পর্ব-১
আমি কাঁপছি থরথর করে। পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে যেন। আমার সামনের চেয়ারে ষাট, বাষট্টি বছরের যিনি বসে আছেন, প্রায় ছয় বছর পর উনাকে এভাবে দেখতে আমি মানসিকভাবে তৈরী ছিলাম না মোটেও! এ জীবনে আর কোনদিন এই মানুষটার মুখোমুখি হবার কোন রুচিই আমার ছিলো না ! উনার কপালেও মনে হচ্ছে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। বড্ড অস্বস্তিকর একটা পরিবেশ।
-মিতু, উনি আমার বাবা।
আবরারের কথাতে আমার পাথর হওয়া শরীরটা নড়ে উঠলো। আমি সালাম দিতে পারলাম না, ঘৃনায় !
আবরার সরল হাসি মুখে নিয়ে আবার বললো,
-মিতু, উনি আমার বাবা।
আমি ঠোটের কোনে বিদ্রুপ আর ঘৃনা মেশানো একটু হাসি দিলাম।
-আবরার, তোমরা বসো। আমার একটা জরুরী কল এসেছে। স্যরি, এক্ষুনি উঠতে হচ্ছে !
উনি উঠে দাড়ালেন, বেরিয়ে যেতে পারলেই যেন বেঁচে যান। কোনদিকে না তাকিয়ে রওনা দিলেন সামনের দিকে।
আমি বসলাম। আবরার তার বাবার ব্যবহারে কিছুটা রহস্যের মধ্যে পড়ে গেল বোধহয়।
-আসলে বাবা অনেকদিন পর দেশে এসেছেন তো, তাই সবাই খুব ব্যস্ত রাখেন। মিতু, কিছু মনে করোনা। আমরা বরং খাবারের অর্ডার দেই?
-আবরার, আমার শরীরটা ভালো লাগছেনা। কিছু খেতে ইচ্ছে নেই। শুধু একটু পানি।
সামনে রাখা পানির বোতলের মুখ খুলে আবরার ঝকঝকে গ্লাসে পানি ঢালছে। স্বচ্ছ, ঠান্ডা পানি। কিন্তু আমি সেই পানির ভেতর অসংখ্য নোংরা ছোট ছোট পোকা কিলবিল করতে দেখছি। আমার গা গুলিয়ে উঠছে। গ্লাস হাতে নিয়েও মুখের কাছে নিতে পারছিনা !
-তোমার কি বেশী খারাপ লাগছে? বাবার ব্যবহারে কষ্ট পেলে, মিতু?
-না, তা কেন? বাইরে এতো গরম আর ট্র্যাফিক ছিল, রাস্তা থেকেই খারাপ লাগা শুরু। আমি আজ উঠবো।
-কি বলো ! আজ আমাদের অনেক কথা, অনেক কাজ আছে। বিয়ের তো মাত্র মাসখানেক বাকী ! ছুটির দিন ছাড়া আমরা তো সময়ই পাইনা ! কত প্ল্যান করতে হবে, ভুলে গেলে?
-প্লিজ, আমি উঠবো। বাসায় যাবো, আবরার।
অবাক দৃষ্টিতে এক অসহায় কিশোরের মত মুখ করে আবরার তাকিয়ে আছে। সে দৃষ্টি উপেক্ষা করা গতকালও আমার পক্ষে সম্ভব ছিলোনা হয়তো, কিন্তু আজ আমি নিরুপায়। উপেক্ষা, অপেক্ষা কোনকিছুই আজ আমাকে টলাতে পারবেনা।
বাসায় ফিরতে রাত আট'টা বেজে গেল।নিজের ঘরে ঢোকার আগে একটা প্যারাসিটামল আর দুটো সিডেটিভ খেয়ে নিলাম।ঘুম আসবে না জানি। ঘরে ঢোকার মুখে মাকে বললাম,
-মা, আমি খেয়ে এসেছি। আমাকে খেতে ডেকোনা।
-কী হয়েছে, মিতু? আজ তো আবরারের বাবার সাথে দেখা করার কথা ছিল। দেখা হয়েছে? কোন সমস্যা? তোর মুখটা বড্ড শুকনো লাগছে যে !
-মা, কথা বলতে ভালো লাগছেনা। আমি ঘুমাবো।
ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। ফোন বন্ধ করে বিছানায় যখন নিজেকে সমর্পন করলাম তখন হাজার স্মৃতির সাথে কিছু জঘন্য নোংরা স্মৃতি আমার চোখের সামনে একটার পর একটা ভাসতে লাগলো। কতকাল আমি চোখের জলে ভাসিনি! গত এক বছর আবরার আমার চোখে কেবল স্বপ্ন এঁকে গেছে ! সেইসব স্বপ্ন আমি আজ আমার চোখের জলে ভাসাবো ! পৃথিবীর কেউ আমাকে আজ ডেকো না। কেউ কোনদিন জানতে চেয়ো না, আবরারকে আমি কোনদিন, কোনকালে ভালবেসেছিলাম কিনা ! দুজনে মিলে একটা সুন্দর ছোট্ট নীড়ের কল্পনা করেছিলাম কিনা !
চাকরীটা আমার খুব দরকার ছিল। মাষ্টার্স পাশ করতেই একটা চাকরীর জন্য আমি হন্যে হতে থাকলাম। বড় অভাবের সংসার আমাদের। বাবার স্বল্প বেতনের চাকরীর পয়সায় চার'টা ভাইবোনের পড়ালেখা চালানো খুব মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। ছোটভাই দুটো ইউনিভার্সিটিতে ঢোকার পর থেকেই টিউশনি করে নিজের খরচটা চালিয়ে নেয়। বাবা-মা মফস্বলে আমাদের টিনশেড বাড়িতে ছোট বোনটাকে নিয়ে থাকেন। বোনটা তখন কলেজ ফার্ষ্ট ইয়ার। আমরা সবগুলো ভাইবোনই লেখাপড়ায় ভাল করতাম। লেখাপড়া, বাবা-মা, ভাইবোন এর বাইরে আমার বিশেষ কোন জগৎ ছিলোনা। এখন দরকার শুধু একটা চাকরী। চাকরীটা হলে বাবা-মাকে বলবো, ছোটবোনের ফাইনাল পরীক্ষা শেষে ঢাকা চলে আসতে। সবাই মিলে দু'কামরার একটা বাসা ভাড়া নিয়ে জড়াজড়ি করে থাকবো। সুখে-দুঃখে একসাথে বাঁচবো।
খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনটা দেখে চলে এলাম অফিসে। একটা প্রাইভেট ফার্ম। অনেকগুলো চাকরীর ইন্টারভিউ দিয়ে ব্যর্থ হওয়াতে মনে তেমন আশা ছিলনা।বস্ নিজের রুমে ডেকে আমার সাথে বেশ কিছুক্ষন কথা বললেন। আমার পরিবার, আমাদের দৈন্য দশা বোধহয় উনার মনের কোনে কিছুটা মায়ার উদ্রেক করেছিল, তাই চাকরীটা হয়ে গেল। বেতন একেবারে কম না।মেয়ে বলতে এখানে আমি একজনই।
নতুন জীবন শুরু হলো।লালমাটিয়ায় একটা মেয়েদের হোষ্টেলে থাকি।বনানীতে অফিস করি। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর আমি।আমার কাজ, আমার একাগ্রতা আমাকে অল্প সময়ে সবার নজর কাড়তে সাহায্য করে। কারো কারো বাঁকা নজরও উপেক্ষা করতে হয় আমাকে।বস্ আফসার চৌধুরী আমার কাছে ছিলেন পিতৃসম। উনার উদার ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হতাম। এতো বড় মাপের একজন মানুষের মনের কোথাও এতটুকু অহংকার নেই। অফিস করে রুমে এসে ফোনে মায়ের কাছে কত গল্প করতাম! সেই সাথে চলছিল বি.সি.এস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি। বাবার স্বপ্ন আমি ম্যাজিস্ট্রেট হবো। সেই স্বপ্ন পূরন করার জন্য আমিও আপ্রান পড়ালেখা করি। আমার বাবা ! দুটো পয়সা বাঁচানোর জন্য দিনের পর দিন কতটা পথ হেটে অফিস করতেন ! কতদিন মাকে দেখেছি চুপিচুপি ছেড়া শাড়ীর আঁচলটা সেলাই করে নিতে !
অফিসে কাজের চাপে মাঝেমাঝেই ফিরতে দেরী হয়ে যেত। এসব কিছুই স্বাভাবিক জীবনের ছকে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। তখনও চাকরীর বয়স আটমাস হয়নি।এক বিকেলে বস্ নিজে আমার ডেস্কে এসে বললেল,
-মেহজাবীন, তুমি কাজ শেষ করে একটু দেখা করো।
-স্যার, আমার কাজ শেষ হতে তো সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
-আমি আছি। আমার কাজ শেষ হতে রাত নয়টা বাজবে।
কাজ শেষ করতে সাতটা বাজলো। অফিস প্রায় খালি। আমি স্যারের সঙ্গে দেখা করে রুমে ফিরবো তাড়াতাড়ি। বাইরে দমকা বাতাস শুরু হয়েছে।
-স্যার, আমাকে ডেকেছিলেন?
-ওহ্ মেহজাবীন আসো। বসো।
আমার স্যারের সামনে বসতে বড্ড অস্বস্তি হচ্ছিল।
-কি তাড়া আছে?
-জী না, স্যার।
-তা চাকরী কেমন লাগছে?
-ভালো, স্যার।
-কোন সমস্যা নেই তো?
-জী না।
-তোমার সাথে কোনদিন পার্সোনাল আলাপই হলোনা। এতো ব্যস্ত থাকতে হয় !
-বলুন স্যার।
-তুমি কি জানো, তুমি অতি চমৎকার একটা মেয়ে?
আমি চুপ করে মাথা নীচু করে বসে আছি। উনি আমার টুকটাক খোঁজ খবর জানতে চাইলেন। আমি ছোট ছোট উত্তর দিচ্ছি।
-মানুষ হিসেবে আমাকে তোমার কেমন লাগে?
-ভালো এবং পরিপূর্ন মানুষ লাগে।
-হা হা হা ! পরিপূর্ন কথাটা আমার জন্য প্রযোজ্য নয়। আমি আসলে শূন্য একজন মানুষ। ঘর-সংসারের কোন বন্ধন আমার নেই, কেউ আমার জন্য কোথাও অপেক্ষা করে নেই। আমি রিক্ত একজন। তাই কাজের মধ্যে ডুবে থাকি, ভুলে থাকি নিজেকে।
-জানতাম না, স্যার।
-তোমার বয়সী আমার একটা ছেলে আছে। ওর মায়ের সাথে এই শহরেই থাকে। মাঝেমাঝে আমাদের দেখা হয়। ছেলেটা এক সময় আমার বুকে ছাড়া ঘুমাতো না। দশ বছর হলো ওর মায়ের সাথে আমার সেপারেশান। আমি এই শহরের লক্ষ মানুষের মাঝে সম্পূর্ন একা একজন।
-খুব কষ্টের ব্যাপার !
-হুম, কষ্টের তো বটেই !
-তুমি আমার সাথে মাঝেমাঝে একটু সময় দেবে, মেহজাবীন? লাইক আ ফ্রেন্ড।
বসের জন্য ফেরার পথে বুকটা হু হু করে উঠলো। ধন-সম্পদ মানুষকে এতটুকুও সুখী করতে পারেনা ! চাকচিক্যের আড়ালে কি নিঃস্ব একজন মানুষ ! আমার মাঝে নিশ্চয় উনি উনার সন্তানের ছায়া খুঁজেছেন।
এরপর মাঝেমধ্যে বস্ আমাকে ডাকতেন। দু'চারটা কথা বলতেন, আমি শুনতাম। সেদিনও বস বললেন,
-কিছু কাজ জমা আছে, মেহজাবীন তুমি একটু হেল্প করো আজ।
-জী স্যার।
আমি বসের রুমে ঢুকলাম। অলরেডী সন্ধ্যা তখন। সবাই চলে গেছে। যাবার সময় কেউ কেউ অর্থবোধক দৃষ্টিতে আমাকে দেখে গেছে।মুনির নামের পিয়নটা কেবল গেটের কাছে ঝিমুচ্ছে।
-মেহজাবীন, কাজ শুরু করার আগে একটু কফি খায়, কেমন? তুমি বসো, আমি কফি বানাবো। বসের রুমের সাথেই ছোট্ট আরেকটা রুম। হাল্কা বেগুনী রঙের স্বল্প আলো জ্বলছে সেখানে।
-তুমি এখানে আসো।আমি কফিটা এই রুমে খেতে পছন্দ করি।
আমার কেন জানি ভালো লাগছেনা। তবুও গেলাম কেন জানিনা। সাদা ধবধবে বিছানার পাশে দুটো চেয়ার পাতা। সামনে ছোট একটা টেবিলে দু'মগ কফি।
-বসো। কফি শেষ করো। কাজ শেষে তোমাকে পৌছে দেবো। কাল তো শুক্রবার। রেষ্ট করে নিও।
কফি শেষ করতেই আমার মাথাটায় ঝিমঝিম শুরু হলো। হয়তো সারাদিনের ক্লান্তিতে এমন লাগছে।উঠে দাড়াতেই পড়ে যাবার মত অবস্থা। বস্ আমার হাত ধরে বসিয়ে দিলেন।
-তোমার কি খারাপ লাগছে?
-স্যার, আমি চলে যাবো। আমার ভালো লাগছেনা।
-ভালো লাগবে। এই যে এখানে, এই বিছানাতে একটু রেষ্ট নাও।
-স্যার, আমি যেতে চাই ! প্লিজ ! আমি শনিবারে সকালে আপনার কাজগুলো করে দেবো।
আমার চোখে দেখা সেই ভালো মানুষরুপী মানুষের মুখে সেদিন আমি হায়েনার রূপ দেখেছি! কি নির্মম নোংরাভাবে আমার জীবনের গতিটা থমকে গিয়েছিল সেই কলুষিত থাবায়। পশুর শক্তির কাছে আমি, আমার শরীর, আমার অনুনয়, চোখের পানি সব পরাজিত হলো ! আমি রেইপড হলাম, সেই বেগুনী আলোর নীচে ! পৃথিবীর নোংরা মানচিত্র উন্মোচিত হলো আমার সামনে! কি ঘৃনা ! কি ব্যথা !! কেউ জানলো না। কাউকে জানতে দিইনি কোনদিন !
আর কোনদিন ঐ অফিসে যাইনি। শুধু কেঁদেছি আর কেঁদেছি। কতদিন, কতকাল জানিনা। বন্ধু শর্মীর ছায়া আমাকে আগলে রেখেছে সেই দুঃসময়ে। নতুন করে হাটতে শেখালো সে আমাকে। বাঁচতে শেখালো নতুন করে।
চলবে..
আমি কাঁপছি থরথর করে। পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে যেন। আমার সামনের চেয়ারে ষাট, বাষট্টি বছরের যিনি বসে আছেন, প্রায় ছয় বছর পর উনাকে এভাবে দেখতে আমি মানসিকভাবে তৈরী ছিলাম না মোটেও! এ জীবনে আর কোনদিন এই মানুষটার মুখোমুখি হবার কোন রুচিই আমার ছিলো না ! উনার কপালেও মনে হচ্ছে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। বড্ড অস্বস্তিকর একটা পরিবেশ।
-মিতু, উনি আমার বাবা।
আবরারের কথাতে আমার পাথর হওয়া শরীরটা নড়ে উঠলো। আমি সালাম দিতে পারলাম না, ঘৃনায় !
আবরার সরল হাসি মুখে নিয়ে আবার বললো,
-মিতু, উনি আমার বাবা।
আমি ঠোটের কোনে বিদ্রুপ আর ঘৃনা মেশানো একটু হাসি দিলাম।
-আবরার, তোমরা বসো। আমার একটা জরুরী কল এসেছে। স্যরি, এক্ষুনি উঠতে হচ্ছে !
উনি উঠে দাড়ালেন, বেরিয়ে যেতে পারলেই যেন বেঁচে যান। কোনদিকে না তাকিয়ে রওনা দিলেন সামনের দিকে।
আমি বসলাম। আবরার তার বাবার ব্যবহারে কিছুটা রহস্যের মধ্যে পড়ে গেল বোধহয়।
-আসলে বাবা অনেকদিন পর দেশে এসেছেন তো, তাই সবাই খুব ব্যস্ত রাখেন। মিতু, কিছু মনে করোনা। আমরা বরং খাবারের অর্ডার দেই?
-আবরার, আমার শরীরটা ভালো লাগছেনা। কিছু খেতে ইচ্ছে নেই। শুধু একটু পানি।
সামনে রাখা পানির বোতলের মুখ খুলে আবরার ঝকঝকে গ্লাসে পানি ঢালছে। স্বচ্ছ, ঠান্ডা পানি। কিন্তু আমি সেই পানির ভেতর অসংখ্য নোংরা ছোট ছোট পোকা কিলবিল করতে দেখছি। আমার গা গুলিয়ে উঠছে। গ্লাস হাতে নিয়েও মুখের কাছে নিতে পারছিনা !
-তোমার কি বেশী খারাপ লাগছে? বাবার ব্যবহারে কষ্ট পেলে, মিতু?
-না, তা কেন? বাইরে এতো গরম আর ট্র্যাফিক ছিল, রাস্তা থেকেই খারাপ লাগা শুরু। আমি আজ উঠবো।
-কি বলো ! আজ আমাদের অনেক কথা, অনেক কাজ আছে। বিয়ের তো মাত্র মাসখানেক বাকী ! ছুটির দিন ছাড়া আমরা তো সময়ই পাইনা ! কত প্ল্যান করতে হবে, ভুলে গেলে?
-প্লিজ, আমি উঠবো। বাসায় যাবো, আবরার।
অবাক দৃষ্টিতে এক অসহায় কিশোরের মত মুখ করে আবরার তাকিয়ে আছে। সে দৃষ্টি উপেক্ষা করা গতকালও আমার পক্ষে সম্ভব ছিলোনা হয়তো, কিন্তু আজ আমি নিরুপায়। উপেক্ষা, অপেক্ষা কোনকিছুই আজ আমাকে টলাতে পারবেনা।
বাসায় ফিরতে রাত আট'টা বেজে গেল।নিজের ঘরে ঢোকার আগে একটা প্যারাসিটামল আর দুটো সিডেটিভ খেয়ে নিলাম।ঘুম আসবে না জানি। ঘরে ঢোকার মুখে মাকে বললাম,
-মা, আমি খেয়ে এসেছি। আমাকে খেতে ডেকোনা।
-কী হয়েছে, মিতু? আজ তো আবরারের বাবার সাথে দেখা করার কথা ছিল। দেখা হয়েছে? কোন সমস্যা? তোর মুখটা বড্ড শুকনো লাগছে যে !
-মা, কথা বলতে ভালো লাগছেনা। আমি ঘুমাবো।
ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। ফোন বন্ধ করে বিছানায় যখন নিজেকে সমর্পন করলাম তখন হাজার স্মৃতির সাথে কিছু জঘন্য নোংরা স্মৃতি আমার চোখের সামনে একটার পর একটা ভাসতে লাগলো। কতকাল আমি চোখের জলে ভাসিনি! গত এক বছর আবরার আমার চোখে কেবল স্বপ্ন এঁকে গেছে ! সেইসব স্বপ্ন আমি আজ আমার চোখের জলে ভাসাবো ! পৃথিবীর কেউ আমাকে আজ ডেকো না। কেউ কোনদিন জানতে চেয়ো না, আবরারকে আমি কোনদিন, কোনকালে ভালবেসেছিলাম কিনা ! দুজনে মিলে একটা সুন্দর ছোট্ট নীড়ের কল্পনা করেছিলাম কিনা !
চাকরীটা আমার খুব দরকার ছিল। মাষ্টার্স পাশ করতেই একটা চাকরীর জন্য আমি হন্যে হতে থাকলাম। বড় অভাবের সংসার আমাদের। বাবার স্বল্প বেতনের চাকরীর পয়সায় চার'টা ভাইবোনের পড়ালেখা চালানো খুব মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। ছোটভাই দুটো ইউনিভার্সিটিতে ঢোকার পর থেকেই টিউশনি করে নিজের খরচটা চালিয়ে নেয়। বাবা-মা মফস্বলে আমাদের টিনশেড বাড়িতে ছোট বোনটাকে নিয়ে থাকেন। বোনটা তখন কলেজ ফার্ষ্ট ইয়ার। আমরা সবগুলো ভাইবোনই লেখাপড়ায় ভাল করতাম। লেখাপড়া, বাবা-মা, ভাইবোন এর বাইরে আমার বিশেষ কোন জগৎ ছিলোনা। এখন দরকার শুধু একটা চাকরী। চাকরীটা হলে বাবা-মাকে বলবো, ছোটবোনের ফাইনাল পরীক্ষা শেষে ঢাকা চলে আসতে। সবাই মিলে দু'কামরার একটা বাসা ভাড়া নিয়ে জড়াজড়ি করে থাকবো। সুখে-দুঃখে একসাথে বাঁচবো।
খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনটা দেখে চলে এলাম অফিসে। একটা প্রাইভেট ফার্ম। অনেকগুলো চাকরীর ইন্টারভিউ দিয়ে ব্যর্থ হওয়াতে মনে তেমন আশা ছিলনা।বস্ নিজের রুমে ডেকে আমার সাথে বেশ কিছুক্ষন কথা বললেন। আমার পরিবার, আমাদের দৈন্য দশা বোধহয় উনার মনের কোনে কিছুটা মায়ার উদ্রেক করেছিল, তাই চাকরীটা হয়ে গেল। বেতন একেবারে কম না।মেয়ে বলতে এখানে আমি একজনই।
নতুন জীবন শুরু হলো।লালমাটিয়ায় একটা মেয়েদের হোষ্টেলে থাকি।বনানীতে অফিস করি। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর আমি।আমার কাজ, আমার একাগ্রতা আমাকে অল্প সময়ে সবার নজর কাড়তে সাহায্য করে। কারো কারো বাঁকা নজরও উপেক্ষা করতে হয় আমাকে।বস্ আফসার চৌধুরী আমার কাছে ছিলেন পিতৃসম। উনার উদার ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হতাম। এতো বড় মাপের একজন মানুষের মনের কোথাও এতটুকু অহংকার নেই। অফিস করে রুমে এসে ফোনে মায়ের কাছে কত গল্প করতাম! সেই সাথে চলছিল বি.সি.এস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি। বাবার স্বপ্ন আমি ম্যাজিস্ট্রেট হবো। সেই স্বপ্ন পূরন করার জন্য আমিও আপ্রান পড়ালেখা করি। আমার বাবা ! দুটো পয়সা বাঁচানোর জন্য দিনের পর দিন কতটা পথ হেটে অফিস করতেন ! কতদিন মাকে দেখেছি চুপিচুপি ছেড়া শাড়ীর আঁচলটা সেলাই করে নিতে !
অফিসে কাজের চাপে মাঝেমাঝেই ফিরতে দেরী হয়ে যেত। এসব কিছুই স্বাভাবিক জীবনের ছকে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। তখনও চাকরীর বয়স আটমাস হয়নি।এক বিকেলে বস্ নিজে আমার ডেস্কে এসে বললেল,
-মেহজাবীন, তুমি কাজ শেষ করে একটু দেখা করো।
-স্যার, আমার কাজ শেষ হতে তো সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
-আমি আছি। আমার কাজ শেষ হতে রাত নয়টা বাজবে।
কাজ শেষ করতে সাতটা বাজলো। অফিস প্রায় খালি। আমি স্যারের সঙ্গে দেখা করে রুমে ফিরবো তাড়াতাড়ি। বাইরে দমকা বাতাস শুরু হয়েছে।
-স্যার, আমাকে ডেকেছিলেন?
-ওহ্ মেহজাবীন আসো। বসো।
আমার স্যারের সামনে বসতে বড্ড অস্বস্তি হচ্ছিল।
-কি তাড়া আছে?
-জী না, স্যার।
-তা চাকরী কেমন লাগছে?
-ভালো, স্যার।
-কোন সমস্যা নেই তো?
-জী না।
-তোমার সাথে কোনদিন পার্সোনাল আলাপই হলোনা। এতো ব্যস্ত থাকতে হয় !
-বলুন স্যার।
-তুমি কি জানো, তুমি অতি চমৎকার একটা মেয়ে?
আমি চুপ করে মাথা নীচু করে বসে আছি। উনি আমার টুকটাক খোঁজ খবর জানতে চাইলেন। আমি ছোট ছোট উত্তর দিচ্ছি।
-মানুষ হিসেবে আমাকে তোমার কেমন লাগে?
-ভালো এবং পরিপূর্ন মানুষ লাগে।
-হা হা হা ! পরিপূর্ন কথাটা আমার জন্য প্রযোজ্য নয়। আমি আসলে শূন্য একজন মানুষ। ঘর-সংসারের কোন বন্ধন আমার নেই, কেউ আমার জন্য কোথাও অপেক্ষা করে নেই। আমি রিক্ত একজন। তাই কাজের মধ্যে ডুবে থাকি, ভুলে থাকি নিজেকে।
-জানতাম না, স্যার।
-তোমার বয়সী আমার একটা ছেলে আছে। ওর মায়ের সাথে এই শহরেই থাকে। মাঝেমাঝে আমাদের দেখা হয়। ছেলেটা এক সময় আমার বুকে ছাড়া ঘুমাতো না। দশ বছর হলো ওর মায়ের সাথে আমার সেপারেশান। আমি এই শহরের লক্ষ মানুষের মাঝে সম্পূর্ন একা একজন।
-খুব কষ্টের ব্যাপার !
-হুম, কষ্টের তো বটেই !
-তুমি আমার সাথে মাঝেমাঝে একটু সময় দেবে, মেহজাবীন? লাইক আ ফ্রেন্ড।
বসের জন্য ফেরার পথে বুকটা হু হু করে উঠলো। ধন-সম্পদ মানুষকে এতটুকুও সুখী করতে পারেনা ! চাকচিক্যের আড়ালে কি নিঃস্ব একজন মানুষ ! আমার মাঝে নিশ্চয় উনি উনার সন্তানের ছায়া খুঁজেছেন।
এরপর মাঝেমধ্যে বস্ আমাকে ডাকতেন। দু'চারটা কথা বলতেন, আমি শুনতাম। সেদিনও বস বললেন,
-কিছু কাজ জমা আছে, মেহজাবীন তুমি একটু হেল্প করো আজ।
-জী স্যার।
আমি বসের রুমে ঢুকলাম। অলরেডী সন্ধ্যা তখন। সবাই চলে গেছে। যাবার সময় কেউ কেউ অর্থবোধক দৃষ্টিতে আমাকে দেখে গেছে।মুনির নামের পিয়নটা কেবল গেটের কাছে ঝিমুচ্ছে।
-মেহজাবীন, কাজ শুরু করার আগে একটু কফি খায়, কেমন? তুমি বসো, আমি কফি বানাবো। বসের রুমের সাথেই ছোট্ট আরেকটা রুম। হাল্কা বেগুনী রঙের স্বল্প আলো জ্বলছে সেখানে।
-তুমি এখানে আসো।আমি কফিটা এই রুমে খেতে পছন্দ করি।
আমার কেন জানি ভালো লাগছেনা। তবুও গেলাম কেন জানিনা। সাদা ধবধবে বিছানার পাশে দুটো চেয়ার পাতা। সামনে ছোট একটা টেবিলে দু'মগ কফি।
-বসো। কফি শেষ করো। কাজ শেষে তোমাকে পৌছে দেবো। কাল তো শুক্রবার। রেষ্ট করে নিও।
কফি শেষ করতেই আমার মাথাটায় ঝিমঝিম শুরু হলো। হয়তো সারাদিনের ক্লান্তিতে এমন লাগছে।উঠে দাড়াতেই পড়ে যাবার মত অবস্থা। বস্ আমার হাত ধরে বসিয়ে দিলেন।
-তোমার কি খারাপ লাগছে?
-স্যার, আমি চলে যাবো। আমার ভালো লাগছেনা।
-ভালো লাগবে। এই যে এখানে, এই বিছানাতে একটু রেষ্ট নাও।
-স্যার, আমি যেতে চাই ! প্লিজ ! আমি শনিবারে সকালে আপনার কাজগুলো করে দেবো।
আমার চোখে দেখা সেই ভালো মানুষরুপী মানুষের মুখে সেদিন আমি হায়েনার রূপ দেখেছি! কি নির্মম নোংরাভাবে আমার জীবনের গতিটা থমকে গিয়েছিল সেই কলুষিত থাবায়। পশুর শক্তির কাছে আমি, আমার শরীর, আমার অনুনয়, চোখের পানি সব পরাজিত হলো ! আমি রেইপড হলাম, সেই বেগুনী আলোর নীচে ! পৃথিবীর নোংরা মানচিত্র উন্মোচিত হলো আমার সামনে! কি ঘৃনা ! কি ব্যথা !! কেউ জানলো না। কাউকে জানতে দিইনি কোনদিন !
আর কোনদিন ঐ অফিসে যাইনি। শুধু কেঁদেছি আর কেঁদেছি। কতদিন, কতকাল জানিনা। বন্ধু শর্মীর ছায়া আমাকে আগলে রেখেছে সেই দুঃসময়ে। নতুন করে হাটতে শেখালো সে আমাকে। বাঁচতে শেখালো নতুন করে।
চলবে..