বড় চাচার জোরাজুরিতে ঢাকা আসার পর আমরা ধানমন্ডিতে বড় চাচার বাসায় উঠেছিলাম । ঢাকায় না আসলেও আমাদের চলতো । খুলনায় আমরা ভালোই ছিলাম । চাচার ব্যাবসা তখন বাড়বাড়ন্ত । চাচা আব্বাকে বলেছিলেন -
তোরা চলে আয়, সাথে করে কিচ্ছু আনতে হবে না । সবকিছু নতুন করে শুরু করবি । আমি সব ব্যবস্থা করে দেবো । তুই শুধু ঢাকায় আয় ।
মা কিন্তু চাচার কথায় একদম ভরসা পায়নি কারণ বড় চাচী আমাদের পছন্দ করতেন না । এই পর্যন্ত যতোবারই ওনার সাথে আমাদের দেখা হয়েছে ততবারই আমার মনে হয়েছে আমরা যেন ফকির মিসকিন টাইপ কোনো কিছু । অথচ আমি যখন মা'র সাথে বড় চাচীকে মেলাতাম, আমার কাছে মনে হতো বড় চাচীর তুলনায় কম শিক্ষিত আমার মা অনেক বেশি জ্ঞানী, ভদ্র আর বিচক্ষণ মানুষ । শুধুমাত্র টাকার গরমের কারণে তিনি সুযোগ পেলেই আমাদের অপমান করতে ছাড়তেন না । তবে বড় চাচা ছিলেন পুরো উল্টো । তিনি সত্যিই চেয়েছিলেন ভাইয়ের সংসারটাকে দাঁড় করিয়ে দিতে । সেখানে ওনারও কিছুটা স্বার্থ তো ছিলোই । ব্যবসা দিনদিন বাড়ছে, সামাল দেয়ার জন্য বিশ্বস্ত লোক দরকার ।
আব্বা শেষ পর্যন্ত মা'কে রাজি করিয়েই ফেললেন ঢাকা আসার জন্য । পোস্ট অফিসের চাকরীটা ছেড়ে দিয়ে আমাদের নিয়ে ঢাকা যাওয়ার মনঃস্থির করলেন । আমাদের যা কিছু ছিলো সংসারে, সবকিছু অন্য চাচা ফুপুদের মাঝে ভাগ করে দিয়ে যেদিন আমরা ঢাকা পৌঁছালাম তখন আব্বা মা'র সাথে আমরা তিন ভাইবোন, আমি, কুমকুম আর সৌরভ , তিন সুটকেস কাপড়চোপড় আর মা'র অল্প কিছু গয়না আর হ্যাঁ চোখ ভরা স্বপ্ন, বুক ভরা আশা
চাচী প্রথমে বুঝতে পারেননি আমরা যে একেবারে চলে এসেছি তাদের বাসায় । বাড়িতে তখন চাচাতো বোন মায়া আপার বিয়ের আয়োজন চলছে । সেই উপলক্ষ্যে বাড়ি ভরা আত্মীয়স্বজন ।
মায়া আপাকে দেখে আমি বরাবরই মুগ্ধ হয়ে যেতাম । আপাকে আমার কাছে মনে হতো মোমের পুতুল একটা । এতো সুন্দর কোনো মানুষ আমি এর আগে দেখিনি । আপা যখন কথা বলতো, আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম । মনে মনে ভেবে খুব অবাক হতাম যে এমন মায়ের এরকম নিরহংকারী আর বিনয়ী মেয়ে হলো কী করে ! তবে মৃদুল আমাদের সাথে কখনো কথা বলতো না । চাচীর নিষেধ ছিলো কি-না জানি না কারণ মৃদুল আমাদের কাছাকাছি আসলেই চাচী কঠিন ধমক দিয়ে ওকে সরিয়ে দিতেন ।
বিয়ের আয়োজন শেষে মায়া আপা শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে ঘর একসময় ফাঁকা হয়ে গেলো । আত্মীয়স্বজনরা সবাই বাড়ি ফিরে গেলেন । আরো দু'চারদিন অপেক্ষার পর চাচী মুখ ফুটে বলেই ফেললেন -
কী ব্যাপার নিলু, তোমার বাচ্চাদের স্কুল মিস হচ্ছে না? ঢাকায় এতোদিন পড়ে আছো যে?
আব্বা মা খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন । কী বলবেন এমন প্রশ্নের উত্তরে! চাচা উদ্ধার করলেন অবশেষে । একেবারে ঢাকা চলে আসার কথা শুনে চাচীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো । শুরু হয়ে গেলো চাচীর চিৎকার চেঁচামেচি । আব্বা, মা হতবিহ্বল হয়ে পড়লো চাচীর অবস্থা দেখে । বড় চাচা ভ্যাবাচেকা অবস্থায় পড়ে শুধু বললেন -
ফরিদা, সাতটা দিন সময় দাও , ওদের একটা ব্যবস্থা এর মধ্যে হবেই ।
কোনো ব্যবস্থা হবে না । বিয়েতে এসেছে, বিয়ে শেষ, এখন ফিরে যাবে ।
আমি তো একা সব সামলাতে পারছি না তাই জুয়েলকে বলেছি সবাইকে নিয়ে ঢাকা চলে আসতে । আমারও উপকার হলো । বাচ্চারাও ভালো স্কুল কলেজে পড়তে পারলো ।
মানে কী এসবের ! ওরা থাকবে কোথায়? তোমার কী মাথা খারাপ হলো নাকি?
না, না এখানে ওরা থাকবে না। তাই তো বললাম, সাতটা দিন…
চাচী দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন, সাত দিন মানে সাত দিন ।
আব্বা পড়লেন উভয়সংকটে । আমাদের সমস্ত কিছু বিলিয়ে দিয়ে এসেছি, ফিরে যাওয়ার উপায় নেই তারপরও মা'কে বললেন -
চলো নিলু ফিরে যাই । সব ঠিক হয়ে যাবে ।
মা সময়ে সময়ে অসম্ভব জেদি হয়ে উঠতেন । পুরো পরিস্থিতিটা মা মুখ বুঁজে সহ্য করলেন । আব্বাকে শুধু বললেন -
সাত দিন পর তুমি কোথায় নিয়ে যাবে জানি না তবে মনে রেখো সাতদিন পর একদিনও আমি এ বাড়িতে থাকবো না, তবে খুলনা আমি এখন আর ফিরছি না
ছয়দিনের মাথায় আমাদের ঠিকানা বদল হয়ে গেলো । মিরপুরে দাদার একটা বাড়ি ছিলো । ভাড়া দেয়া ছিলো বাড়িটা । দুই ধারে তিনটা করে ঘর আর মাঝখানে যাওয়া-আসার পথ । একপাশে ভাড়াটে আছে আরেক পাশ খালি পড়েছিলো । ওখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো । আমরা পাঁচজন মানুষ আর তিন সুটকেস কাপড়, এই নিয়ে শুরু হলো নতুন জীবন । খাট-পালং, হাঁড়ি-বাসন কিচ্ছু নেই ।
যেহেতু বছরের অর্ধেক শেষ তাই স্কুল-কলেজগুলো ভর্তি নিতে চাইছিলো না । বাড়ির পাশেই ছিলো গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ । মা যেয়ে হেড স্যারের সাথে কথা বললেন । সবকিছু শুনে স্যার আমাদের দু'বোনকে ভর্তি করে নিলেন । শুধু বাকী মাসের বেতন দিলেই হবে । এটা আমাদের জন্য অনেক বড় সাহায্য ছিলো তখন । সৌরভের তখনো স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি ।
বড় চাচার অনুরোধে আব্বা ওনার ফ্যাক্টরিতে বসতে শুরু করলেন । মা ভালোমন্দ কিছুই বললেন না শুধু আমরা চাচার বাসায় যাওয়া বন্ধ করে দিলাম আর ওনাদের তো আমাদের এখানে আসার প্রশ্নই ওঠে না । আব্বা একবার আসতে বলায় চাচী একদম মুখের ওপর বলে দিয়েছিলেন -
মিরপুরে কী মানুষ থাকে না-কি ? ব্যাস তারপর থেকে যাওয়া-আসা বন্ধ ।
খুলনায় থাকতে আমরা বেশ স্বচ্ছল ছিলাম কিন্তু ঢাকায় এসে মোটামুটি অথৈজলে পড়ে গেলাম । বাজেটে কাটছাঁট শুরু হয়ে গেলো । সকালে রুটি-আলু ভাজি, দুপুরে ডিম আলুর তরকারী আর শাক, রাতে যে-কোনো দু'টো ভর্তার সাথে ভাত । ত্রিশ দিন এক ম্যেনু । তবে মা'র হাতের জাদুকরী রান্নায় প্রতি বেলায় আমরা তৃপ্তি নিয়ে খাবার খেতাম ।
আব্বা ভোরে বের হয়ে যান, ফিরে আসেন রাত দশটায়, একেবারে সব কাজ গুছিয়ে অফিসে তালা ঝুলিয়ে তারপর ছুটি । প্রথম মাসের বেতন এনে যখন মা'র হাতে তুলে দিলেন, মা বললেন -
এরচেয়ে তোমার পোস্ট অফিসের বেতন বেশি ছিলো ।
এরমধ্যেই চালিয়ে নাও নিলু । আমি জানি, তুমি পারবে । আসলে বেতন সেকশনটা তো ভাবির হাতে, ভাবিই ঠিক করে দেয় কার কতো বেতন হবে ।
মা আর কোনো কথা বললেন না । টাকাটা নিয়ে আলমারিতে রেখে দিলেন।
মা নিজের মতো করে কিছু একটা করতে চাচ্ছিলেন কিন্তু নতুন জায়গা, অচেনা পরিবেশে ঠিক কী করা যায় বুঝে উঠতে পারছিলেন না । আমাদের সামনের ঘরের ভাড়াটে সালমা খালা । ওনার ঘরে সারাদিন মেশিন চলার আওয়াজ আসে । লোকজন কাপড় নিয়ে যাওয়া-আসা করে । মা একদিন খালার কাছে জানতে চাইলেন -
এগুলো কীসের কাজ সালমা?
আপা আমি বুটিক শপ থেকে অর্ডার আনি তারপর লোক দিয়ে কাজগুলো করাই । আপা আপনাকে বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু কী মনে করেন তাই আর বলতে পারিনি ।
কী কথা বলো না?
আপা আপনার হাতের কাজ আমি দেখেছি । এত্তো সুন্দর, সুক্ষ আর পেটানো কাজ আমি আগে দেখিনি । আপনি কাজ করলে কিন্তু খুব ভালো করতে পারবেন আপা ।
মা হেসে বললেন , আচ্ছা দিও, দেখি চেষ্টা করে কিছু পারি কি-না ।
এরপর মা আমাদের দুই বোনকে নিয়ে কাজ শুরু করলেন । বেবী ফ্রক আর পাঞ্জাবিতে যতো হাতের কাজ, আমরা তিনজন মিলে করতে লাগলাম । অল্প, অল্প করে পয়সা জমতে লাগলো টানাটানির সংসারে । আমাদের ত্রিশ দিনের ম্যেনুতে সামান্য ভালোবাসার ছোঁয়া লাগলো । সৌরভের আবদারের কারণে সপ্তাহে একদিন মাছ তো পরের সপ্তাহে মাংস উঠতো আমাদের পাতে ।
এরমধ্যে হুট করে সালমা খালার বিদেশ যাওয়ার একটা সুযোগ চলে এলো । সালমা খালা মা'কে নিয়ে যেয়ে বুটিকের ম্যানেজার আপার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন । খালার কাজগুলো এখন থেকে মা করবেন । মা'র হাতের কাজ উনি আগেই দেখেছিলেন তাই কাজ পেতে মা'র অসুবিধা হলো না ।
সালমা খালা তার মেশিন আর ঘরের সব জিনিসপত্র রেখে গেলেন । বললেন, আপা যখন টাকা হবে তখন দিয়েন । আজকে আমি এর কোনো দাম নেবো না । আমরা খুব অবাক হয়েছিলাম । আপন মানুষ দুর দুর করে ঠেলে দিয়েছে আর অচেনা একজন আমাদের জীবন পাল্টানোর গল্পটা নিজ হাতে শুরু করে দিয়ে গেলেন ।
ঈদে কাজ খুব বেড়ে গেলো । মা কিস্তিতে আরো তিনটা সেলাই মেশিন কিনে ফেললেন । দিনরাত কাজ চলছে বাসায় । আমরা দুই বোনও লেখাপড়ার বাইরে কাজ নিয়েই মেতে থাকি । একদিন সকালে বড় চাচী এসে হাজির । আমরা খুব বেশি অবাক হয়ে গেলাম । এখানে এসেছি প্রায় এক বছর । এর মধ্যে কারো যাওয়া-আসা নেই । হঠাৎ কী মনে করে আসলেন ঠিক বুঝতে পারলাম না কেউই । চাচী এসে ঘুরে ঘুরে সব দেখলেন । মা'কে বললেন -
ভালোই তো সাজিয়ে নিয়েছো বাড়িঘর । আমাকে বললেন -
এই মুনমুন, যা তো ড্রাইভারকে গিয়ে বল তোদের জিনিসগুলো নামিয়ে দিতে ।
আমি আর কুমকুম যেয়ে ব্যাগগুলো নিয়ে এসে চাচীর সামনে রাখলাম । ব্যাগগুলো তুলে নিয়ে মা'র দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন -
কিছু মনে কেরো না নিলু । নিজের লোকের অবস্থা খারাপ থাকলে তো বাইরে দান-খয়রাত করে লাভ নেই । না মানে তোমাদের জন্য ভালো জিনিসই কিনেছি । যাকাতের টাকা দেখে মনে করো না যে তোমাদেরও চাকর, দারোয়ানের মতো জিনিস দিয়েছি ।
রাগে আমার হাত-পা কাঁপছিলো । চাচীর মুখের ওপর কিছু শুনিয়ে দিতে চাচ্ছিলাম । মা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন তাই হাতের ইশারায় আমাকে ডেকে ভেতরে যেতে বললেন নাস্তা আনার জন্য । তারপর চাচীর দিকে ফিরে বললেন -
ভাবি আপনি যা এনেছেন সেটাই আমাদের ভাগ্য । একটা কথা জানেন তো, নিয়ত গুনে বরকত হয় ।
চাচী আর কোনো কথা বললেন না, কিছু মুখেও দিলেন না । যাওয়ার আগে মা'কে বলে গেলেন -
ভালোই তো আছো মনে হচ্ছে । মায়া'র আব্বা কেন যে নাকে কাঁদে ভাইয়ের জন্য বুঝি না ! গোডাউন থেকে মনেহয় জুয়েলের ভালোই হাত সাফাই হয় ।
মা কোনো উত্তর দিলেন না । আমরা মা'র ওপর রাগ করলে উল্টো আমাদের বললেন -
ধৈর্য ধরো । ধৈর্য খুব বড় গুণ । ওপরে একজন আছেন যিনি সবকিছু দেখেন । সময়ে সবকিছু ফিরিয়ে দেন তিনি । রাতে আব্বা ফিরলে চাচীর বলে যাওয়া কথা আর কাপড় দেখিয়ে মা বললেন -
আগামীকাল বড় ভাইয়ের কাছে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে চাকরী ছেড়ে চলে আসবে ।
মা'র কথায় এমন কিছু ছিলো যে আব্বা আর কথা বাড়ালেন না । পরদিন থেকে আর কাজে গেলেন না । এরপর বড় চাচার সাথে আমাদের যোগাযোগ একেবারেই বন্ধ হয়ে গেলো ।
মা'র সাথে আব্বা এসে ব্যবসার হাল ধরায় তরতরিয়ে ব্যবসা বাড়তে লাগলো । কঠোর পরিশ্রম আর সততার পাশাপাশি ভাগ্যও বোধহয় সহায় ছিলো আমাদের । পাঁচ বছরের মাথায় সত্যিই আমরা ঘুরে দাঁড়ালাম । তবে আমাদের জীবনযাপনে খুব একটা হেরফের হলো না । মা কোনো একটা প্ল্যান মাথায় নিয়ে টাকা জমাচ্ছিলেন আর আব্বাসহ আমাদের সবার ভরসা ছিলো মা'র ওপর । একসময় বুটিক পড়ায় আমাদের নিজেদেরও একটা দোকান হলো আর বাড়ির পাশে দরদাম করে মা ছোট্ট এক টুকরো জায়গাও কিনে ফেললেন । আমাদের স্বপ্নগুলো ধীরে ধীরে আকার পাচ্ছিলো । নানাবাড়ির সম্পত্তি বিক্রি থেকে মা'র ভাগে কিছু টাকা এলো । এছাড়া জমানো টাকা আর ব্যাংক লোন নিয়ে ছিমছাম দোতলা একটা বাড়িও দাঁড়িয়ে গেলো ।
মাঝে মাঝে বড় চাচার খবর পাই । চাচা মাঝে কিছুদিন কঠিন অসুখে পড়েছিলেন । তখন চাচীর ভাইদের হাতে ব্যবসার দায়িত্ব যায় । ওনারা নিজেদের মতো করে সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে চাচার ব্যবসায় লাল-নীল বাত্তি জ্বালিয়ে দিয়েছেন । আব্বা মাঝে মাঝে যেয়ে চাচাকে দেখে আসতেন কিন্তু মা'র কঠিন নিষেধ ছিলো, ব্যবসায়িক বা অন্য কোনো বিষয়ে যেন আব্বা কোনো কথা না বলেন । আব্বা একদিন বাসায় এসে বললেন -
ভাবী মিরপুরের বাসায় চলে আসতে চাচ্ছেন । ধানমন্ডিতে এতো টাকা বাড়িভাড়া দিয়ে কুলাতে পারছেন না ।
আমরা তখন মাত্র নতুন বাসায় উঠেছি । পুরোনো বাড়িতে একপাশে কারখানা, আরেক পাশ খালি ছিলো । মা বললেন -
বাড়ি যেহেতু আব্বার নামে, একপাশে তো ওনারা থাকতেই পারেন । আরেক দিকে আমার কারখানা থাকবে ।
নিলু ওমন জায়গায় ভাবী কী করে থাকবে বলো তো? বলছিলাম যে আমাদের নিচতলা তো খালি আছে , ভাবীও তাই বলছিলেন….
মা এমন একটা চাহুনি দিলেন যে আমরা সবাই চুপ হয়ে গেলাম । তবে পরের ঘটনার জন্য আমরা একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না । একদিন বাদেই সক্কাল সক্কাল ট্রাক ভরা মালামাল নিয়ে বড় চাচার ফ্যামিলি হাজির । মা তখন সৌরভকে নিয়ে কাজের পেমেন্ট আনতে গেছেন আসাদগেটে আর আব্বা ইসলামপুরে কাপড় আনতে গেছেন । বাড়িতে আমরা দুই বোন । কী করবো বুঝতে পারছি না । নীচতলা তো খালিই ছিলো । লেবাররা সব মালপত্র ভেতরে রেখে চলে গেলো । বড় চাচী ওপরে এসে দুপুরে রান্নায় কী খাবেন তার ফর্দ ফাতেমার কাছে দিয়ে দিলেন ।
ঘন্টাখানেক পর মা ফিরে এসে কান্ড দেখে কিছুই বললেন না । যেন কিছুই হয়নি । বড় চাচী ছুটে এসে মা'কে জড়িয়ে ধরে বললেন -
ইশ, কত্তোদিন তোমাদের দেখি না নিলু ! তোমাদের সাথে থাকতেই চলে এলাম ।
খাওয়াদাওয়া করেন ভাবী, পরে কথা বলছি । মা'র আওয়াজে এমন কিছু ছিলো, চাচী আর কিছু বললেন না ।
বিকেলে ফাতেমা সবাইকে চা-নাস্তা দিয়ে গেলে মা কথা শুরু করলেন -
ভাবী এবার বলেন কী বলবেন ।
আরে বলবো আবার কী? আমি তো আমার ছোট বোনের সাথে থাকতে চলে এলাম ।
বাড়ি তো খালি ছিলো । আমি মুনমুনের আব্বাকে বলেছি তো যে আপনারা ওখানে উঠতে পারেন ইচ্ছে হলে ।
তাই কী হয় বলো? এতো পুরোনো, ড্যাম্প ধরা বাড়িতে থাকা যায়? একতলাটা তো খালিই আছে । তোমাদের তো আর লাগছে না । আর ভাইয়ের বাড়িতে ভাই তো থাকতে পারে ।
ভাবী আমি আসলে বেশি কথা বলতে চাচ্ছি না । আব্বার বাড়িতে আপনারা থাকবেন, তাতে আমার বলার কিছু নেই । বাড়ি তো পুরোনোই । অসুবিধে নেই, আপনারা সাতদিন এখানে থাকেন, এরমধ্যে বাড়িঘর রঙ করিয়ে দিচ্ছি । তারপর উঠে যাবেন ঐ বাড়িতে ।
তুমি এমন করছো কেন নিলু? তোমার বিপদে আমি সাহায্য করিনি ।
মনে আছে ভাবী, কিছুই ভুলিনি আমি । তবে জানেন কী, আপনি আরাম আয়েশে থেকে অভ্যস্ত তাই এখানে আপনার অসুবিধা হতে পারে । মিরপুরে আপনি কী করে থাকবেন?
কিচ্ছু হবে না । দুই বোন মিলেমিশে থাকবো আর আমার বাপের বাড়ি তো মিরপুরেই ।
জানি আপনার বাপের বাড়ি মিরপুরে, মিরপুর থেকেই আপনি ধানমন্ডি গেছেন । যাকগে, ভাবী ঢাকায় এসেছিলাম বড় ভাইয়ের কারণে । মুনমুনের আব্বা কোনোদিন কারো সাথে-পাছে থাকেনি, নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ । বড় ভাইয়ের ওপর ওনার অগাধ বিশ্বাস ছিলো আর সেই বিশ্বাস আমার সংসারটাকে পথে বসিয়ে দিয়েছিলো প্রায় । সালমা না থাকলে কী হতো জানি না । একদম শেষ থেকে আবার শুরু করতে হয়েছে আমাদের । সংসারটাকে একটু একটু করে গুছিয়ে এনেছি সবাই মিলে । এখানে আমি নতুন করে কোনো জটিলতা, কোনো ঝামেলা ঢুকতেই দেবো না । সবার দিন আসে, সবাইকেই হয়তো আবার শেষ থেকে শুরু করতে হয় । সাতদিন বেড়ান, তারপর নিজের বাড়িতে উঠে যাবেন । মা'র কথা শুনে কেউ কোনো কথা বলে না আর । মা উঠে নিজের ঘরে চলে গেলেন ।
রাতে আমরা সবাই মিলে যেয়ে মা'কে ধরলাম -
মা তুমিই তো আমাদের শিখিয়েছো, মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়াতে আর এ তো আমাদের আপন চাচার বিপদ । চাচা অসুস্থ, তুমি এমন কোরো না মা । ওরা থাকুক না নিচের তলায় ।
শোন জীবনে মাঝে মাঝে কঠিন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়, নিজেদের ভালো থাকার জন্যই । বড় ভাবীর মতো মানুষরা কোনোদিন পাল্টায় না । তোর আব্বা আমার ওপর রাগ করলেও আমি সিদ্ধান্ত পাল্টাবো না । বড় ভাই অসুস্থ, ওনাকে সাধ্যমতো করার চেষ্টা করবো কিন্তু এ বাড়িতে না । ওনাকে ঐ বাড়িতে যেতেই হবে । যারা মানুষকে মানুষ মনে করে না, জীবন তাদেরকে কখনো কখনো সময়ের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় । নাহলে এরা কখনো শুধরোবে না । সুযোগ পেলেই নিজের চেহারা দেখিয়ে দেবে । এই সুযোগ ওনাকে দেয়া যাবে না । উনিও একটু বুঝুক, শেষ থেকে শুরু করতে কেমন লাগে ।
(সমাপ্ত)
তোরা চলে আয়, সাথে করে কিচ্ছু আনতে হবে না । সবকিছু নতুন করে শুরু করবি । আমি সব ব্যবস্থা করে দেবো । তুই শুধু ঢাকায় আয় ।
মা কিন্তু চাচার কথায় একদম ভরসা পায়নি কারণ বড় চাচী আমাদের পছন্দ করতেন না । এই পর্যন্ত যতোবারই ওনার সাথে আমাদের দেখা হয়েছে ততবারই আমার মনে হয়েছে আমরা যেন ফকির মিসকিন টাইপ কোনো কিছু । অথচ আমি যখন মা'র সাথে বড় চাচীকে মেলাতাম, আমার কাছে মনে হতো বড় চাচীর তুলনায় কম শিক্ষিত আমার মা অনেক বেশি জ্ঞানী, ভদ্র আর বিচক্ষণ মানুষ । শুধুমাত্র টাকার গরমের কারণে তিনি সুযোগ পেলেই আমাদের অপমান করতে ছাড়তেন না । তবে বড় চাচা ছিলেন পুরো উল্টো । তিনি সত্যিই চেয়েছিলেন ভাইয়ের সংসারটাকে দাঁড় করিয়ে দিতে । সেখানে ওনারও কিছুটা স্বার্থ তো ছিলোই । ব্যবসা দিনদিন বাড়ছে, সামাল দেয়ার জন্য বিশ্বস্ত লোক দরকার ।
আব্বা শেষ পর্যন্ত মা'কে রাজি করিয়েই ফেললেন ঢাকা আসার জন্য । পোস্ট অফিসের চাকরীটা ছেড়ে দিয়ে আমাদের নিয়ে ঢাকা যাওয়ার মনঃস্থির করলেন । আমাদের যা কিছু ছিলো সংসারে, সবকিছু অন্য চাচা ফুপুদের মাঝে ভাগ করে দিয়ে যেদিন আমরা ঢাকা পৌঁছালাম তখন আব্বা মা'র সাথে আমরা তিন ভাইবোন, আমি, কুমকুম আর সৌরভ , তিন সুটকেস কাপড়চোপড় আর মা'র অল্প কিছু গয়না আর হ্যাঁ চোখ ভরা স্বপ্ন, বুক ভরা আশা
চাচী প্রথমে বুঝতে পারেননি আমরা যে একেবারে চলে এসেছি তাদের বাসায় । বাড়িতে তখন চাচাতো বোন মায়া আপার বিয়ের আয়োজন চলছে । সেই উপলক্ষ্যে বাড়ি ভরা আত্মীয়স্বজন ।
মায়া আপাকে দেখে আমি বরাবরই মুগ্ধ হয়ে যেতাম । আপাকে আমার কাছে মনে হতো মোমের পুতুল একটা । এতো সুন্দর কোনো মানুষ আমি এর আগে দেখিনি । আপা যখন কথা বলতো, আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম । মনে মনে ভেবে খুব অবাক হতাম যে এমন মায়ের এরকম নিরহংকারী আর বিনয়ী মেয়ে হলো কী করে ! তবে মৃদুল আমাদের সাথে কখনো কথা বলতো না । চাচীর নিষেধ ছিলো কি-না জানি না কারণ মৃদুল আমাদের কাছাকাছি আসলেই চাচী কঠিন ধমক দিয়ে ওকে সরিয়ে দিতেন ।
বিয়ের আয়োজন শেষে মায়া আপা শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে ঘর একসময় ফাঁকা হয়ে গেলো । আত্মীয়স্বজনরা সবাই বাড়ি ফিরে গেলেন । আরো দু'চারদিন অপেক্ষার পর চাচী মুখ ফুটে বলেই ফেললেন -
কী ব্যাপার নিলু, তোমার বাচ্চাদের স্কুল মিস হচ্ছে না? ঢাকায় এতোদিন পড়ে আছো যে?
আব্বা মা খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন । কী বলবেন এমন প্রশ্নের উত্তরে! চাচা উদ্ধার করলেন অবশেষে । একেবারে ঢাকা চলে আসার কথা শুনে চাচীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো । শুরু হয়ে গেলো চাচীর চিৎকার চেঁচামেচি । আব্বা, মা হতবিহ্বল হয়ে পড়লো চাচীর অবস্থা দেখে । বড় চাচা ভ্যাবাচেকা অবস্থায় পড়ে শুধু বললেন -
ফরিদা, সাতটা দিন সময় দাও , ওদের একটা ব্যবস্থা এর মধ্যে হবেই ।
কোনো ব্যবস্থা হবে না । বিয়েতে এসেছে, বিয়ে শেষ, এখন ফিরে যাবে ।
আমি তো একা সব সামলাতে পারছি না তাই জুয়েলকে বলেছি সবাইকে নিয়ে ঢাকা চলে আসতে । আমারও উপকার হলো । বাচ্চারাও ভালো স্কুল কলেজে পড়তে পারলো ।
মানে কী এসবের ! ওরা থাকবে কোথায়? তোমার কী মাথা খারাপ হলো নাকি?
না, না এখানে ওরা থাকবে না। তাই তো বললাম, সাতটা দিন…
চাচী দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন, সাত দিন মানে সাত দিন ।
আব্বা পড়লেন উভয়সংকটে । আমাদের সমস্ত কিছু বিলিয়ে দিয়ে এসেছি, ফিরে যাওয়ার উপায় নেই তারপরও মা'কে বললেন -
চলো নিলু ফিরে যাই । সব ঠিক হয়ে যাবে ।
মা সময়ে সময়ে অসম্ভব জেদি হয়ে উঠতেন । পুরো পরিস্থিতিটা মা মুখ বুঁজে সহ্য করলেন । আব্বাকে শুধু বললেন -
সাত দিন পর তুমি কোথায় নিয়ে যাবে জানি না তবে মনে রেখো সাতদিন পর একদিনও আমি এ বাড়িতে থাকবো না, তবে খুলনা আমি এখন আর ফিরছি না
ছয়দিনের মাথায় আমাদের ঠিকানা বদল হয়ে গেলো । মিরপুরে দাদার একটা বাড়ি ছিলো । ভাড়া দেয়া ছিলো বাড়িটা । দুই ধারে তিনটা করে ঘর আর মাঝখানে যাওয়া-আসার পথ । একপাশে ভাড়াটে আছে আরেক পাশ খালি পড়েছিলো । ওখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো । আমরা পাঁচজন মানুষ আর তিন সুটকেস কাপড়, এই নিয়ে শুরু হলো নতুন জীবন । খাট-পালং, হাঁড়ি-বাসন কিচ্ছু নেই ।
যেহেতু বছরের অর্ধেক শেষ তাই স্কুল-কলেজগুলো ভর্তি নিতে চাইছিলো না । বাড়ির পাশেই ছিলো গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ । মা যেয়ে হেড স্যারের সাথে কথা বললেন । সবকিছু শুনে স্যার আমাদের দু'বোনকে ভর্তি করে নিলেন । শুধু বাকী মাসের বেতন দিলেই হবে । এটা আমাদের জন্য অনেক বড় সাহায্য ছিলো তখন । সৌরভের তখনো স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি ।
বড় চাচার অনুরোধে আব্বা ওনার ফ্যাক্টরিতে বসতে শুরু করলেন । মা ভালোমন্দ কিছুই বললেন না শুধু আমরা চাচার বাসায় যাওয়া বন্ধ করে দিলাম আর ওনাদের তো আমাদের এখানে আসার প্রশ্নই ওঠে না । আব্বা একবার আসতে বলায় চাচী একদম মুখের ওপর বলে দিয়েছিলেন -
মিরপুরে কী মানুষ থাকে না-কি ? ব্যাস তারপর থেকে যাওয়া-আসা বন্ধ ।
খুলনায় থাকতে আমরা বেশ স্বচ্ছল ছিলাম কিন্তু ঢাকায় এসে মোটামুটি অথৈজলে পড়ে গেলাম । বাজেটে কাটছাঁট শুরু হয়ে গেলো । সকালে রুটি-আলু ভাজি, দুপুরে ডিম আলুর তরকারী আর শাক, রাতে যে-কোনো দু'টো ভর্তার সাথে ভাত । ত্রিশ দিন এক ম্যেনু । তবে মা'র হাতের জাদুকরী রান্নায় প্রতি বেলায় আমরা তৃপ্তি নিয়ে খাবার খেতাম ।
আব্বা ভোরে বের হয়ে যান, ফিরে আসেন রাত দশটায়, একেবারে সব কাজ গুছিয়ে অফিসে তালা ঝুলিয়ে তারপর ছুটি । প্রথম মাসের বেতন এনে যখন মা'র হাতে তুলে দিলেন, মা বললেন -
এরচেয়ে তোমার পোস্ট অফিসের বেতন বেশি ছিলো ।
এরমধ্যেই চালিয়ে নাও নিলু । আমি জানি, তুমি পারবে । আসলে বেতন সেকশনটা তো ভাবির হাতে, ভাবিই ঠিক করে দেয় কার কতো বেতন হবে ।
মা আর কোনো কথা বললেন না । টাকাটা নিয়ে আলমারিতে রেখে দিলেন।
মা নিজের মতো করে কিছু একটা করতে চাচ্ছিলেন কিন্তু নতুন জায়গা, অচেনা পরিবেশে ঠিক কী করা যায় বুঝে উঠতে পারছিলেন না । আমাদের সামনের ঘরের ভাড়াটে সালমা খালা । ওনার ঘরে সারাদিন মেশিন চলার আওয়াজ আসে । লোকজন কাপড় নিয়ে যাওয়া-আসা করে । মা একদিন খালার কাছে জানতে চাইলেন -
এগুলো কীসের কাজ সালমা?
আপা আমি বুটিক শপ থেকে অর্ডার আনি তারপর লোক দিয়ে কাজগুলো করাই । আপা আপনাকে বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু কী মনে করেন তাই আর বলতে পারিনি ।
কী কথা বলো না?
আপা আপনার হাতের কাজ আমি দেখেছি । এত্তো সুন্দর, সুক্ষ আর পেটানো কাজ আমি আগে দেখিনি । আপনি কাজ করলে কিন্তু খুব ভালো করতে পারবেন আপা ।
মা হেসে বললেন , আচ্ছা দিও, দেখি চেষ্টা করে কিছু পারি কি-না ।
এরপর মা আমাদের দুই বোনকে নিয়ে কাজ শুরু করলেন । বেবী ফ্রক আর পাঞ্জাবিতে যতো হাতের কাজ, আমরা তিনজন মিলে করতে লাগলাম । অল্প, অল্প করে পয়সা জমতে লাগলো টানাটানির সংসারে । আমাদের ত্রিশ দিনের ম্যেনুতে সামান্য ভালোবাসার ছোঁয়া লাগলো । সৌরভের আবদারের কারণে সপ্তাহে একদিন মাছ তো পরের সপ্তাহে মাংস উঠতো আমাদের পাতে ।
এরমধ্যে হুট করে সালমা খালার বিদেশ যাওয়ার একটা সুযোগ চলে এলো । সালমা খালা মা'কে নিয়ে যেয়ে বুটিকের ম্যানেজার আপার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন । খালার কাজগুলো এখন থেকে মা করবেন । মা'র হাতের কাজ উনি আগেই দেখেছিলেন তাই কাজ পেতে মা'র অসুবিধা হলো না ।
সালমা খালা তার মেশিন আর ঘরের সব জিনিসপত্র রেখে গেলেন । বললেন, আপা যখন টাকা হবে তখন দিয়েন । আজকে আমি এর কোনো দাম নেবো না । আমরা খুব অবাক হয়েছিলাম । আপন মানুষ দুর দুর করে ঠেলে দিয়েছে আর অচেনা একজন আমাদের জীবন পাল্টানোর গল্পটা নিজ হাতে শুরু করে দিয়ে গেলেন ।
ঈদে কাজ খুব বেড়ে গেলো । মা কিস্তিতে আরো তিনটা সেলাই মেশিন কিনে ফেললেন । দিনরাত কাজ চলছে বাসায় । আমরা দুই বোনও লেখাপড়ার বাইরে কাজ নিয়েই মেতে থাকি । একদিন সকালে বড় চাচী এসে হাজির । আমরা খুব বেশি অবাক হয়ে গেলাম । এখানে এসেছি প্রায় এক বছর । এর মধ্যে কারো যাওয়া-আসা নেই । হঠাৎ কী মনে করে আসলেন ঠিক বুঝতে পারলাম না কেউই । চাচী এসে ঘুরে ঘুরে সব দেখলেন । মা'কে বললেন -
ভালোই তো সাজিয়ে নিয়েছো বাড়িঘর । আমাকে বললেন -
এই মুনমুন, যা তো ড্রাইভারকে গিয়ে বল তোদের জিনিসগুলো নামিয়ে দিতে ।
আমি আর কুমকুম যেয়ে ব্যাগগুলো নিয়ে এসে চাচীর সামনে রাখলাম । ব্যাগগুলো তুলে নিয়ে মা'র দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন -
কিছু মনে কেরো না নিলু । নিজের লোকের অবস্থা খারাপ থাকলে তো বাইরে দান-খয়রাত করে লাভ নেই । না মানে তোমাদের জন্য ভালো জিনিসই কিনেছি । যাকাতের টাকা দেখে মনে করো না যে তোমাদেরও চাকর, দারোয়ানের মতো জিনিস দিয়েছি ।
রাগে আমার হাত-পা কাঁপছিলো । চাচীর মুখের ওপর কিছু শুনিয়ে দিতে চাচ্ছিলাম । মা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন তাই হাতের ইশারায় আমাকে ডেকে ভেতরে যেতে বললেন নাস্তা আনার জন্য । তারপর চাচীর দিকে ফিরে বললেন -
ভাবি আপনি যা এনেছেন সেটাই আমাদের ভাগ্য । একটা কথা জানেন তো, নিয়ত গুনে বরকত হয় ।
চাচী আর কোনো কথা বললেন না, কিছু মুখেও দিলেন না । যাওয়ার আগে মা'কে বলে গেলেন -
ভালোই তো আছো মনে হচ্ছে । মায়া'র আব্বা কেন যে নাকে কাঁদে ভাইয়ের জন্য বুঝি না ! গোডাউন থেকে মনেহয় জুয়েলের ভালোই হাত সাফাই হয় ।
মা কোনো উত্তর দিলেন না । আমরা মা'র ওপর রাগ করলে উল্টো আমাদের বললেন -
ধৈর্য ধরো । ধৈর্য খুব বড় গুণ । ওপরে একজন আছেন যিনি সবকিছু দেখেন । সময়ে সবকিছু ফিরিয়ে দেন তিনি । রাতে আব্বা ফিরলে চাচীর বলে যাওয়া কথা আর কাপড় দেখিয়ে মা বললেন -
আগামীকাল বড় ভাইয়ের কাছে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে চাকরী ছেড়ে চলে আসবে ।
মা'র কথায় এমন কিছু ছিলো যে আব্বা আর কথা বাড়ালেন না । পরদিন থেকে আর কাজে গেলেন না । এরপর বড় চাচার সাথে আমাদের যোগাযোগ একেবারেই বন্ধ হয়ে গেলো ।
মা'র সাথে আব্বা এসে ব্যবসার হাল ধরায় তরতরিয়ে ব্যবসা বাড়তে লাগলো । কঠোর পরিশ্রম আর সততার পাশাপাশি ভাগ্যও বোধহয় সহায় ছিলো আমাদের । পাঁচ বছরের মাথায় সত্যিই আমরা ঘুরে দাঁড়ালাম । তবে আমাদের জীবনযাপনে খুব একটা হেরফের হলো না । মা কোনো একটা প্ল্যান মাথায় নিয়ে টাকা জমাচ্ছিলেন আর আব্বাসহ আমাদের সবার ভরসা ছিলো মা'র ওপর । একসময় বুটিক পড়ায় আমাদের নিজেদেরও একটা দোকান হলো আর বাড়ির পাশে দরদাম করে মা ছোট্ট এক টুকরো জায়গাও কিনে ফেললেন । আমাদের স্বপ্নগুলো ধীরে ধীরে আকার পাচ্ছিলো । নানাবাড়ির সম্পত্তি বিক্রি থেকে মা'র ভাগে কিছু টাকা এলো । এছাড়া জমানো টাকা আর ব্যাংক লোন নিয়ে ছিমছাম দোতলা একটা বাড়িও দাঁড়িয়ে গেলো ।
মাঝে মাঝে বড় চাচার খবর পাই । চাচা মাঝে কিছুদিন কঠিন অসুখে পড়েছিলেন । তখন চাচীর ভাইদের হাতে ব্যবসার দায়িত্ব যায় । ওনারা নিজেদের মতো করে সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে চাচার ব্যবসায় লাল-নীল বাত্তি জ্বালিয়ে দিয়েছেন । আব্বা মাঝে মাঝে যেয়ে চাচাকে দেখে আসতেন কিন্তু মা'র কঠিন নিষেধ ছিলো, ব্যবসায়িক বা অন্য কোনো বিষয়ে যেন আব্বা কোনো কথা না বলেন । আব্বা একদিন বাসায় এসে বললেন -
ভাবী মিরপুরের বাসায় চলে আসতে চাচ্ছেন । ধানমন্ডিতে এতো টাকা বাড়িভাড়া দিয়ে কুলাতে পারছেন না ।
আমরা তখন মাত্র নতুন বাসায় উঠেছি । পুরোনো বাড়িতে একপাশে কারখানা, আরেক পাশ খালি ছিলো । মা বললেন -
বাড়ি যেহেতু আব্বার নামে, একপাশে তো ওনারা থাকতেই পারেন । আরেক দিকে আমার কারখানা থাকবে ।
নিলু ওমন জায়গায় ভাবী কী করে থাকবে বলো তো? বলছিলাম যে আমাদের নিচতলা তো খালি আছে , ভাবীও তাই বলছিলেন….
মা এমন একটা চাহুনি দিলেন যে আমরা সবাই চুপ হয়ে গেলাম । তবে পরের ঘটনার জন্য আমরা একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না । একদিন বাদেই সক্কাল সক্কাল ট্রাক ভরা মালামাল নিয়ে বড় চাচার ফ্যামিলি হাজির । মা তখন সৌরভকে নিয়ে কাজের পেমেন্ট আনতে গেছেন আসাদগেটে আর আব্বা ইসলামপুরে কাপড় আনতে গেছেন । বাড়িতে আমরা দুই বোন । কী করবো বুঝতে পারছি না । নীচতলা তো খালিই ছিলো । লেবাররা সব মালপত্র ভেতরে রেখে চলে গেলো । বড় চাচী ওপরে এসে দুপুরে রান্নায় কী খাবেন তার ফর্দ ফাতেমার কাছে দিয়ে দিলেন ।
ঘন্টাখানেক পর মা ফিরে এসে কান্ড দেখে কিছুই বললেন না । যেন কিছুই হয়নি । বড় চাচী ছুটে এসে মা'কে জড়িয়ে ধরে বললেন -
ইশ, কত্তোদিন তোমাদের দেখি না নিলু ! তোমাদের সাথে থাকতেই চলে এলাম ।
খাওয়াদাওয়া করেন ভাবী, পরে কথা বলছি । মা'র আওয়াজে এমন কিছু ছিলো, চাচী আর কিছু বললেন না ।
বিকেলে ফাতেমা সবাইকে চা-নাস্তা দিয়ে গেলে মা কথা শুরু করলেন -
ভাবী এবার বলেন কী বলবেন ।
আরে বলবো আবার কী? আমি তো আমার ছোট বোনের সাথে থাকতে চলে এলাম ।
বাড়ি তো খালি ছিলো । আমি মুনমুনের আব্বাকে বলেছি তো যে আপনারা ওখানে উঠতে পারেন ইচ্ছে হলে ।
তাই কী হয় বলো? এতো পুরোনো, ড্যাম্প ধরা বাড়িতে থাকা যায়? একতলাটা তো খালিই আছে । তোমাদের তো আর লাগছে না । আর ভাইয়ের বাড়িতে ভাই তো থাকতে পারে ।
ভাবী আমি আসলে বেশি কথা বলতে চাচ্ছি না । আব্বার বাড়িতে আপনারা থাকবেন, তাতে আমার বলার কিছু নেই । বাড়ি তো পুরোনোই । অসুবিধে নেই, আপনারা সাতদিন এখানে থাকেন, এরমধ্যে বাড়িঘর রঙ করিয়ে দিচ্ছি । তারপর উঠে যাবেন ঐ বাড়িতে ।
তুমি এমন করছো কেন নিলু? তোমার বিপদে আমি সাহায্য করিনি ।
মনে আছে ভাবী, কিছুই ভুলিনি আমি । তবে জানেন কী, আপনি আরাম আয়েশে থেকে অভ্যস্ত তাই এখানে আপনার অসুবিধা হতে পারে । মিরপুরে আপনি কী করে থাকবেন?
কিচ্ছু হবে না । দুই বোন মিলেমিশে থাকবো আর আমার বাপের বাড়ি তো মিরপুরেই ।
জানি আপনার বাপের বাড়ি মিরপুরে, মিরপুর থেকেই আপনি ধানমন্ডি গেছেন । যাকগে, ভাবী ঢাকায় এসেছিলাম বড় ভাইয়ের কারণে । মুনমুনের আব্বা কোনোদিন কারো সাথে-পাছে থাকেনি, নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ । বড় ভাইয়ের ওপর ওনার অগাধ বিশ্বাস ছিলো আর সেই বিশ্বাস আমার সংসারটাকে পথে বসিয়ে দিয়েছিলো প্রায় । সালমা না থাকলে কী হতো জানি না । একদম শেষ থেকে আবার শুরু করতে হয়েছে আমাদের । সংসারটাকে একটু একটু করে গুছিয়ে এনেছি সবাই মিলে । এখানে আমি নতুন করে কোনো জটিলতা, কোনো ঝামেলা ঢুকতেই দেবো না । সবার দিন আসে, সবাইকেই হয়তো আবার শেষ থেকে শুরু করতে হয় । সাতদিন বেড়ান, তারপর নিজের বাড়িতে উঠে যাবেন । মা'র কথা শুনে কেউ কোনো কথা বলে না আর । মা উঠে নিজের ঘরে চলে গেলেন ।
রাতে আমরা সবাই মিলে যেয়ে মা'কে ধরলাম -
মা তুমিই তো আমাদের শিখিয়েছো, মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়াতে আর এ তো আমাদের আপন চাচার বিপদ । চাচা অসুস্থ, তুমি এমন কোরো না মা । ওরা থাকুক না নিচের তলায় ।
শোন জীবনে মাঝে মাঝে কঠিন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়, নিজেদের ভালো থাকার জন্যই । বড় ভাবীর মতো মানুষরা কোনোদিন পাল্টায় না । তোর আব্বা আমার ওপর রাগ করলেও আমি সিদ্ধান্ত পাল্টাবো না । বড় ভাই অসুস্থ, ওনাকে সাধ্যমতো করার চেষ্টা করবো কিন্তু এ বাড়িতে না । ওনাকে ঐ বাড়িতে যেতেই হবে । যারা মানুষকে মানুষ মনে করে না, জীবন তাদেরকে কখনো কখনো সময়ের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় । নাহলে এরা কখনো শুধরোবে না । সুযোগ পেলেই নিজের চেহারা দেখিয়ে দেবে । এই সুযোগ ওনাকে দেয়া যাবে না । উনিও একটু বুঝুক, শেষ থেকে শুরু করতে কেমন লাগে ।
(সমাপ্ত)