শাশুড়ী আম্মা ডেকে বললেন, "বউমা তোমার বাসা কি প্রেম ভালোবাসার কারখানা নাকি?" জ্বি আম্মা! তিনি আবারো শুরু করলেন, " এই পর্যন্ত যতগুলি কাজের মেয়ে রাখছ সব-কয়টাই হয় তার নাগরের হাত ধরে পালাইছে,না হয় হাতে নাতে ধরা পড়ছে আর তা না হলে কাজ কাম বাদ দিয়া ফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা প্রেম করছে।"
লজ্জায় আমার মুখ লাল হয়ে গেল। এইসব কি বলছেন উনি ? আমি আর আমার হাসব্যন্ড বাচ্চাদের এবং কাজের মানুষের সামনে খুব সাবধানে চলাফের করি। কথাবার্তাও বলি সাবধানে।
আর আমার হাসব্যান্ড এমনিতেই ঠান্ডা স্বভাবের মানুষ আর একটু গম্ভীর ও।সোফায় একটা নিদিষ্ট দূরত্ব রেখে বসে আমার সাথে, আর আমি যদিও বা একটু ঘেষে বসি বলে, কি কর এসব, সরে বস বাচ্চারা এদিকে আসা যাওয়া করে। এমনকি বাচ্চারা বড় হচ্ছে বলে পোশাক এর ব্যাপারে ও আমাকে আরও সচেতন হবার নির্দেশ দিয়েছে। সেখানে মার এই কথাটা, সারা-দিন আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল ।
কিন্তু চিন্তা করে দেখলাম তাইত, প্রথম যে মেয়েটা পালালো তার যে মোবাইল আছে আমি জানতামও না।চুপি, চুপি সারভেন্ট টয়লেটে ঢুকে দীর্ঘ সময় কথা বলত।আমি ভাবতাম আমাশা, নয় ডায়েরিয়া হইছে বুঝি। ওরস্যালাইন,ঔষধ লাগবে কিনা জানতে চেয়েছি। কাচাঁ পেঁপে দিয়ে শিং মাছের ঝোল, আলু ভর্তা রান্না করে খেতেও বলছি।
হঠাৎ একদিন বাচ্চাকে স্কুল থেকে নিয়ে এসে ঘরের প্রধান দরজা খোলা পেলাম। কি ব্যাপার? ওর নাম ধরে কয়েকবার ডাকাডাকিও করলাম কিন্তু কোথাও নেই। সম্পূর্ণ বাড়ি নীচ তলা ও দু'তলা নিয়ে আমরা থাকি। শাশুড়ীর আর্থ্রাইটিসের এর সমস্যা আছে বলে উনি নীচতলায় থাকেন ওখানে ও খোঁজ নিলাম নেই।দারোয়ান ও বলল, সে নাকি টয়লেটে ছিল।
অবশেষে তার খালাকে খবর দেয়া হল। সে এসেই, কান্নাকাটি শুরু করেদিল তার বোনকে কি জবাব দিবে বলে। এও বলল, বস্তির মানুষেরা নাকি বলাবলি করছে বড়লোকেরা কাজের মানুষ মেরে গুম করে দেয়। এই কথা শুনে আমার হাতপা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। যথেষ্ট হয়েছে, এবার হাসব্যান্ড কে ফোন দিয়ে বিস্তারিত জানিয়ে থানায় জিডি করতে বললাম। পরে জানা গেল, গাজীপুরে সে তার প্রেমিক এর সাথে বিয়ে করে ভালই আছে। শুনে, প্রচন্ড রাগ হয়েছিল।কি যে টেনশনে সেই দিনটা পার করেছিলাম।
যতদূর মনে পড়ে, উন্নত প্রযুক্তি মানুষের ঘরের দুয়ারে দুয়ার পৌঁছে যাবার আগ পর্যন্ত যে কয়জন মেয়ে বাসায় পার্মানেন্ট হিসেবে রেখেছিলাম, তদের বিয়ের বয়স, না হওয়া পর্যন্ত ওরা ভালো ভাবেই কাজ করে গেছে।কাজের পাশাপাশি ওরা যেন মোটামুটি পড়তে ও লিখতে পারে এইটুকুন শিক্ষাও দিতে পেরেছিলাম।
যেহেতু বাচ্চারা ছোট, কাজেই সবসময় বাচ্চাদের সাথে থাকার জন্য, ওদের শরণাপন্ন হতেই হয় আমার ৷ ছোট আরেকটা মেয়ে রাখলাম।সেও টানা দুই বছর থাকার পর বাড়ি গিয়ে একটা টাচ্ মোবাইল কিনে আনল।আমার ছোট ছেলের কাছ থেকে সব কিছু শিখে নিল।গেইমস্ খেলা থেকে শুরু করে মেসেজ পাঠানো পর্যন্ত। এবার আমি চালাক হলাম দু'দিন পর পর মোবাইল চেক করি।হঠাৎ একদিন একটা ছেলের সাথে তার ছবিও দেখে বললাম, কে রে এটা ও বলল, ওর মামাত ভাই আর এইটা তার দেশে বেড়ানোর সময়ে তোলা ছবি আরও কয়েক দিন পর আবিষ্কার করলাম, কার সাথে যেন ফোনে কথা বলে। এবার বলল, ওর দুলাভাই এর সাথে কথা বলে। মহা মুশকিলে পরলাম।ঘরের কাজ করব না কাজের মেয়ে পাহারা দিব।
আরও কিছুদিন পর আবারও, মোবাইল চেক করে দেখলাম আরেকটা ছেলের ছবি।জিজ্ঞেস করলাম, এ কার ছবি? এটা কখন তুললি? বলে বসল, ওর সাথে ব্রেকাপ হয়ে গেছে তার।কি বলব ভাষা খুঁজে পেলাম না, শুধু মনে হল কেন যে আম্মার কাছ থেকে কিছু স্পেশাল গালি শিখলাম না।আমার দাদির গালি ছিলো আরও স্পেশাল। অসম্ভব দাম্ভিক ও অহংকারী মহিলা ছিলেন তিনি। বান্দি ছাড়া ওদেরকে আর কিছুই ডাকতেন না। এর কিছুটা প্রভাব আমার ছোটবোনের উপর পড়েছে। কিন্তু কি আশ্চর্য ওর বাসার কাজের মেয়েরা কি সুন্দর থাকছে! শক্তের ভক্ত নরমের যম আর কি!!
তারপর থেকে, মাঝে মাঝে শুধু ওকে ওর চাচার বাসায় বেড়াতে পাঠাই।এখন ভাবছি, শুধু মাত্র দেশের বাড়িতে যেতে দিব। বিচ্ছেদের পর কিছুদিন ভালোভাবেই কাজ করছিল। এরই মধ্যে একদিন এক বিয়ের দাওয়াতে বেড়াতে গিয়ে জরুরী ভিত্তিতে বাসায় আসার ফোন পেলাম। ভাবলাম শাশুড়ীর কিছু হয়েছে, কিন্ত পৌঁছে দেখি কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আমার কাজের মেয়ে।
কি হয়েছে মা? গম্ভীর মুখে উনি বললেন, "তোমার কাজের মেয়ে ছাদে কার সাথে যেন কথা বলছে, দেখে ফেলাতেই ওই ছেলে আম গাছ বেয়ে পালিয়েছে।" "তবে দারোয়ান এর তাড়া খেয়ে ভয়ে যেভাবে পালিয়েছে এক সপ্তাহ বিছানা থেকে উঠতে পারবেনা, বলে মা হাসলেন।" আমি বললাম, মা এটা অমানবিক,সবাই আমার মুখের দিকে এমনভাবে তাকাল যেন আমিই নাটের গুরু। পরের দিনই তাকে হিসেব নিকেশ বুঝিয়ে বিদেয় দেয়া হল। থাকার জন্য অনেক আকুতি মিনতি করেছিল, কিন্তু পারিপার্শ্বিকতার চাপে রাখতে অপারগ ছিলাম।
প্রতিবার আমিই পড়ি বিপদে, কাজের মানুষ ছাড়া চলা যায়!এবার ভাবলাম, আমার ত দুইটাই ছেলে।তাই এবার কাজের ছেলে রাখলে কেমন হয়।ঐসব ঝামেলা অন্তত থাকবে না। আম্মার বাসার ছেলেটার ভাইকে নিয়ে আসলাম । কিছুদিন যেতে না যেতেই তার ও মতি গতি স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না। হঠাৎ একদিন তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।আসে পাশে খোঁজার পর হাসব্যান্ড ছাদে গিয়ে দেখে সে বসে আছে।কি রে তুই এখানে? তন্নতন্ন করে তোকে খোঁজা হচ্ছে আর তুই এখানে! তোর সমস্যা কি?
উত্তরে সে হাউমাউ করে কেঁদে বলল, ওর ইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। হাসব্যান্ড অনেক বুঝিয়ে ঘরে নিয়ে আসল। সেবার বড় ধরনের ডাকাতি হল শাশুড়ীর ফ্লোরে। উনার ধারণা ,এই ছেলের ও হাত আছে এতে। আমার তা মনে হল না। পাছে ওর অপমান হয় তাই আর রাখিনি।
মাকে একটু রেগেই, বললাম এভাবে'ত পারা যায়না মা। বাচ্চাদের স্কুল, খেলার মাঠে আনা নেয়া, ঘরের কাজে আমি একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছি। মা বললেন," বিবাহিত বুয়া পাও কিনা দেখ।"আমি বললাম, মা একমাস পর পর ওরা দেশে যেতে চাইবে।পরে আসবে কি না তার গেরান্টি কি? মা বললেন তাহলে, "অল্প বয়সী বিধবা মহিলা খোঁজ।"
মা'কে বললাম কিছু মনে করবেন না মা, শুনেছি বিবাহিতদের সাথে থাকলে ওদেরও নাকি, মা থামিয়ে দিয়ে বললেন আর বলতে হবে না বুঝেছি, তাহলে আর কি চ্যাংরা চ্যাংরা মেয়ে রাখ আর বিপদে পড়।
মার এই কথাটা মনে রেখে, একজন বয়স্ক বুয়া নিয়োগ করলাম। প্রথম দিনই শর্ত জুড়ে দিল,সপ্তাহে এক বিড়া পান,দু'বেলা কড়া লিকার দিয়ে দুধ চা লাগবে তার। অবশ্য চা সে নিজেই বানিয়ে নিবে।ভাবলাম, এ আর তেমন কি,বললাম খালা তোমার যা ইচ্ছে হয় রান্না করে খেও। এটা বলাতেই কাল হল,কেননা খালা দু'দিন পর পর হিদল(পুঁটিমাছের শুটকি) রান্না করে খাওয়া শুরু করল। আমি ছাড়া বাসায় কেউ এই খাবার খায় না।গন্ধে সবার দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম।দেশের বাড়ি থেকে লতায় পাতায় আত্মীয় সহ নিজের ছেলেমেয়েরা যখন তখন ফোন দিতে থাকল।নেটওয়ার্ক এর সমস্যার কারণে সে সমস্ত বাড়িঘর জুড়ে শব্দ করে কথা বলা শুরু করল। পানের পিকে আমার রান্না ঘরের চেহারাও বদলে গেল।দু'মাস পর, নাতনির বিয়ে উপলক্ষে দেশে যাইতে চাইল।আমার শাশুড়ীকে দেখে মনে হল, ওনাকে বিদেয় করার এরকম একটা সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিলেন তিনি।
অনেক খুঁজে মোবাইল ছাড়া মেয়ে রাখলাম।সহজ, সরল হাসি খুশি।আমার বাসায় আগে থেকেই আমার স্বামী এবং বাচ্চা দের বলা আছে যেহেতু আমার মেয়ে নেই তাই ওদেরকে আমি আমার মেয়ের মতই দেখব।কেউ আমাকে বাঁধা দিতে পারবে না।এই মেয়েকে ও আমি অনেক আদর করতাম। শাশুড়ীও খুশি সন্ধ্যায় উনার হাতপা টিপে দেয় আর দুজন মিলে জি-বাংলায় নাটক দেখে।
কাজের মানুষের সুখ বেশিদিন কপালে সয় না আমার। কিছু দিন যেতে না যেতেই এটা ওটা শুকাতে দেবার নাম করে ছাদে যায়। পাশের বাসার ভাবি বলল, আমি যখন বাসায় থাকি না তখন ও নাকি ভাবিদের বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন এর শ্রমিক দের সাথে আকার ইংগিতে কথা বলে। এবার কাউকে কিছু না জানিয়ে ঈদের ছুটিতে দেশে পাঠিয়ে দিলাম।
সর্বশেষ,যে মেয়েটিকে রাখলাম, তাকে নাকি জোর করে তার বাবা-মা বিয়ে দিতে চাচ্ছেন এক বুড়ার সাথে। তাই সে গ্রামের এক খালার সাথে পালিয়ে চলে আসছে। ঐ খালা আমাদের পরিচিত উনার অনুরোধেই ওকে রাখলাম। নতুন করে শিখাতে শিখাতে আমি ক্লান্ত তাও শিখািচ্ছি..কতক্ষণ ধরে পানি ফুটাতে হবে,কিভাবে টেবিলে খাবার দিবে,চা বানানো,রুটি বানানো ইত্যাদি। কয়েকদিন পর রাতে কার যেন হাসির শব্দ পাই, ভয় পেয়ে গেলাম হাসব্যান্ড কেও জানালাম।
হাসব্যান্ড বলল, আরেকবার শুনলে তাকে ডাক দিতে।তাকে ডাক না দিয়ে, রাতে চুপি চুপি রুম থেকে বের হয়ে খেয়াল করলাম, শব্দটা সার্ভেন্ট রুম থেকে আসছে।ভালো করে কান পেতে শুনলাম, মেয়েটা কার সাথে যেন গল্প আর হাসাহাসি করছে। রাগে মনে হচ্ছিল, এখনি বাসা থেকে বের করে দেই।কিন্ত কাজের মেয়ে পাওয়া খুবই দুষ্কর। মাথা ঠান্ডা করে কাজ করতে হবে। সকালে উঠেই জিজ্ঞেস করলাম সারারাত জেগে তুই কার সাথে কথা বলিস?
উত্তরে বলল, তার চাচাতো ভাই এর সাথে, সে মালয়েশিয়ায় থাকে। সারাদিন কাজ করে সেই ছেলে, তাই রাতে ওর সাথে কথা বলে। এবছর আসলে ওদের বিয়েও হবে।ওর মাও জানে এই ব্যাপারটা, পরেরদিন ওর মা ফোন করে আমাকেও তাই জানাল।যাক এর প্রেম ভালোবাসা লাইসেন্স প্রাপ্ত।কিন্তু সমস্যা হল সারারাত কথা বলে আর দিনে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কাজ করে, এক এক করে আমার সব প্লেটবাসন ভেঙে একাকার অবস্থা।বিষয়টা আর ভালো লাগছিল না। নয় মাসের চুক্তিতে এসেছিল,তার আগেই কাজ ছেড়ে দিতে বলি ওকে।
মা, শাশুড়ীর আমলে দেখেছি অবসরে ওরা শুধু বাংলা সিনামা দেখা নিয়ে ব্যাস্ত থাকত,পরবর্তীতে হিন্দি সিরিয়াল, পাশাপাশি ওপারের বাংলা সিরিয়াল আর এখন মোবাইলে চ্যাটিং নিয়ে ব্যাস্ত।
অলস মস্তিষ্ক যেন শয়তানের আড্ডাখানা না হয়,সেজন্য আমি ওদেরকে অবসরে মহিলা আরবি শিক্ষিকা রেখে আরবি শিখিয়েছি,সেলাই শিখিয়েছি, পার্সোনাল টিভি দিয়ে দিয়েছি,ছেলেটাকে ড্রাইভিং ও শিখিয়েছি, এজন্য কত কথা শুনেছি। যথেষ্ট হয়েছে, এখন থেকে ভেবেছি আর পার্মানেন্ট কাউকে রাখব না।
বর্তমানে একটা মেয়ে পেয়েছি, সারাদিন কাজ করে, বিকেলে চলে যায়। বাসা কাছে হওয়াতে, একদম ভোরেই চলে আাসে। এভাবেই চলছে। কয়েকদিন পর, এক সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে, ড্রাইভার বলল, "মেডাম দেখেন আপনার বাসার মেয়েটা অন্ধকারে কার সাথে যেন কথা বলছে। এক নজর তাকিয়ে ভাবলাম, আমার কি এত ঠেকা পড়ছে ? ওকে কিছু বলার, ও'ত আমার এখানে পার্মানেন্ট থাকেনা বরং নিজের বাচ্চাদের আত্মনির্ভরশীল করে তুলি ভবিষ্যতে যেন, কারোর উপর নির্ভরশীল হতে না হয়। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে, ড্রাইভার কে বললাম, তুমি সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালাও।
(সমাপ্ত)
লজ্জায় আমার মুখ লাল হয়ে গেল। এইসব কি বলছেন উনি ? আমি আর আমার হাসব্যন্ড বাচ্চাদের এবং কাজের মানুষের সামনে খুব সাবধানে চলাফের করি। কথাবার্তাও বলি সাবধানে।
আর আমার হাসব্যান্ড এমনিতেই ঠান্ডা স্বভাবের মানুষ আর একটু গম্ভীর ও।সোফায় একটা নিদিষ্ট দূরত্ব রেখে বসে আমার সাথে, আর আমি যদিও বা একটু ঘেষে বসি বলে, কি কর এসব, সরে বস বাচ্চারা এদিকে আসা যাওয়া করে। এমনকি বাচ্চারা বড় হচ্ছে বলে পোশাক এর ব্যাপারে ও আমাকে আরও সচেতন হবার নির্দেশ দিয়েছে। সেখানে মার এই কথাটা, সারা-দিন আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল ।
কিন্তু চিন্তা করে দেখলাম তাইত, প্রথম যে মেয়েটা পালালো তার যে মোবাইল আছে আমি জানতামও না।চুপি, চুপি সারভেন্ট টয়লেটে ঢুকে দীর্ঘ সময় কথা বলত।আমি ভাবতাম আমাশা, নয় ডায়েরিয়া হইছে বুঝি। ওরস্যালাইন,ঔষধ লাগবে কিনা জানতে চেয়েছি। কাচাঁ পেঁপে দিয়ে শিং মাছের ঝোল, আলু ভর্তা রান্না করে খেতেও বলছি।
হঠাৎ একদিন বাচ্চাকে স্কুল থেকে নিয়ে এসে ঘরের প্রধান দরজা খোলা পেলাম। কি ব্যাপার? ওর নাম ধরে কয়েকবার ডাকাডাকিও করলাম কিন্তু কোথাও নেই। সম্পূর্ণ বাড়ি নীচ তলা ও দু'তলা নিয়ে আমরা থাকি। শাশুড়ীর আর্থ্রাইটিসের এর সমস্যা আছে বলে উনি নীচতলায় থাকেন ওখানে ও খোঁজ নিলাম নেই।দারোয়ান ও বলল, সে নাকি টয়লেটে ছিল।
অবশেষে তার খালাকে খবর দেয়া হল। সে এসেই, কান্নাকাটি শুরু করেদিল তার বোনকে কি জবাব দিবে বলে। এও বলল, বস্তির মানুষেরা নাকি বলাবলি করছে বড়লোকেরা কাজের মানুষ মেরে গুম করে দেয়। এই কথা শুনে আমার হাতপা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। যথেষ্ট হয়েছে, এবার হাসব্যান্ড কে ফোন দিয়ে বিস্তারিত জানিয়ে থানায় জিডি করতে বললাম। পরে জানা গেল, গাজীপুরে সে তার প্রেমিক এর সাথে বিয়ে করে ভালই আছে। শুনে, প্রচন্ড রাগ হয়েছিল।কি যে টেনশনে সেই দিনটা পার করেছিলাম।
যতদূর মনে পড়ে, উন্নত প্রযুক্তি মানুষের ঘরের দুয়ারে দুয়ার পৌঁছে যাবার আগ পর্যন্ত যে কয়জন মেয়ে বাসায় পার্মানেন্ট হিসেবে রেখেছিলাম, তদের বিয়ের বয়স, না হওয়া পর্যন্ত ওরা ভালো ভাবেই কাজ করে গেছে।কাজের পাশাপাশি ওরা যেন মোটামুটি পড়তে ও লিখতে পারে এইটুকুন শিক্ষাও দিতে পেরেছিলাম।
যেহেতু বাচ্চারা ছোট, কাজেই সবসময় বাচ্চাদের সাথে থাকার জন্য, ওদের শরণাপন্ন হতেই হয় আমার ৷ ছোট আরেকটা মেয়ে রাখলাম।সেও টানা দুই বছর থাকার পর বাড়ি গিয়ে একটা টাচ্ মোবাইল কিনে আনল।আমার ছোট ছেলের কাছ থেকে সব কিছু শিখে নিল।গেইমস্ খেলা থেকে শুরু করে মেসেজ পাঠানো পর্যন্ত। এবার আমি চালাক হলাম দু'দিন পর পর মোবাইল চেক করি।হঠাৎ একদিন একটা ছেলের সাথে তার ছবিও দেখে বললাম, কে রে এটা ও বলল, ওর মামাত ভাই আর এইটা তার দেশে বেড়ানোর সময়ে তোলা ছবি আরও কয়েক দিন পর আবিষ্কার করলাম, কার সাথে যেন ফোনে কথা বলে। এবার বলল, ওর দুলাভাই এর সাথে কথা বলে। মহা মুশকিলে পরলাম।ঘরের কাজ করব না কাজের মেয়ে পাহারা দিব।
আরও কিছুদিন পর আবারও, মোবাইল চেক করে দেখলাম আরেকটা ছেলের ছবি।জিজ্ঞেস করলাম, এ কার ছবি? এটা কখন তুললি? বলে বসল, ওর সাথে ব্রেকাপ হয়ে গেছে তার।কি বলব ভাষা খুঁজে পেলাম না, শুধু মনে হল কেন যে আম্মার কাছ থেকে কিছু স্পেশাল গালি শিখলাম না।আমার দাদির গালি ছিলো আরও স্পেশাল। অসম্ভব দাম্ভিক ও অহংকারী মহিলা ছিলেন তিনি। বান্দি ছাড়া ওদেরকে আর কিছুই ডাকতেন না। এর কিছুটা প্রভাব আমার ছোটবোনের উপর পড়েছে। কিন্তু কি আশ্চর্য ওর বাসার কাজের মেয়েরা কি সুন্দর থাকছে! শক্তের ভক্ত নরমের যম আর কি!!
তারপর থেকে, মাঝে মাঝে শুধু ওকে ওর চাচার বাসায় বেড়াতে পাঠাই।এখন ভাবছি, শুধু মাত্র দেশের বাড়িতে যেতে দিব। বিচ্ছেদের পর কিছুদিন ভালোভাবেই কাজ করছিল। এরই মধ্যে একদিন এক বিয়ের দাওয়াতে বেড়াতে গিয়ে জরুরী ভিত্তিতে বাসায় আসার ফোন পেলাম। ভাবলাম শাশুড়ীর কিছু হয়েছে, কিন্ত পৌঁছে দেখি কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আমার কাজের মেয়ে।
কি হয়েছে মা? গম্ভীর মুখে উনি বললেন, "তোমার কাজের মেয়ে ছাদে কার সাথে যেন কথা বলছে, দেখে ফেলাতেই ওই ছেলে আম গাছ বেয়ে পালিয়েছে।" "তবে দারোয়ান এর তাড়া খেয়ে ভয়ে যেভাবে পালিয়েছে এক সপ্তাহ বিছানা থেকে উঠতে পারবেনা, বলে মা হাসলেন।" আমি বললাম, মা এটা অমানবিক,সবাই আমার মুখের দিকে এমনভাবে তাকাল যেন আমিই নাটের গুরু। পরের দিনই তাকে হিসেব নিকেশ বুঝিয়ে বিদেয় দেয়া হল। থাকার জন্য অনেক আকুতি মিনতি করেছিল, কিন্তু পারিপার্শ্বিকতার চাপে রাখতে অপারগ ছিলাম।
প্রতিবার আমিই পড়ি বিপদে, কাজের মানুষ ছাড়া চলা যায়!এবার ভাবলাম, আমার ত দুইটাই ছেলে।তাই এবার কাজের ছেলে রাখলে কেমন হয়।ঐসব ঝামেলা অন্তত থাকবে না। আম্মার বাসার ছেলেটার ভাইকে নিয়ে আসলাম । কিছুদিন যেতে না যেতেই তার ও মতি গতি স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না। হঠাৎ একদিন তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।আসে পাশে খোঁজার পর হাসব্যান্ড ছাদে গিয়ে দেখে সে বসে আছে।কি রে তুই এখানে? তন্নতন্ন করে তোকে খোঁজা হচ্ছে আর তুই এখানে! তোর সমস্যা কি?
উত্তরে সে হাউমাউ করে কেঁদে বলল, ওর ইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। হাসব্যান্ড অনেক বুঝিয়ে ঘরে নিয়ে আসল। সেবার বড় ধরনের ডাকাতি হল শাশুড়ীর ফ্লোরে। উনার ধারণা ,এই ছেলের ও হাত আছে এতে। আমার তা মনে হল না। পাছে ওর অপমান হয় তাই আর রাখিনি।
মাকে একটু রেগেই, বললাম এভাবে'ত পারা যায়না মা। বাচ্চাদের স্কুল, খেলার মাঠে আনা নেয়া, ঘরের কাজে আমি একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছি। মা বললেন," বিবাহিত বুয়া পাও কিনা দেখ।"আমি বললাম, মা একমাস পর পর ওরা দেশে যেতে চাইবে।পরে আসবে কি না তার গেরান্টি কি? মা বললেন তাহলে, "অল্প বয়সী বিধবা মহিলা খোঁজ।"
মা'কে বললাম কিছু মনে করবেন না মা, শুনেছি বিবাহিতদের সাথে থাকলে ওদেরও নাকি, মা থামিয়ে দিয়ে বললেন আর বলতে হবে না বুঝেছি, তাহলে আর কি চ্যাংরা চ্যাংরা মেয়ে রাখ আর বিপদে পড়।
মার এই কথাটা মনে রেখে, একজন বয়স্ক বুয়া নিয়োগ করলাম। প্রথম দিনই শর্ত জুড়ে দিল,সপ্তাহে এক বিড়া পান,দু'বেলা কড়া লিকার দিয়ে দুধ চা লাগবে তার। অবশ্য চা সে নিজেই বানিয়ে নিবে।ভাবলাম, এ আর তেমন কি,বললাম খালা তোমার যা ইচ্ছে হয় রান্না করে খেও। এটা বলাতেই কাল হল,কেননা খালা দু'দিন পর পর হিদল(পুঁটিমাছের শুটকি) রান্না করে খাওয়া শুরু করল। আমি ছাড়া বাসায় কেউ এই খাবার খায় না।গন্ধে সবার দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম।দেশের বাড়ি থেকে লতায় পাতায় আত্মীয় সহ নিজের ছেলেমেয়েরা যখন তখন ফোন দিতে থাকল।নেটওয়ার্ক এর সমস্যার কারণে সে সমস্ত বাড়িঘর জুড়ে শব্দ করে কথা বলা শুরু করল। পানের পিকে আমার রান্না ঘরের চেহারাও বদলে গেল।দু'মাস পর, নাতনির বিয়ে উপলক্ষে দেশে যাইতে চাইল।আমার শাশুড়ীকে দেখে মনে হল, ওনাকে বিদেয় করার এরকম একটা সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিলেন তিনি।
অনেক খুঁজে মোবাইল ছাড়া মেয়ে রাখলাম।সহজ, সরল হাসি খুশি।আমার বাসায় আগে থেকেই আমার স্বামী এবং বাচ্চা দের বলা আছে যেহেতু আমার মেয়ে নেই তাই ওদেরকে আমি আমার মেয়ের মতই দেখব।কেউ আমাকে বাঁধা দিতে পারবে না।এই মেয়েকে ও আমি অনেক আদর করতাম। শাশুড়ীও খুশি সন্ধ্যায় উনার হাতপা টিপে দেয় আর দুজন মিলে জি-বাংলায় নাটক দেখে।
কাজের মানুষের সুখ বেশিদিন কপালে সয় না আমার। কিছু দিন যেতে না যেতেই এটা ওটা শুকাতে দেবার নাম করে ছাদে যায়। পাশের বাসার ভাবি বলল, আমি যখন বাসায় থাকি না তখন ও নাকি ভাবিদের বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন এর শ্রমিক দের সাথে আকার ইংগিতে কথা বলে। এবার কাউকে কিছু না জানিয়ে ঈদের ছুটিতে দেশে পাঠিয়ে দিলাম।
সর্বশেষ,যে মেয়েটিকে রাখলাম, তাকে নাকি জোর করে তার বাবা-মা বিয়ে দিতে চাচ্ছেন এক বুড়ার সাথে। তাই সে গ্রামের এক খালার সাথে পালিয়ে চলে আসছে। ঐ খালা আমাদের পরিচিত উনার অনুরোধেই ওকে রাখলাম। নতুন করে শিখাতে শিখাতে আমি ক্লান্ত তাও শিখািচ্ছি..কতক্ষণ ধরে পানি ফুটাতে হবে,কিভাবে টেবিলে খাবার দিবে,চা বানানো,রুটি বানানো ইত্যাদি। কয়েকদিন পর রাতে কার যেন হাসির শব্দ পাই, ভয় পেয়ে গেলাম হাসব্যান্ড কেও জানালাম।
হাসব্যান্ড বলল, আরেকবার শুনলে তাকে ডাক দিতে।তাকে ডাক না দিয়ে, রাতে চুপি চুপি রুম থেকে বের হয়ে খেয়াল করলাম, শব্দটা সার্ভেন্ট রুম থেকে আসছে।ভালো করে কান পেতে শুনলাম, মেয়েটা কার সাথে যেন গল্প আর হাসাহাসি করছে। রাগে মনে হচ্ছিল, এখনি বাসা থেকে বের করে দেই।কিন্ত কাজের মেয়ে পাওয়া খুবই দুষ্কর। মাথা ঠান্ডা করে কাজ করতে হবে। সকালে উঠেই জিজ্ঞেস করলাম সারারাত জেগে তুই কার সাথে কথা বলিস?
উত্তরে বলল, তার চাচাতো ভাই এর সাথে, সে মালয়েশিয়ায় থাকে। সারাদিন কাজ করে সেই ছেলে, তাই রাতে ওর সাথে কথা বলে। এবছর আসলে ওদের বিয়েও হবে।ওর মাও জানে এই ব্যাপারটা, পরেরদিন ওর মা ফোন করে আমাকেও তাই জানাল।যাক এর প্রেম ভালোবাসা লাইসেন্স প্রাপ্ত।কিন্তু সমস্যা হল সারারাত কথা বলে আর দিনে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কাজ করে, এক এক করে আমার সব প্লেটবাসন ভেঙে একাকার অবস্থা।বিষয়টা আর ভালো লাগছিল না। নয় মাসের চুক্তিতে এসেছিল,তার আগেই কাজ ছেড়ে দিতে বলি ওকে।
মা, শাশুড়ীর আমলে দেখেছি অবসরে ওরা শুধু বাংলা সিনামা দেখা নিয়ে ব্যাস্ত থাকত,পরবর্তীতে হিন্দি সিরিয়াল, পাশাপাশি ওপারের বাংলা সিরিয়াল আর এখন মোবাইলে চ্যাটিং নিয়ে ব্যাস্ত।
অলস মস্তিষ্ক যেন শয়তানের আড্ডাখানা না হয়,সেজন্য আমি ওদেরকে অবসরে মহিলা আরবি শিক্ষিকা রেখে আরবি শিখিয়েছি,সেলাই শিখিয়েছি, পার্সোনাল টিভি দিয়ে দিয়েছি,ছেলেটাকে ড্রাইভিং ও শিখিয়েছি, এজন্য কত কথা শুনেছি। যথেষ্ট হয়েছে, এখন থেকে ভেবেছি আর পার্মানেন্ট কাউকে রাখব না।
বর্তমানে একটা মেয়ে পেয়েছি, সারাদিন কাজ করে, বিকেলে চলে যায়। বাসা কাছে হওয়াতে, একদম ভোরেই চলে আাসে। এভাবেই চলছে। কয়েকদিন পর, এক সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে, ড্রাইভার বলল, "মেডাম দেখেন আপনার বাসার মেয়েটা অন্ধকারে কার সাথে যেন কথা বলছে। এক নজর তাকিয়ে ভাবলাম, আমার কি এত ঠেকা পড়ছে ? ওকে কিছু বলার, ও'ত আমার এখানে পার্মানেন্ট থাকেনা বরং নিজের বাচ্চাদের আত্মনির্ভরশীল করে তুলি ভবিষ্যতে যেন, কারোর উপর নির্ভরশীল হতে না হয়। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে, ড্রাইভার কে বললাম, তুমি সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালাও।
(সমাপ্ত)