রুবিদের বাড়িতে হৈচৈ পড়ে গিয়েছে। একে তো ঈদ, তার উপর ঈদের পাঁচ দিন পরই রুবির বিয়ে। বাবা মা ভাই বোন দুলাভায়ের পছন্দ করা ছেলের সাথেই বিয়ে হচ্ছে রুবির।অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ছে রুবি। দু'বোন এক ভায়ের মধ্যে ও ছোট। সেজন্যই সকলের অনেক আদরের ও।
এদিকে রুবির হবু বর পেশায় একজন সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার।বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান সে। হবু বরের নাম এরশাদ আলি তারেক। এদিকে যখন রুবির এনগেজমেন্ট হলো তখন থেকেই ঐ এরশাদ নামটা নিয়ে, রুবির বন্ধু বান্ধবরা ওকে ক্ষেপানো শুরু করেছে। রুবি অবশ্য এতে মোটেও রাগ করে না।বরং মজাই পায়।
রুবির বড় ভাই রাজশাহী থাকেন পরিবার নিয়ে।উনি পেশায় একজন ডাক্তার। একদিকে ঈদ অন্যদিকে আদরের বোনের বিয়ে বলেই ডাক্তার রেজা আগাম বেশ কদিনের ছুটি নিয়ে ঢাকায় নিজেদের বাসায় এসেছেন স্বপরিবারে।
প্রায় প্রতিদিনই দু'তিন বার করে ননদকে নিয়ে শপিংয়ে
বের হচ্ছেন রুবির ভাবী।
-দেখতো রুবি এই মেরুন বেনারসিটা কেমন? নারে রুবি এটা তো মেরুন না! কেমন যেন লাল, নাকি রে?
-ভাবী তোমার যেটা ভালো মনে হয় কিনে নাও। আমার একটা হলেই হবে।
রুবির ভাবী খেয়াল করে দেখছে রুবি ফুঁসফুঁস করে কাঁদছে। একটু পর পর হাত দিয়ে চোখের পানি মুছছে।
-এই কি হলো রে? কাঁদিস কেন? বিয়ে করবি না?
-এমনি কাঁদছি ভাবী, কিছু না।
-কি ভেবে কাঁদছিস, বলতো শুনি।বরতো দারুন হ্যান্ডসাম!
-আগামি বছর আর তোমাদের সাথে এভাবে শপিংয়ে আসতে পারবো না।ভাইয়া ঈদের সময় ঢাকা এসে বাড়িতে ঢুকেই রুবি কই রুবি কই বলে বাড়ি মাথায় তুলবে না।আমি দৌড়ে বাবুই বর্ষাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিতে পারবো না।
রুবি আর কথা বলতে পারছে না। কথাগুলো গলার কাছে দলার মত জমে যাচ্ছে। ওর ভাবী ওকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-আমিও তো তোর মতই আদরের মেয়ে আমার বাবা মায়ের। তো? আমি কি যাই না বাবার বাড়ি? আমি কি মা বাবা ভাইকে নিয়ে আনন্দ করি না? পাগলি কোথাকার! তুই আর বড় হবি না রুবি। নে নেতো জলদি শেষ করি আজকের কেনাকাটা। অনেক কাজ এখনও বাকি।
হঠাৎ ই দোকানের একজন কর্মচারী দু' গ্লাস লাচ্ছি ওদের ননদ ভাবীর দিকে এগিয়ে দেয়। প্রচন্ড গরম! ওরাও ঢকঢক করে লাচ্ছি চালান দেয় গলায়।
ফোনটা বেজেই যাচ্ছে, ল্যান্ড ফোনটা! পুরো বাড়ির একটা মানুষও ফোন রিসিভ করছে না।গুরুত্বপূর্ণ ফোনও তো হতে পারে। মনে মনেই বলেন রুবির মা। শেষে উনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ফোনটা রিসিভ করেন।
-আসসালামু আলাইকুম...।কে বলছেন?
-ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি তারেকের মামা বলছিলাম। রুবি মামনীর বাবা বা ভায়ের সাথে কথা বলতাম আমি।
-জ্বি আমি রুবির মা। কি হয়েছে ভাই?
-ও আপা আপনি! আপা তারেকের বাবা মানে আমার দুলাভায়ের ডেঙ্গু পজেটিভ এসেছে।
-ও আল্লাহ! বলেন কি ভাই? উনার শরীর এখন কেমন? প্রয়োজনে এই বিয়ে পিছিয়ে দেওয়া হবে ভাই।
-জ্বি আপা বিয়ের বিষয়েই কথা বলবো আপনাদের সাথে। আমি বরং আজ সন্ধ্যায় আসি।
-জ্বি ভাই আসেন।
রুবির মায়ের পেরেশানি শুরু হয়ে গিয়েছে। মনে মনেই বলছেন উনি, কিবা বলবে তারেকের মামা, কেনই বা আসছেন আমাদের বাসায়, বিয়েটা কি হবে নাকি...! ছিঃ আমি কেন এসব উল্টা পাল্টা ভাবছি!
সন্ধ্যায় রুবিদের বাসায় তারেকের মামা, ওর ছোট চাচাকে সাথে নিয়ে আসেন। বাসায় উপস্থিত আছে রুবির বাবা একমাত্র ভাই আর দুলাভাই। রুবি নিজ হাতে চা বানিয়ে ড্রইংরুমে নিয়ে আসে। ওদিকে রুবির মোবাইলটা বেজেই যাচ্ছে। ফোনটা আছে রুবির রুমে। রুবির যেতেও ইচ্ছা করছে না ফোন ধরতে। ওর এখন ইচ্ছে করছে দেওয়ালের ওপাশ থেকে মুরুব্বীদের কথা শুনতে। নাহ.. ফোনটা তো বেজেই যাচ্ছে।
-হ্যালো....!
-রুবি?
-জ্বি বলছিলাম। আপনি?
-তারেক!
রুবি বেজায় লজ্জা পায়।মনে মনেই বলছে রুবি, এতক্ষণ ধরে মানুষটা ফোন করছে আর আমি কিনা....! ছিহ... কি ভাবলো আমাকে? নিশ্চয় ভাবছে আমি অলস মেয়ে! ফোনটাও ধরতে পারি না।
-রুবি... মামা আর চাচা কি বলছেন, শুনেছেন কি আপনি? আপনার আর বিয়ের কথা বলতে গিয়েছেন।
-এটা তো আমরা জানি। তো নতুন করে কেন মামা চাচা বলতে এসেছেন? কোন সমস্যা হয়েছে কি?
-হ্যাঁ সমস্যাই বটে! আব্বুর ডেঙ্গু পজিটিভ এসেছে, শুনেছেন আপনি?
-বলেন কি? নাতো শুনিনি আমি।
-আব্বু এখন বাড়িতেই আছেন।রেস্টে থাকতে হবে। ডাক্তারের কথা মতই সব হচ্ছে।
-আচ্ছা আমার ভাইয়া তো ডাক্তার, উনাকে পাঠাবো আপনাদের বাড়িতে?
-আরে নাহ! আপনিই একটি বারের জন্য আসেন আমাদের বাড়ি। আব্বু আপনাকে দেখতে চান। উনি বলছেন, আমার একমাত্র বৌমা আমাকে দেখতে আসছে না কেন?
বৌমা কথাটা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে যায় রুবি।
-ওমা! আমি কেমন করে যাবো? বিয়ের আগে কেউ কেমন করে শ্বশুরবাড়ি যাই, বলেন তো?
-বিয়ের পরেতো আসে শ্বশুরবাড়ি, নাকি মিস রুবি?
-হু..!
কাজি সাহেব চলে এসেছেন রুবিদের বাড়িতে। সব কিছুই কেমন যেন হুড়মুড় করে ঘটে যাচ্ছে। ঈদের পাঁচদিন পর বিয়ে হবার কথা রুবি তারেকের।অথচ তারেকের বাবার অসুস্থতার জন্যই ঈদের দু'দিন আগে খুব নিকট কিছু আত্মীয়দের ডেকে বিয়ে হচ্ছে ওদের। অবশ্য এতে কেউই মন খারাপ করেননি। কারন রুবির বাবা বললেন,
-বিয়ে শাদী আল্লাহর হাতে।এখানে আমাদের কারো কিছুই করার নেই। আল্লাহ যা ভালো ভেবে রেখেছেন, তাই হবে।
তারেকের বাবা মানুষটা খুবই নরম মনের। ডেঙ্গুতে উনার মনোবল পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছে। উনি নিজে নিজেই বারবার বলছেন উনি বুঝি আর বাঁচবেন না। মারা যাবেন ডেঙ্গুতে! তাই মারা যাবার আগে বৌমাকে দেখতে চান, তাঁর একমাত্র ছেলের বৌকে।
দুপুরেই রুবির দু'জন বান্ধবী এসেছে। ওরা বাসায় বসেই রুবিকে বউ সাজিয়ে দিয়েছে। বিয়ের দিন সব মেয়েকেই সুন্দর দেখায়। রুবিকেও বেশ লাগছে দেখতে।
রুবির শ্বশুর ফোনে বলে দিয়েছেন রুবির বাবাকে,
-বেয়াই সাহেব, বিয়ের পর বৌমা যেন শুধু একটি বার আমাকে দেখতে আসে। আমি বৌমার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করবো। আপনারাও আসবেন। আমি অসুস্থ্য মানুষ, আমাকে একবার দেখে আপনারা আবারও তারেককে সাথে নিয়ে আপনাদের বাসায় ফিরে যাবেন। কারন নব বিবাহিত দম্পতির জুটি ভাঙ্গা ঠিক না বেয়াই সাহেব।
রুবি শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। অদ্ভুত ব্যাপার! রুবি একটুও কাঁদছে না। অথচ দু'দিন আগেও মেয়েটি সারাক্ষণই কাঁদতো। একটু সুযোগ পেলেই ভাই আর বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতো সে।
এই মুহূর্তে সবাই কি ভাবছে রুবি তা জানে না, কিন্তু রুবি নিজেই অনেক কিছু ভাবছে। ওর আজকের ভাবনার বিষয়গুলো ও কাউকে বলেনি। কাউকে না! কারন রুবি দেখেছে, খুব বেশি ভাবনা চিন্তা করে সব কাজ করা যায় না বা হয়ও না। আবার হুট করেই অনেক অনেক কিছুই হয়! যেমন হুট করেই আজ ওর বিয়ে হলো। অথচ কত প্ল্যান ছিলো বিয়ে নিয়ে। অবশ্য রুবি এখন মোটেও এসব নিয়ে ভাবছে না। কারন বিয়ের অনুষ্ঠান তো পরে হবেই।
রুবিরা রাত এগারোটার দিকে জামাই বাড়ি আসলো। অল্প কিছু নিকট আত্মীয় নতুন বৌয়ের অপেক্ষায় বসে আছে তারেকদের বাড়িতে। রুবিকে শাশুড়ি কপালে চুমু দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে দোয়া করছে।আর রুবি এদিকে ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে শ্বশুরকে দেখার জন্য। এরই মধ্যে তারেককে দু'বার বলাও হয়ে গেলো, আমাকে আব্বুর কাছে নিয়ে চলেন।
রাত প্রায় একটা বাজে। রুবির বাবা ভাই দুলাভাই বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
-ভাইয়া তোরা চলে যাচ্ছিস? বাবা ও বাবা তোমরা চলে যাচ্ছো?
রুবির চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। বিয়ের শাড়ির আঁচল দিয়েই চোখ মুছছে রুবি।
-এ কেমন কথা বলছিস রুবি? তুই তারেক তোরাতো আমাদের সাথেই বাড়ি যাবি। আবার কাঁদছিস কেন রে?
-ভাইয়া আমি তোমাদের সাথে যাবো না।
-মানে কি?
-ভাইয়া তুমিতো অনেক নাম করা ডাক্তার! আমার শ্বশুরকে একটু ভালো করে দেখোতো। উনার সমস্যা কি খুব বেশি?
-এইতো সেবা শুশ্রুষায় উনি সুস্থ হয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ।এই অসুখের জন্য প্যারাসিটেমল দেই আমরা। স্যালাইনও পুশ করি। রোগীকে বেশি বেশি তরল খেতে বলি।যেমন ডাবের পানি ফলের রস এই তো! বার বার ব্লাড টেষ্ট করে দেখে নিতে হয় প্ল্যাটিলেটের পরিমান। তোকে এত কিছু ভাবতে হবে না পাগলি। আমরা সকলেই আছিতো উনার পাশে। তুই চিন্তা করিস না।আমি উনার রিপোর্টগুলো দেখেছি।
রুবি, তারেকের সাথে বাড়ির মেইন গেইট পর্যন্ত একসাথে আসে বাবা ভাইদের বিদায় দিতে। এবার একটু জোরে পা চালিয়ে হঠাৎ ওর দুলাভায়ের কানের কাছে যেয়ে রুবি চুপিচুপি বলে,
-এই যে মশাই শুনছেন, আগামিকাল সকাল আটটার মধ্যেই আমার বেশ কিছু কাপড় চোপড় দিয়ে যাবেন এই বাসায়, বুঝেছেন?
রুবির দুলাভাই বাড়ি যেতে যেতে নিজের মনে মনেই বলেন, রুবিটাও হয়েছে ওর বড় আপুর মত। এমন ভালো মনের মেয়ে, বড় মনের সাহসী বুদ্ধিমতি মেয়ে আল্লাহ সবার ঘরে ঘরে দিন। ভালো থেকো রুবি। সুখি হও তোমরা।
(সমাপ্ত)
এদিকে রুবির হবু বর পেশায় একজন সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার।বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান সে। হবু বরের নাম এরশাদ আলি তারেক। এদিকে যখন রুবির এনগেজমেন্ট হলো তখন থেকেই ঐ এরশাদ নামটা নিয়ে, রুবির বন্ধু বান্ধবরা ওকে ক্ষেপানো শুরু করেছে। রুবি অবশ্য এতে মোটেও রাগ করে না।বরং মজাই পায়।
রুবির বড় ভাই রাজশাহী থাকেন পরিবার নিয়ে।উনি পেশায় একজন ডাক্তার। একদিকে ঈদ অন্যদিকে আদরের বোনের বিয়ে বলেই ডাক্তার রেজা আগাম বেশ কদিনের ছুটি নিয়ে ঢাকায় নিজেদের বাসায় এসেছেন স্বপরিবারে।
প্রায় প্রতিদিনই দু'তিন বার করে ননদকে নিয়ে শপিংয়ে
বের হচ্ছেন রুবির ভাবী।
-দেখতো রুবি এই মেরুন বেনারসিটা কেমন? নারে রুবি এটা তো মেরুন না! কেমন যেন লাল, নাকি রে?
-ভাবী তোমার যেটা ভালো মনে হয় কিনে নাও। আমার একটা হলেই হবে।
রুবির ভাবী খেয়াল করে দেখছে রুবি ফুঁসফুঁস করে কাঁদছে। একটু পর পর হাত দিয়ে চোখের পানি মুছছে।
-এই কি হলো রে? কাঁদিস কেন? বিয়ে করবি না?
-এমনি কাঁদছি ভাবী, কিছু না।
-কি ভেবে কাঁদছিস, বলতো শুনি।বরতো দারুন হ্যান্ডসাম!
-আগামি বছর আর তোমাদের সাথে এভাবে শপিংয়ে আসতে পারবো না।ভাইয়া ঈদের সময় ঢাকা এসে বাড়িতে ঢুকেই রুবি কই রুবি কই বলে বাড়ি মাথায় তুলবে না।আমি দৌড়ে বাবুই বর্ষাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিতে পারবো না।
রুবি আর কথা বলতে পারছে না। কথাগুলো গলার কাছে দলার মত জমে যাচ্ছে। ওর ভাবী ওকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-আমিও তো তোর মতই আদরের মেয়ে আমার বাবা মায়ের। তো? আমি কি যাই না বাবার বাড়ি? আমি কি মা বাবা ভাইকে নিয়ে আনন্দ করি না? পাগলি কোথাকার! তুই আর বড় হবি না রুবি। নে নেতো জলদি শেষ করি আজকের কেনাকাটা। অনেক কাজ এখনও বাকি।
হঠাৎ ই দোকানের একজন কর্মচারী দু' গ্লাস লাচ্ছি ওদের ননদ ভাবীর দিকে এগিয়ে দেয়। প্রচন্ড গরম! ওরাও ঢকঢক করে লাচ্ছি চালান দেয় গলায়।
ফোনটা বেজেই যাচ্ছে, ল্যান্ড ফোনটা! পুরো বাড়ির একটা মানুষও ফোন রিসিভ করছে না।গুরুত্বপূর্ণ ফোনও তো হতে পারে। মনে মনেই বলেন রুবির মা। শেষে উনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ফোনটা রিসিভ করেন।
-আসসালামু আলাইকুম...।কে বলছেন?
-ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি তারেকের মামা বলছিলাম। রুবি মামনীর বাবা বা ভায়ের সাথে কথা বলতাম আমি।
-জ্বি আমি রুবির মা। কি হয়েছে ভাই?
-ও আপা আপনি! আপা তারেকের বাবা মানে আমার দুলাভায়ের ডেঙ্গু পজেটিভ এসেছে।
-ও আল্লাহ! বলেন কি ভাই? উনার শরীর এখন কেমন? প্রয়োজনে এই বিয়ে পিছিয়ে দেওয়া হবে ভাই।
-জ্বি আপা বিয়ের বিষয়েই কথা বলবো আপনাদের সাথে। আমি বরং আজ সন্ধ্যায় আসি।
-জ্বি ভাই আসেন।
রুবির মায়ের পেরেশানি শুরু হয়ে গিয়েছে। মনে মনেই বলছেন উনি, কিবা বলবে তারেকের মামা, কেনই বা আসছেন আমাদের বাসায়, বিয়েটা কি হবে নাকি...! ছিঃ আমি কেন এসব উল্টা পাল্টা ভাবছি!
সন্ধ্যায় রুবিদের বাসায় তারেকের মামা, ওর ছোট চাচাকে সাথে নিয়ে আসেন। বাসায় উপস্থিত আছে রুবির বাবা একমাত্র ভাই আর দুলাভাই। রুবি নিজ হাতে চা বানিয়ে ড্রইংরুমে নিয়ে আসে। ওদিকে রুবির মোবাইলটা বেজেই যাচ্ছে। ফোনটা আছে রুবির রুমে। রুবির যেতেও ইচ্ছা করছে না ফোন ধরতে। ওর এখন ইচ্ছে করছে দেওয়ালের ওপাশ থেকে মুরুব্বীদের কথা শুনতে। নাহ.. ফোনটা তো বেজেই যাচ্ছে।
-হ্যালো....!
-রুবি?
-জ্বি বলছিলাম। আপনি?
-তারেক!
রুবি বেজায় লজ্জা পায়।মনে মনেই বলছে রুবি, এতক্ষণ ধরে মানুষটা ফোন করছে আর আমি কিনা....! ছিহ... কি ভাবলো আমাকে? নিশ্চয় ভাবছে আমি অলস মেয়ে! ফোনটাও ধরতে পারি না।
-রুবি... মামা আর চাচা কি বলছেন, শুনেছেন কি আপনি? আপনার আর বিয়ের কথা বলতে গিয়েছেন।
-এটা তো আমরা জানি। তো নতুন করে কেন মামা চাচা বলতে এসেছেন? কোন সমস্যা হয়েছে কি?
-হ্যাঁ সমস্যাই বটে! আব্বুর ডেঙ্গু পজিটিভ এসেছে, শুনেছেন আপনি?
-বলেন কি? নাতো শুনিনি আমি।
-আব্বু এখন বাড়িতেই আছেন।রেস্টে থাকতে হবে। ডাক্তারের কথা মতই সব হচ্ছে।
-আচ্ছা আমার ভাইয়া তো ডাক্তার, উনাকে পাঠাবো আপনাদের বাড়িতে?
-আরে নাহ! আপনিই একটি বারের জন্য আসেন আমাদের বাড়ি। আব্বু আপনাকে দেখতে চান। উনি বলছেন, আমার একমাত্র বৌমা আমাকে দেখতে আসছে না কেন?
বৌমা কথাটা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে যায় রুবি।
-ওমা! আমি কেমন করে যাবো? বিয়ের আগে কেউ কেমন করে শ্বশুরবাড়ি যাই, বলেন তো?
-বিয়ের পরেতো আসে শ্বশুরবাড়ি, নাকি মিস রুবি?
-হু..!
কাজি সাহেব চলে এসেছেন রুবিদের বাড়িতে। সব কিছুই কেমন যেন হুড়মুড় করে ঘটে যাচ্ছে। ঈদের পাঁচদিন পর বিয়ে হবার কথা রুবি তারেকের।অথচ তারেকের বাবার অসুস্থতার জন্যই ঈদের দু'দিন আগে খুব নিকট কিছু আত্মীয়দের ডেকে বিয়ে হচ্ছে ওদের। অবশ্য এতে কেউই মন খারাপ করেননি। কারন রুবির বাবা বললেন,
-বিয়ে শাদী আল্লাহর হাতে।এখানে আমাদের কারো কিছুই করার নেই। আল্লাহ যা ভালো ভেবে রেখেছেন, তাই হবে।
তারেকের বাবা মানুষটা খুবই নরম মনের। ডেঙ্গুতে উনার মনোবল পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছে। উনি নিজে নিজেই বারবার বলছেন উনি বুঝি আর বাঁচবেন না। মারা যাবেন ডেঙ্গুতে! তাই মারা যাবার আগে বৌমাকে দেখতে চান, তাঁর একমাত্র ছেলের বৌকে।
দুপুরেই রুবির দু'জন বান্ধবী এসেছে। ওরা বাসায় বসেই রুবিকে বউ সাজিয়ে দিয়েছে। বিয়ের দিন সব মেয়েকেই সুন্দর দেখায়। রুবিকেও বেশ লাগছে দেখতে।
রুবির শ্বশুর ফোনে বলে দিয়েছেন রুবির বাবাকে,
-বেয়াই সাহেব, বিয়ের পর বৌমা যেন শুধু একটি বার আমাকে দেখতে আসে। আমি বৌমার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করবো। আপনারাও আসবেন। আমি অসুস্থ্য মানুষ, আমাকে একবার দেখে আপনারা আবারও তারেককে সাথে নিয়ে আপনাদের বাসায় ফিরে যাবেন। কারন নব বিবাহিত দম্পতির জুটি ভাঙ্গা ঠিক না বেয়াই সাহেব।
রুবি শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। অদ্ভুত ব্যাপার! রুবি একটুও কাঁদছে না। অথচ দু'দিন আগেও মেয়েটি সারাক্ষণই কাঁদতো। একটু সুযোগ পেলেই ভাই আর বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতো সে।
এই মুহূর্তে সবাই কি ভাবছে রুবি তা জানে না, কিন্তু রুবি নিজেই অনেক কিছু ভাবছে। ওর আজকের ভাবনার বিষয়গুলো ও কাউকে বলেনি। কাউকে না! কারন রুবি দেখেছে, খুব বেশি ভাবনা চিন্তা করে সব কাজ করা যায় না বা হয়ও না। আবার হুট করেই অনেক অনেক কিছুই হয়! যেমন হুট করেই আজ ওর বিয়ে হলো। অথচ কত প্ল্যান ছিলো বিয়ে নিয়ে। অবশ্য রুবি এখন মোটেও এসব নিয়ে ভাবছে না। কারন বিয়ের অনুষ্ঠান তো পরে হবেই।
রুবিরা রাত এগারোটার দিকে জামাই বাড়ি আসলো। অল্প কিছু নিকট আত্মীয় নতুন বৌয়ের অপেক্ষায় বসে আছে তারেকদের বাড়িতে। রুবিকে শাশুড়ি কপালে চুমু দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে দোয়া করছে।আর রুবি এদিকে ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে শ্বশুরকে দেখার জন্য। এরই মধ্যে তারেককে দু'বার বলাও হয়ে গেলো, আমাকে আব্বুর কাছে নিয়ে চলেন।
রাত প্রায় একটা বাজে। রুবির বাবা ভাই দুলাভাই বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
-ভাইয়া তোরা চলে যাচ্ছিস? বাবা ও বাবা তোমরা চলে যাচ্ছো?
রুবির চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। বিয়ের শাড়ির আঁচল দিয়েই চোখ মুছছে রুবি।
-এ কেমন কথা বলছিস রুবি? তুই তারেক তোরাতো আমাদের সাথেই বাড়ি যাবি। আবার কাঁদছিস কেন রে?
-ভাইয়া আমি তোমাদের সাথে যাবো না।
-মানে কি?
-ভাইয়া তুমিতো অনেক নাম করা ডাক্তার! আমার শ্বশুরকে একটু ভালো করে দেখোতো। উনার সমস্যা কি খুব বেশি?
-এইতো সেবা শুশ্রুষায় উনি সুস্থ হয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ।এই অসুখের জন্য প্যারাসিটেমল দেই আমরা। স্যালাইনও পুশ করি। রোগীকে বেশি বেশি তরল খেতে বলি।যেমন ডাবের পানি ফলের রস এই তো! বার বার ব্লাড টেষ্ট করে দেখে নিতে হয় প্ল্যাটিলেটের পরিমান। তোকে এত কিছু ভাবতে হবে না পাগলি। আমরা সকলেই আছিতো উনার পাশে। তুই চিন্তা করিস না।আমি উনার রিপোর্টগুলো দেখেছি।
রুবি, তারেকের সাথে বাড়ির মেইন গেইট পর্যন্ত একসাথে আসে বাবা ভাইদের বিদায় দিতে। এবার একটু জোরে পা চালিয়ে হঠাৎ ওর দুলাভায়ের কানের কাছে যেয়ে রুবি চুপিচুপি বলে,
-এই যে মশাই শুনছেন, আগামিকাল সকাল আটটার মধ্যেই আমার বেশ কিছু কাপড় চোপড় দিয়ে যাবেন এই বাসায়, বুঝেছেন?
রুবির দুলাভাই বাড়ি যেতে যেতে নিজের মনে মনেই বলেন, রুবিটাও হয়েছে ওর বড় আপুর মত। এমন ভালো মনের মেয়ে, বড় মনের সাহসী বুদ্ধিমতি মেয়ে আল্লাহ সবার ঘরে ঘরে দিন। ভালো থেকো রুবি। সুখি হও তোমরা।
(সমাপ্ত)