নিম্মি হচ্ছে পরিবারের বড় মেয়ে। নিম্মির বাবা ফরিদ খায়ের একজন সরকারি কর্মকর্তা আর মা শামীমা আরা একজন গৃহিনী। নিম্মি এ বছরে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছে, তিন ভাই বোনের মধ্যে ভাই নোমান মেঝ, সে ও এ বছরে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে আর সবার ছোট আন্নি। আন্নি কলেজে এবার ভর্তি হয়েছে। আন্নি হচ্ছে চুপচাপ আর নিম্মি হচ্ছে উচ্ছলতা প্রিয় মানুষ। সব সময় পুরো বাসা মাতিয়ে রাখে নিম্মি।
এ সপ্তাহে নিম্মির বিয়ে। নিম্মির পছন্দ করা ছেলের সাথেই বিয়ে হচ্ছে নিম্মির। এ কারণে নিম্মি খুব খুশি। তার সময় যেন কাটছে না শুধু মনে হচ্ছে কখন তার ভালবাসার মানুষ তুষারের ঘরে বউ হয়ে যাবে!
ফরিদ সাহেবের আর মিসেস শামীমার মন খুব খারাপ লাগছে এই চঞ্চল মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাবে, তাদের ছেড়ে চলে যাবে শ্বশুড় বাড়ি। মা-বাবা দু'জনেরই নিম্মির জন্য টান একটু বেশি কারণ নিম্মি হচ্ছে তাদের বড় সন্তান।
নিম্মির বিয়ের ২ দিন পর.....
নিম্মির এখন মনে হচ্ছে নিম্মি বোধহয় এ জগৎের সবচেয়ে সুখী মানুষ! কারণ তুষারের সাথে তার দীর্ঘ ছয় বছরের প্রেমের পর তার দুজন এক সাথে এখন। যদিও ফরিদ সাহেব বেসরকারি চাকরিজীবি ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতেই একবারে রাজি ছিলেন না, তবুও মেয়ের দিকে চেয়ে রাজি হয়েছিলেন এছাড়া তুষারের পরিবার ও খুব ভাল। নিম্মির এখন ও মনে হয়, এসব সব স্বপ্ন বোধহয়।
গতকাল নিম্মির রিসিপশন অনুষ্ঠান হয়েছে, তাই আজ বাপের বাড়ি যাচ্ছে নিম্মি। সারা রাস্তা তুষারের হাত ধরে আছে নিম্মি। বার বার বলছে তুষার, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না যে, আমরা বিয়ের পর একসাথে যাচ্ছি।
ঘরে ঢুকতেই আন্নি ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানালো নতুন দুলাভাইকে। নিম্মি দেখল মা অনেক আয়োজন করেছেন। নিম্মি দুই বার রান্না ঘরে গেলো মাকে সাহায্য করতে কারন নিম্মি রান্না খুব ভাল পারে। কিন্তু মা বললেন না তুই যা জামাইয়ের সাথে কথা বল, আমি করছি। অথচ আগে মেহমান আসলে নিম্মিই রান্নাঘরে থাকত। নিম্মি রান্নাঘর থেকে এসে নিজের রুমে ঢুকলো শাড়ি বদল করতে আন্নি বলল আপা এই রুম এখন থেকে আমার, পুরোটা আমার দখলে,
-আচ্ছা।
-আপা তুমি দুলাভাই কে নিয়ে আজ মায়ের রুমে থাকবে।
-কেন? আমি এই রুমেই থাকব।
-না আপা এই রুম ছোট, খাট ও ছোট...
-কেন ছোট হবে তুই আর আমি আগে থাকিনি এই খাটে?
-আপা আম্মু বলেছেন এই রুমে জামাই কে দেওয়া যায়না, তাছাড়া এই রুমে বাথরুম নেই।
-না থাক। আমি এই রুমেই থাকব।
-আচ্ছা, আম্ম রাজি হলে....
রাতের বেলা মা বললেন নিম্মি তুই আর জামাই আমার রুমে থাকবি মা, নোমান ফুল দিয়ে সাজিয়েছে খাট।
-আম্মু কেন? আব্বু আর তুমি কোথায় থাকবে?
-আমি আন্নির সাথে আর তোর আব্বু নোমানের সাথে। মারে জামাই মানুষ দুই দিন আরাম করে থাকবেনা?
-না মা, এটা ঠিক নাহ।
-আচ্ছা এটা পরে বুঝবো।
নিম্মির মন খুব খারাপ হলো আগে বাসায় কেউ মেহমান আসলে এরকম জায়গা বদল হতো তবে কি সে এই বাসার মেহমান?
এছাড়া বাবা মায়ের খাটে বড় হওয়ার পর কোন দিনও থাকা হয়নি, আজ জামাই নিয়ে থাকতে হবে?
কেমন এক মন খারাপ হচ্ছে নিম্মির কাউকে বোঝানো যাচ্ছেনা।
তুষার বলল নিম্মি?
-হুম
-মন খারাপ কেন?
-না এমনি। মন খারাপ না।
-আজ কত আনন্দের দিন, মন খারাপ কেন?
-তুষার আমার প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে আমি ঘুমিয়ে যাই, তুমি ঘুমাও।
-মাথা কি ম্যাসেজ করে দিব?
-না, ঘুমালেই ভাল লাগবে।
নিম্মি অন্য পাশ ফিরেতেই পানিতে দুই চোখ ভিজে উঠছে, এত কষ্ট লাগছে কেন? নিজেই বুঝতে পারছেনা।
সকাল বেলা মা তার প্রিয় ডিম-পোলাও রান্না করেছেন অথচ ও দুই বার রান্না ঘরে গেলেও বলছেন যা তুই রেস্ট নে। মা ওর প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছেন এটা ও নিম্মির অসহ্য লাগছে।
যেদিন চলে আসবে মিসেস শামীমা নিম্মির ঘরে পরার ভাল ৬ টি ড্রেস ব্যাগে দিয়ে দিলেন বললেন তুই তো এখানে থাকবিনা মা। আর জামা গুলিও নতুন, নিয়ে যা শ্বশুড় বাড়িতে পরতে পারবি। নিম্মি বলল মা আমার সব জিনিস দিয়ে পর করে দিচ্ছ মা।
-না রে মা!
-আচ্ছা যাচ্ছি মা, ভাল থেকো।
নিম্মি গাড়িতে বসে আবারো কান্না করছে তুষার বলল নিম্মি মন খারাপ কর না। বাসা কাছেই যেকোনো সময় আসবে। কান্না করনা নিম্মি প্লিজ।
নিম্মির বাসার জন্যে কান্না করছেনা, নিম্মি কান্না করছে সে যে তার প্রিয় পরিবারের কাছে পর হয়ে যাচ্ছে, এই দুঃখে।
বেশ কিছু দিন পর নিম্মি বাসায় এসে দেখলো তার রুম টা পুরোপুরি বদলে গেছে তার পড়ার টেবিল রুমে নেই। নিম্মি তার মা কে ডাকা শুরু করল আম্মু, আম্মু...
-কি হয়েছে রে?
-আমার পড়ার টেবিল কোথায়?
-ওই পাশের বারান্দায় রেখেছি।
-কেন?
-আন্নি বই রাখার জন্যে শেল্ফ কিনেছে, তাই জায়গা হয়নি। আর টেবিল তো কাজে ও লাগেনা তাই।
-ভাল করেছ। আর আমার নীল পর্দা কি হয়েছে?
-নীল পর্দা তো সুতি কাপড়ের রোদ ঢুকে যায়,আন্নির রোদ চোখে লাগলেই মাইগ্রেন হয় তাই বদল করে মোটা কাপড় পর্দা দিয়েছি।
-মা, আমার নীল পর্দা দিয়ে দাও।
-কেন?
-মা আমি নিজের হাতে কাজ করেছিলাম এই পর্দায় এটা আমার অনেক প্রিয়।
-আচ্ছা নিস। এখন বল কি খাবি?
-তুমি কি রান্না করেছ?
-এগুলি দিয়ে কি আর তোকে খাওয়ানো যায়? এত দিন পর এলি?
-মা এই যে আমাকে মেহমান বানিয়ে দাও ঠিক এই কারণেই আসতে চাইনা।
আন্নি তুই তো নিজের মত রুম গুছিয়ে নিচ্ছিস, যখন বিয়ের পর দেখবি নোমানের বউ তোর সব জিনিস ফেলে দিয়ে, ঘর সাজাবে তখন বুঝবি।
মা আমি বিকেল পর্যন্ত থাকব ভেবেছিলাম, আমার ভাল লাগছেনা, আমার পর্দা দাও আমি চলে যাব।
-না মা এমন করেনা।
-মা প্লিজ এমন করনা আজ আমার থাকতে ভাল লাগছেনা প্লিজ জোড় করনা।
নিম্মি রিকশার হুড ফেলে একা একা যাচ্ছে হাতে নীল পর্দা, পরনে ধবধবে সাদা জামদানী শাড়ি আর হলুদ ব্লাউজ। নিম্মি চোখ মুখ শক্ত করে রিকশায় বসে আছে, রিকশা চলছে....
আর নিম্মি ভাবছে মেয়েরা বিয়ের পর কত তাড়াতাড়ি পর হয়ে যায়, কত শখের জিনিস ও ঘরে গিয়ে পাওয়া যায়না তা যে কত কষ্টের এটা বোধহয় মেয়েরা ছাড়া আর কেউ জানেনা। মেয়েদের কখনোই কোন ঘর হয়না, কখনোই না.....
(সমাপ্ত)