What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Self-Made গয়নার বাক্স (1 Viewer)

Fahima

Senior Member
Joined
Apr 8, 2019
Threads
137
Messages
539
Credits
32,076
আজকের এই ফেসবুকের জমানায়ও আমি বিয়ের পাত্রের নাম ছাড়া কিছুই জানতে পারলাম না । বরাবরই লাজুক এই আমি মা'কে মুখ ফুটে বলতে পর্যন্ত পারলাম না যে আমি পাত্রের ছবি দেখতে চাই। ছোট বোন নামিরাকে বিষয়টা নিয়ে ইঙ্গিত করতেই ও যেন কিছুই বুঝতে পারছে না এমন ভাণ করে সরে গেলো । আমি জানি ও ইচ্ছে করে আমার সাথে এই আচরণগুলো করে সবসময় । মনে মনে ঠিক করেছি বিয়ের পর ওর সাথে আর কোনো সম্পর্কই রাখবো না ।

বাড়ির সবার কথাবার্তায় বুঝলাম, মুকুল মানে পাত্র যেহেতু লতায় পাতায় আত্মীয় আর তাকে সবাই আগেও দেখেছে তাই এতো ছবি টবি দেখার কিছু নেই । দুর্ভাগ্য আমার, আমি তাকে আগে পরে কখনোই দেখিনি । সামনে বৃহস্পতিবার ছেলের বাড়ি থেকে একেবারে আংটি পরাতে আসবে । দেখাদেখি যা করার তখন সেরে নিলেই হবে । আমার বুকের ভেতরের দ্রিম দ্রিম আওয়াজ আমি বাইরে থেকেই শুনতে পেলাম যেন । সরাসরি আংটি পরানো ! হ্যাঁ বুঝলাম আমি প্রেম করি না তার মানে তো এই না যে আমি তার চেহারাটা মানে একটা ছবিও দেখতে পাবো না । খুব অভিমান হলো মা-বাবার ওপরে ।

পাত্র আমার মামাতো বোন সারা আপুর জা'য়ের ভাই । সারা আপুই প্রস্তাবটা নিয়ে এসেছিলো আমাদের বাড়িতে । প্রস্তাব শুনে বাবা একটু ইতস্তত করছিলেন কারণ আমাদের তুলনায় ছেলেদের অবস্থা একটু বেশি ভালো । বাবা সারা আপুকে বললেন, না করে দাও সারা ।

সারা আপু বললো -

এমন ছেলে সবসময় পাওয়া যায় না ফুপা । যেমন ভালো চাকরী করে, তেমন ভদ্র ছেলে । আজকের দিনে সবকিছু মিলে এমন অমায়িক আর ভদ্র ছেলে তো সোনার পাথরবাটি ।

না রে মা । মানানসই একটা ব্যাপার আছে না ? সম্বন্ধ করতে হয় নিজের অবস্থা বুঝে । আমরা তো তাদের সাথে কোনোভাবেই যাই না ।

সারা আপু মন খারাপ করে চলে গেলেও পরদিন তার জা সহ এসে হাজির । আমি তখন ভার্সিটিতে । জা এসে এমন করে ধরলেন বাবা-মাকে যে বাবা-মা'র না করার আর কোনো সুযোগই রইলো না । তারই ফলাফল হলো, সামনের বৃহস্পতিবার মুকুলের সাথে আমার আংটি বদল ।

ছেলের আংটি সারা আপু নিজেই কিনে নিয়ে এলো । মা তো প্রথমে একটু ঘাবড়েই গিয়েছিলেন । সারা আপুর যা খরচের হাত, ভয়ে আর আংটির দাম জিজ্ঞেস করতে সাহস পাচ্ছিলেন না । সারা আপু নিজেই বললো -

ফুপু শোনো, বাজারে অনেক রকম ঝকমারি আংটি পাওয়া যায় কিন্তু ওসব আমার একদম পছন্দ না আর মুকুলও ঐরকম ঢাউস আংটি পরবেই না । তারচেয়ে একদম সিম্পলের মধ্যে রিং নিয়ে নিলাম । তেরো হাজার নিয়েছে আংটিটা । ঠিক আছে তো ফুপু?

মা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিলেন । কারণ এর কমে এখন ভদ্রগোছের আংটি পাওয়া যাবে না হয়তো ।

আমরা মধ্যবিত্তরা জন্ম থেকেই বোধহয় শিখে যাই, স্বপ্ন ভেঙে গেলে আবারো নতুন উদ্যমে স্বপ্ন দেখতে কারণ স্বপ্নগুলোই তো বাঁচিয়ে রাখে আমাদের । জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চলে আমাদের স্বপ্ন ভাঙার আর জোড়া লাগার খেলা । মা'কে অনেক আগে থেকেই দেখছি আমার বিয়েতে গয়না গড়াবার জন্য টাকা জমাতে । মা'র একটা কাঠের ব্যাংক ছিলো । মা যখন যা পারতেন ওখানে জমা করে রাখতেন । আমি মা'কে বলতাম -

কী হবে গয়না দিয়ে বলো তো? আমার সোনার গয়না একদম ভালো লাগে না মা ।

সোনার গয়না ছাড়া আবার বিয়ে হয় নাকি? ও তুই এখন বুঝবি না । আরেকটু বড় হয়ে নে । তখন বুঝবি সোনার গয়নার মর্ম ।

আমাদের যে টানাটানির সংসার ছিলো, তা নয় তবে সংসারের ঘানি টানার পর মাস শেষে জমানোর মতো তেমন কিছু থাকতো না বাকি সব মধ্যবিত্তদের মতোই । এর মধ্যেই মা বেশ ক'বছর ধরে অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে গেলেন ওনার স্বপ্ন পূরণের জন্য । আমরা ভাইবোনেরা হাসাহাসি করতাম আর মা'কে বলতাম -

মা যেভাবে তুমি টাকা জমাচ্ছো, এই টাকা দিয়ে তো আমরা একটা বাড়িই কিনে ফেলতে পারবো ।

বাড়িতে যেহেতু বিয়ের কথা উঠেছেই, একদিন ক্লাস শেষে ফিরে দেখলাম, মা তাঁর সেই কাঠের মিনি সিন্দুক নিয়ে বসেছেন । আমার ভাই হাতুড়ি দিয়ে বাক্সটার এক মাথা খুলে ফেলতেই হুড়মুড়িয়ে এক গাদা টাকা বেরিয়ে এলো বাইরে । পঞ্চাশ, একশোর সাথে বেশ কিছু পাঁচশো আর এক হাজার টাকার নোট । প্রবল আগ্রহ নিয়ে সবাই তাকিয়ে আছি । অনিক টাকা গুনছে । মা'র উজ্জ্বল মুখটা ধীরে ধীরে মলিন হয়ে গেলো । এতো বছর ধরে মা যা জমিয়েছেন, তা দিয়ে এক ভরির বেশি গয়না হবে না । বারবার বলছিলেন, চার ভরির নিচে সেট বানাই কেমন করে বলতো ফ্লোরা ? সেদিন আমারও ভীষণ খারাপ লেগেছিলো । টাকার জন্য নয়, মা যে এতো বছর ধরে স্বপ্নটাকে লালন করে যাচ্ছিলেন, অথচ টাকা দেখে মা'র মুখটা একদম মলিন হয়ে গিয়েছিলো, সেটার জন্য । আমি শুধু বলেছিলাম, মা সত্যি বলছি আমার গয়নার কোনো শখ নেই, দরকারও নেই । গয়না ছাড়া যদি ঐ ছেলে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয় , তবেই আমি বিয়ে করবো । মা বলেছিলেন, আচ্ছা দেখা যাবে, তোকে এতো ভাবতে হবে না এসব নিয়ে । এরপর আর গয়না বিষয়ে মা'র সাথে আমার কোনো কথা হয়নি ।

বৃহস্পতিবার আংটি বদলের সময়ই আমি প্রথম দেখলাম মুকুলকে । সত্যি বলছি মুকুলকে আমার ভালো লাগলো, ভীষণ ভালো লাগলো দেখে । তখনো তার সাথে আমার একটাও কথা হয়নি কিন্তু মানুষটার মুখখানা কেমন মায়া কাড়া । নামে আংটি বদল হলেও ওদের বাড়ি থেকে হালকা ডিজাইনের মধ্যে গলার আর কানের একটা সেট এনেছে আংটির সাথে । আমার হবু শ্বাশুড়ি আমাকে গয়নাগুলো পরিয়ে দিয়েছিলেন আর আংটি পরালো মুকুল । আংটি পরানোর জন্য মুকুল আমার হাতটা ধরতেই আমার ভেতরে যেন কিছু একটা হয়ে গেলো । অদ্ভুত শিহরণ পুরো শরীরে , মনে ছড়িয়ে পড়লো যেন । এই অনুভূতি আমার আগে তো কখনো হয়নি । মনে মনে চাইছিলাম, হাতটা যেন আরো কিছুটা সময় ওর হাতের ভেতর থাকে, ইশ আরো কিছুটা ক্ষণ । এরপর আমি তো নার্ভাসনেসের কারণে মাটির দিকে তাকিয়ে আংটি পরাতে না পেরে আরো নার্ভাস হয়ে গেলাম । সারা আপু আমাকে উদ্ধার করলো বিপদ থেকে ।

বিয়ের ডেট ঠিক হলো আরো দুই মাস পরে । মুরুব্বিরা দাবীদাওয়া নিয়ে কথা তুলতেই আমার হবু শ্বাশুড়ি বললেন, আমার একটা দাবি আছে , আপনাদের মেয়েটা আমার বাড়িতে যেয়ে যেন আমার মেয়ে হয়েই থাকে । তাহলেই আমার শান্তি । অন্য কিছু চাওয়ার নেই । এনগেজমেন্টের আয়েজন শেষে একসময় ওরা বিদায় নিলো । আমাদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে এবার আলোচনা শুরু হলো ।খালা, মামী, চাচীরা সবাই বলতে লাগলেন , সত্যিই আমার ভাগ্য খুব বেশি ভালো নইলে সবকিছু একসাথে পাওয়া যায় না ।

বড় সন্তানের সবকিছুতেই বোধহয় বাবা-মা'র আগ্রহ আর ভালোলাগা একটু বেশিই থাকে । একদিন রাতে বারান্দার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মা-বাবার কথা কানে এলো । মা বাবাকে বলছেন -

কতো কিছু ইচ্ছে ছিলো ফ্লোরার বিয়ে নিয়ে । আমাদের চাওয়া মতোন তো সবকিছু হবে না কিন্তু তারপরও তো একটা ব্যাপার থাকে । মেয়েটার বিয়ে নিয়ে কতো কিছু ভেবে রেখেছিলাম । মুকুলের মা আপা তো বললেন কিছুই লাগবে না কিন্তু সারা বললো, আয়োজনটা যেন একটু ভালো হয় ।

টেনশন কোরো না, আল্লাহ ভরসা । দেখি কতোটুকু কী করা যায় । বড় ভাই বলেছেন, কমিউনিটি সেন্টারের চিন্তা না করতে । সিনথিয়ার বরের সেন্টারে ব্যবস্থা হয়ে যাবে ।

বিনে পয়সায়!

বড় ভাই তো বললেন, ওইটা ওনার চিন্তা । আজকাল ভালো একটা সেন্টার নিতে গেলেই তো লাখ লাখ টাকা বেরিয়ে যায় । নিজেদেরই যখন আছে আর ভাই তো নিজ থেকেই আমাকে বলেছেন, তো ক্ষতি কী বলো ? এই খরচটা বাঁচলে তো অনেক বড় উপকার হবে আমাদের ।

মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো । টাকার টেনশনে বাবা-মা অস্থির হয়ে আছে অথচ আমি কোনোভাবেই তাদের সাহায্য করতে পারছি না । আমি দুটো টিউশনি করে আট হাজার টাকা পাই । ওটুকুই মা'র হাতে তুলে দেই । এরচেয়ে বেশি কিছু তো করার উপায় নেই আমার ।

এর মধ্যে একদিন অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এলো । ভরাট কন্ঠের মানুষটা নিজের পরিচয় দিতেই আবারো শিরশিরে অনুভূতি হলো । মুকুল ! আমার যদিও দু'একবার কথা বলতে ইচ্ছে হয়েছিলো কিন্তু লজ্জায় কারো কাছে ফোন নাম্বার চাইতে পারিনি । মনে মনে খুব চাইতাম মুকুল ফোন করুক কিন্তু যখন সেই কাঙ্খিত ফোন এলো, লজ্জায় কথা বলতে পারলাম না । হু, হ্যাঁ করে রেখে দিলাম । মুকুল বোধহয় রাগ করলো কারণ এরপর আর ফোন এলো না । অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি আমি । এরমধ্যে অন্তত একশোবার সেই নাম্বারটা বের করেছি কিন্তু ঐ যে আমার সারাজীবনের লাজুক স্বভাবের জন্য ডায়াল করতে পারিনি । চার দিন পর যখন ফোন এলো, আমি অভিমানে ফেটে পরলাম -

আপনার আমাকে কষ্ট দিতে খুব ভালো লাগে তাই না? এভাবে কেউ অপেক্ষা করায়? আমি তো পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম অপেক্ষায় থাকতে থাকতে । কেন এমন করলেন, কেন?

ফ্লোরা তুমি সত্যি অপেক্ষায় ছিলে ! আমার নাম্বার কিন্তু ছিলো তোমার কাছে । আমি যদি বলি, আমিও অপেক্ষায় ছিলাম, আমারও ভীষণ অভিমান হয়েছে। কতোবার যে ফোনটা চেক করেছি, কোনো মিসড কল আছে কিনা দেখার জন্য । একটাবার কী ফোন করতে পারতে না তুমি, একবারও ইচ্ছে হয়নি?

এতোগুলো কথা একসাথে বলে নিজেই যেন বোকা হয়ে গেলাম । তবে কথাগুলো বলার কারণেই বোধহয় মুকুলের সাথে সম্পর্কটা সহজ হয়ে গেলো, লজ্জা ভেঙে গেলো । তারপর থেকে শুরু হলো রাত জেগে ফোনালাপ । দু'জনের কথা যেন আর ফুরোতে চায় না । অপেক্ষা শুধু দুজনের কাছে আসার । অপেক্ষার প্রহর যে এতোটাই দীর্ঘ হয় তা কী আগে বুঝেছি কখনো ?

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো । ঘরভরা আত্মীয়স্বজন, পুরো বিয়ে বাড়ির পরিবেশ । আমাদের বাড়িটা সাদা রঙের মরিচা বাতিতে সেজেছে । আমার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষে রাতে মা আমার রুমে এলেন । হাতের ব্যাগটা থেকে গয়নার বড় বাক্সটা বের করে আমার সামনে মেলে ধরলেন -

ফ্লোরা দেখতো কেমন হয়েছে ?

একটা সীতাহার, একজোড়া পাশা আর একটা চূড় সুন্দর করে সাজানো ।

খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম -

কার মা!

আরে বোকা মেয়ে, বিয়ে তোর তাহলে গয়না কার হবে?

আমার ! অনেক সুন্দর হয়েছে মা । গয়নাটা সত্যি আমার ভীষন পছন্দ হলো । মা'কে জিজ্ঞেস করলাম - কী করে বানালে মা ? এতো অনেক টাকার জিনিস।

সেটা তোর ভাবতে হবে না । আমার খুব শখ ছিলো তোকে একটা সীতাহার দেয়ার কিন্তু পুরোটা তো হলো না । শেষেরটুকু টারসাল দিয়ে করতে হয়েছে । তাও হারাধন দাদা ছিলো দেখে আড়াই ভরিতে সীতাহার তৈরি করে দিয়েছে ।

মা সত্যি করে বলো এতো টাকা তুমি কোথায় পেলে?

আবারো সেই একই কথা । তুই নিশ্চিন্ত থাক, কারো কাছে হাত পাতিনি আমি, এ পুরো আমার নিজের টাকায় কেনা ।

হঠাৎ খেয়াল হলো মা'র হাত দু'টো খালি । জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখে আসছি মা'র হাতে ঐ চুড়ি দু'টো । ঐগুলো নাকি নানা দেশের বাইরে থেকে ফেরার সময় মা'র জন্য এনেছিলেন । দু'টো চুড়িতে তিন ভরির বেশি স্বর্ণ আছে । আমরা কতোবার মা'কে বলেছি -

মা তুমি এগুলো পরে বাইরে যেও না । ছিনতাইকারী নিয়ে গেলে সব শেষ । পরে আফসোস করবে ।

এই দেখ হাতে দিয়ে রাখতে রাখতে আর বোঝার উপায় আছে , এটা যে সোনার চুড়ি? এটা আমার বাবা'র স্মৃতি । এটা আমি কখনো খুলবো না । ভাগ্যে না থাকলে চলে যাবে আমার কাছ থেকে, কী আর করা ।

বুকের ভেতরটা ছ্যাত করে উঠলো -

মা তুমি চুড়ি দিয়ে আমার জন্য গয়না এনেছো ? আর কী দিয়েছো বলো ? অনেকক্ষণ জোরাজুরি করার পর মা স্বীকার করলেন, মা'র চুড়ি জোড়া আর গলার যে চিক ছিলো, ঐ দুটো দিয়ে আর কিছু টাকা দিয়ে, কিছু বাকি রেখে হারাধন স্যাকরার কাছ থেকে আমার জন্য এই সেট তৈরি করিয়েছেন ।

চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো । মা'কে বললাম -

কবে করেছো এই কাজ? কেন করেছো? তোমার শখের চুড়িগুলো, নানার স্মৃতি কেন এভাবে হাতছাড়া করলে মা ?

টাকা তো আগেই দিয়েছিলাম । আজ যেয়ে আমার গয়নাগুলো দিয়ে তোরটা নিয়ে এলাম ।

মা'র কথাগুলো শুনে আর কান্না থামাতে পারলাম না । মা তাড়াতাড়ি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন -

চুপ, একদম চুপ । বাড়ি ভরা মানুষ, সবাই শুনতে পাবে তো । আমার মেয়েকে বউয়ের সাজে দেখতে বুঝি আমার মন চায় না? আর ওগুলো তো অনেকদিন হাতে দিলাম । আর কতো বল? আমার কী এখন আর চিক পরার বয়স আছে? সময়মতো যদি কাজেই না লাগলো তাহলে গয়নাগাটি রেখে কী লাভ বলতো ? চোখ মোছ তাড়াতাড়ি, ঐ যে সারা আর টিউলিপ আসছে এদিকে । বলেই গয়নার বাক্সটা নিয়ে মা বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে ।

সারা আপু আর টিউলিপ আপু রুমে ঢুকেই বললো -

এই ফ্লোরা তোর গয়না দেখেছিস ? আমার তো খুব পছন্দ হয়েছে ।

হুম…

কী রে মন খারাপ? এমন চেহারা করে আছিস কেন?

আমি আর কান্না থামাতে পারলাম না । সারা আপুকে বলে ফেললাম সবকিছু ।

কই আমি যে ফুপুকে এতো করে বললাম, টাকা লাগলে আমার কাছ থেকে নিতে, ফুপু শুধু বলে যে লাগলে বলবো । ফুপু যে এই কাজ করবে তা তো আমি বুঝিনি ।

কারো সাথে কথা বলতেই আর ভালো লাগলো না আমার । মুকুল কয়েকবার ফোন করলো কিন্তু আমি একবারও রিসিভ করলাম না ।

আজ আমার বিয়ে, পার্লার থেকে সাজ শেষ করে সরাসরি চলে এসেছি কমিউনিটি সেন্টারে । আত্মীয়স্বজন এর মধ্যেই চলে এসেছে । আমি স্টেজে বসে সবাইকে দেখছি । নামিরাকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে দেখতে । আজ চলে যাবো বলেই হয়তো নামিরাকে দেখে বারবার চোখে পানি আসছে । সারাজীন ও আমার সাথে যতে ঝগড়া, মারামারি করেছে, যতো অভিমান জমে ছিলো ওর ওপর, সব যেন ধুয়েমুছে গেলো । বাবা ব্যস্তভাবে ছোটাছুটি করছেন । মা ঘুরে ঘুরে সবার সাথে কথা বলছেন । হাল্কা গোলাপি কাতানে মা'কে দেখতেও ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে । মা কাছে আসতেই দেখলাম হাতে দুটো চকচকে চুড়ি । মনে পড়লো গত ঈদে সিটি গোল্ডের চুড়িদুটো গাউসিয়া থেকে এনেছিলাম মা'র জন্য । দীর্ঘশ্বাস ফেলে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই । একসময় বরপক্ষ চলে এলো । মুকুলের বড় বোন এসে তাদের পক্ষ থেকে আনা গয়নাগুলো পরিয়ে দিলেন আমাকে । গয়নায় গয়নার ভরে উঠলো আমার শরীর ।

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে কিছুক্ষণ আগে চলে এসেছি মুকুলদের বাসায় । বাবা-মা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন এবং আমাদের আত্মীয়স্বজন মিলে অনুষ্ঠানটাকে সত্যি অনেক সুন্দরভাবে শেষ করেছে । রুমে এসে চেঞ্জ করার পর দেখলাম কেউ একজন চা দিয়ে গেলো আমাদের দুজনের জন্য । সত্যি আমার ভীষন চায়ের তেষ্টা পেয়েছিলো । মাথাটাও ব্যাথা করছিলো ভীষণ । চা পেয়ে মনটা ভালো হয়ে গেলো । চায়ে চুমুক দিয়ে বারবার আনমনা হয়ে যাচ্ছি দেখে মুকুল উঠে এসে পাশে বসলো । চায়ের কাপটা আমার হাত থেকে নিয়ে টেবিলে রেখে জড়িয়ে ধরে বললো -

গায়ে হলুদের দিন থেকে বুঝতে পারছি তোমার খুব মন খারাপ । কী হয়েছে আমাকে কী বলা যায়?

কিচ্ছু হয়নি । এমনি মন খারাপ ।

আচ্ছা বলবে না তাই তো? তার মানে তুমি আমাকে এখনো আপন ভাবতে পারোনি ।

সত্যি কিছু হয়নি আমার ।

ঠিক আছে বোলো না । তবে আমার মনেহয় কী জানো, হারাধন মামুকে পেলে বোধহয় তোমার মনটা ভালো হয়ে যেতো । কী করা যায় বলো তো?

হারাধন মামু কে? আমি তখন বেমালুম ভুলে গেছি হারাধন মামার কথা ।

হুম, তাই তো, হারাধন মামু কে? ব্যাটাকে খুঁজতে গিয়ে আমার পুরো তাঁতিবাজার চষে ফেলতে হয়েছে।

কথাটা শেষ করে মুকুল উঠে গিয়ে আলমারি খুলে ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে এসে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো -

ধরো, এটা তোমার ।

কী?

আহা, নিজে হাতে নিয়ে দেখোই না জিনিসটা পছন্দ হয় কিনা ।

মন খারাপ আর অনিচ্ছা সত্ত্বেও ব্যাগ থেকে বক্সটা বের করলাম । কাঠের ওপর চিকন সোনালি মেটালে ডিজাইন করা খুব সুন্দর একটা গয়নার বাক্স । আবারো গয়না ! শুনেছি বাসর রাতে নাকি বউ তার বরের কাছ থেকে বিশেষ কিছু একটা পায় উপহার হিসেবে । আজ আমি এতো গয়না পরেছি, আর কোনো গয়না আজকের দিনে অন্তত হজম হবে না আমার । বাক্সটা টেবিলের ওপর রাখলাম ।

মুকুল মন খারাপ করে বললো -

একবার খুলে দেখো তো কী আছে ।

পরে দেখি, এখন ভালো লাগছে না ।

আমি এতো শখ করে আনলাম আর তুমি একবার খুলেও দেখবে না !

আর পারলাম না কান্না চেপে রাখতে । মুকুলকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলালাম । নিজের মনের কষ্টের কথাগুলো বলে ফেললাম মুকুলকে -

দেখো আজ একদিনে আমার কত্তো গয়না হয়ে গেছে অথচ আমার একটুও খুশি লাগছে না । এই যে এই সীতাহারটা আমার গলায় যেন ফাঁসের মতো হয়ে আছে । মা তাঁর ভালোবাসাকে বিকিয়ে দিয়ে আমার জন্য গয়না তৈরি করিয়েছেন । কয়দিন ধরে আমার ভীষন কষ্ট হচ্ছে মুকুল। এখন আর গয়নার কোনো শখ নেই আমার ।

শোনো ফ্লোরা, সব মা-বাবাই চান তাদের ছেলেমেয়েরা ভালো থাকুক, খুশি থাকুক । মা হয়তো সেই কারণেই ওনার শখের জিনিসটার মায়া ছেড়ে তোমার জন্য গয়না করেছেন । এটা তুমি যখন মা হবে, তখন তোমার সন্তানের জন্য তুমিও করবে । এই বিষয়টা নিয়ে মন খারাপ করে আমাদের আজকের মুহূর্তটা নষ্ট করে দিও না ফ্লোরা ।

আমার কাছে মুকুলকে কেমন অচেনা লাগলো । এভাবে ও কথা বলতে পারলো আমার সাথে ? আমার আবেগের কোনো দাম নেই ওর কাছে ? শুধুমাত্র ঐ গয়নার বাক্সটা খুললাম না বলেই এতো রাগ ! আমার মা যে ওনার বাবার স্মৃতিটা হাতছাড়া করে ফেললেন আমার জন্য , এটার কোনো মূল্যই দিলো না মুকুল !

কী হলো খুলে দেখো কী আছে ভেতরে ।

দু'কথা শুনিয়ে দিতে গিয়েও থেমে গেলাম । চরম বিরক্তি নিয়ে গয়নার বাক্সটার মুখ খুলতেই আমি তাজ্জব বনে গেলাম । মা'র চুড়ি জোড়া আর চিকটা রাখা ভেতরে । আমি ভাষাহীন চোখে তাকালাম মুকুলের দিকে ।

কী করবো বলো ? আমার বউটা ক'দিন ধরে কষ্ট পাচ্ছে । বউ কষ্টে থাকলে আমি ভালো থাকি কী করে?

তুমি কী করে জানলে !

সেটা বিষয় না । শোনো ফ্লোরা যাকে ভালোবাসি, যে মানুষটা আজ থেকে আমার সবচাইতে আপন, তার আনন্দগুলো যেমন আমার, তার কষ্টগুলোও আমার । আমি শুনেছি এই চুড়িগুলো নানার স্মৃতি । মা হয়তো খুশি মনেই এর মায়া ছেড়ে দিয়েছেন কিন্তু তোমার মনের ভেতর তো সারাজীবন একটা অনুশোচনা, একটা কষ্ট থেকে যাবে । কী দরকার অনুশোচনা আর কষ্ট বয়ে বেড়ানোর ? চুড়িগুলো তুমি মা'র হাতে পরিয়ে দিও । তোমার মা তো আমারও মা ।

এই ঋণ শোধ করবো কী করে? আমার কাছে তো এতো টাকা নেই ।

হুম, শোধ তো করতেই হবে । সুদেআসলে ঠিক আদায় করে নেবো । তোমার ভালোবাসা দিয়ে ঋণ শোধ করে দেবে তো ফ্লোরা ?

আমি কৃতজ্ঞতায় আবারো জড়িয়ে ধরলাম মুকুলকে । চোখ দিয়ে আবারো পানি ঝরলো । এ অশ্রু আনন্দের । খুব অনুশোচনা হলো ওকে ক্ষনিকের ভুল বুঝলাম দেখে । সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জানালাম এমন একটা মানুষের সাথে আমার জীবনটা বেঁধে দিয়েছেন দেখে ।


(সমাপ্ত)
 

Users who are viewing this thread

Back
Top