমার ছোট বোনের সাথে থাকতে চলে এলাম ।

বাড়ি তো খালি ছিলো । আমি মুনমুনের আব্বাকে বলেছি তো যে আপনারা ওখানে উঠতে পারেন ইচ্ছে হলে ।

তাই কী হয় বলো? এতো পুরোনো, ড্যাম্প ধরা বাড়িতে থাকা যায়? একতলাটা তো খালিই আছে । তোমাদের তো আর লাগছে না । আর ভাইয়ের বাড়িতে ভাই তো থাকতে পারে ।

ভাবী আমি আসলে বেশি কথা বলতে চাচ্ছি না । আব্বার বাড়িতে আপনারা থাকবেন, তাতে আমার বলার কিছু নেই । বাড়ি তো পুরোনোই । অসুবিধে নেই, আপনারা সাতদিন এখানে থাকেন, এরমধ্যে বাড়িঘর রঙ করিয়ে দিচ্ছি । তারপর উঠে যাবেন ঐ বাড়িতে ।

তুমি এমন করছো কেন নিলু? তোমার বিপদে আমি সাহায্য করিনি ।

মনে আছে ভাবী, কিছুই ভুলিনি আমি । তবে জানেন কী, আপনি আরাম আয়েশে থেকে অভ্যস্ত তাই এখানে আপনার অসুবিধা হতে পারে । মিরপুরে আপনি কী করে থাকবেন?

কিচ্ছু হবে না । দুই বোন মিলেমিশে থাকবো আর আমার বাপের বাড়ি তো মিরপুরেই ।

জানি আপনার বাপের বাড়ি মিরপুরে, মিরপুর থেকেই আপনি ধানমন্ডি গেছেন । যাকগে, ভাবী ঢাকায় এসেছিলাম বড় ভাইয়ের কারণে । মুনমুনের আব্বা কোনোদিন কারো সাথে-পাছে থাকেনি, নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ । বড় ভাইয়ের ওপর ওনার অগাধ বিশ্বাস ছিলো আর সেই বিশ্বাস আমার সংসারটাকে পথে বসিয়ে দিয়েছিলো প্রায় । সালমা না থাকলে কী হতো জানি না । একদম শেষ থেকে আবার শুরু করতে হয়েছে আমাদের । সংসারটাকে একটু একটু করে গুছিয়ে এনেছি সবাই মিলে । এখানে আমি নতুন করে কোনো জটিলতা, কোনো ঝামেলা ঢুকতেই দেবো না । সবার দিন আসে, সবাইকেই হয়তো আবার শেষ থেকে শুরু করতে হয় । সাতদিন বেড়ান, তারপর নিজের বাড়িতে উঠে যাবেন । মা'র কথা শুনে কেউ কোনো কথা বলে না আর । মা উঠে নিজের ঘরে চলে গেলেন ।

রাতে আমরা সবাই মিলে যেয়ে মা'কে ধরলাম -

মা তুমিই তো আমাদের শিখিয়েছো, মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়াতে আর এ তো আমাদের আপন চাচার বিপদ । চাচা অসুস্থ, তুমি এমন কোরো না মা । ওরা থাকুক না নিচের তলায় ।

শোন জীবনে মাঝে মাঝে কঠিন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়, নিজেদের ভালো থাকার জন্যই । বড় ভাবীর মতো মানুষরা কোনোদিন পাল্টায় না । তোর আব্বা আমার ওপর রাগ করলেও আমি সিদ্ধান্ত পাল্টাবো না । বড় ভাই অসুস্থ, ওনাকে সাধ্যমতো করার চেষ্টা করবো কিন্তু এ বাড়িতে না । ওনাকে ঐ বাড়িতে যেতেই হবে । যারা মানুষকে মানুষ মনে করে না, জীবন তাদেরকে কখনো কখনো সময়ের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় । নাহলে এরা কখনো শুধরোবে না । সুযোগ পেলেই নিজের চেহারা দেখিয়ে দেবে । এই সুযোগ ওনাকে দেয়া যাবে না । উনিও একটু বুঝুক, শেষ থেকে শুরু করতে কেমন লাগে ।

(সমাপ্ত)
 

Users who are viewing this thread

Back
Top