বেড সাইড টেবিলে রাখা সেলফোনের রিংটোনে ঘুম ভাঙ্গলো। দেয়াল ঘড়ির দিকে প্রথমে তাকালাম। সাতটা পনের মিনিট। ছুটির দিন এতো সকালে কার ফোন? স্ক্রীনে দেখলাম, মা। মা এতো সকালে কেন ফোন করবে? কোন সমস্যা?
-হ্যালো, মা?
-মীরা, তোর ঘুম ভাঙ্গালাম রে !
-কোন সমস্যা?
-না, মানে সমস্যা তো বটেই ! নইলে ছুটির দিন তোকে এতো সকালে ফোন করি?
-কি সমস্যা?
-তোর বাবা...
-কি হয়েছে বাবার? শরীর খারাপ?
-না..
-তো? কাঁদছো কেন, মা?
-তোর বাবা...
-কি, মা?
-মীরা, তোর বাবা........
-কি শুধু তোর বাবা, তোর বাবা করছো ! বাবা কই?
-হাটতে গেছে। ও মীরা, তোর বাবা...
-হুম, আমার বাবা ! কি করেছে? বিয়ে করে ফেলেছে?
-আমি কি তাই বলেছি?
সাজিদ এতোক্ষনে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো ! তার মানে সে কান খাড়া করে রেখেছিল! কানের কাছে মুখ এনে,
-আব্বা বিয়ে করে ফেলেছে? গুড !
আমি ডান হাতের কনুই দিয়ে সাজিদকে গুতো মারতেই ও ধপ করে শুয়ে পড়লো। আমি মায়ের কথায় কান দিলাম। সাজিদকে মুখে আঙুল দিয়ে চুপ থাকতে বললাম।
-মা, তাহলে বাবার কি হয়েছে সেটা বলো ! আমি আরেকটু ঘুমাবো।
-আমার এতো বড় সর্বনাশ, আর তোর ঘুম ? তাড়াতাড়ি চলে আয়!
-এসে কি করবো?
-তালা খুলবি ! তোর বাবার আলমারীর তালা ! তার আগে চাবি উদ্ধার করবি! প্রয়োজনে আলমারী ভাঙবি !
-কিন্তু আলমারীতে কি?
-রহস্য ! বিরাট রহস্য, ঐ আলমারীর ভেতর। যার চাবি কোথায় আমি তা জানিনা !
সাজিদ আবার ধড়মড় করে উঠে বসলো। আমি চুপ থাকতে ইশারা করছি।সে কোন কথায় শুনছে না। আমার ডান কানের কাছে ফিশফিশ করছে।
-আব্বা বিয়ে করে বৌকে আলমারীতে রেখেছে, মীরু? চাবি হারিয়ে গেছে? আমার কাছে চাবিওয়ালার নাম্বার আছে !
আমি আবার ডান কনুই দিয়ে ওর পেটে গুতো মারলাম। সাজিদ শুয়ে পড়লো।মায়ের সাথে কথা শেষ করে আজ সাজিদকে ভালমতো সাইজ করতে হবে। খুব বেশী বেড়েছে!
-মা, আমার বুয়া নয়টায় আসবে। তাকে কাজগুলো বুঝিয়ে দিয়ে আমি আসছি।
-আমার প্রতি তোদের এতো অবহেলা? অসহায় অবস্থায় পড়েছি বলেই তো ডাকছি ! আর তুই আমাকে তোর ঘুম, তোর বুয়া নানারকম উছিলা দেখাচ্ছিস?
-আচ্ছা, আসছি। এখন একটু শান্ত থাকো।
ফোনের লাইন কেটে মাত্র বিছানা থেকে মাটিতে পা রাখবো, সাজিদ তখনই পেছন থেকে জাপটে ধরলো !
-মীরু, ঘটনা তাহলে সত্য?
-কোন ঘটনা?
-আব্বার বিয়ে..?
-আমার বাপ যদি বিয়ে করেও থাকে, উনার নিজ যোগ্যতায় করেছেন ! তুমি এতো লাফাচ্ছো কেন? আর ফোনে কথা বলার সময় কান খাড়া করে অন্যের কথা শোনা, সাইড টোন করা, এসব অভদ্রতাগুলো ছাড়তে পারো না? বদ লোক কোথাকার !
-রেগে যাচ্ছো কেন, মীরু? রাগলে তোমাকে মীর জাফর লাগে। আজ তো আনন্দের দিন !
-চুপ ! একদম বাজে বকবে না !
-আব্বা বিয়ে করলেন এই বয়সে সেটা বাজে হলো না, আর আমি মুখে বলেই বাজে হয়ে গেলাম? তোমরা মহিলারা আসলেই আজব ! আব্বা উচিৎ কাজ করেছেন ! আমিও...!
আমি বাথরুমের দরজার কাছে দাড়িয়ে গেলাম। মাথায় ধপ্ করে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো সাজিদের কথায় !
-ঐ, তুমি কি বললে?
-কিছু না।মানে বলছিলাম, আমারও তো যাওয়া উচিৎ ! কাব্যকেও ঘুম থেকে উঠায় ? নানাভাইয়ের বিয়ে দেখার সৌভাগ্য হলো আমাদের ছেলেটার !
আমি সাজিদের কথায় আর কান করলাম না। বাথরুমে ঢুকে গেলাম। তাড়াতাড়ি করে গোসলটা সেরে বের হয়ে দেখি সাজিদ ঘরে নেই। কাব্যের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি সাজিদ নীল রঙের পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে কাব্যকেও একটা পাঞ্জাবী পরাচ্ছে। কাব্যের চোখে রাজ্যের ঘুম ! সে তার বাবাকে ঘুম জড়ানো গলায় বলছে,
-আমরা কোথায় যাবো, বাবা?
-বিয়েতে।
-কার বিয়ে?
-গেলেই দেখবে কার বিয়ে !
-আমার বিয়ে কবে হবে, বাবা?
-যত দেরীতে হয়, ততই ভালো রে, বাপ !-
-তুমি বিয়ে করবে না?
-না রে বাপ ! একই ভুল মানুষ কয়বার করে...!!!
সাজিদকে ডেকে আমাদের ঘরে এসে আমি খাটের উপর বসে পড়লাম। পৃথিবীটা দিনদিন পাগলে ভরে যাচ্ছে ! সেই ছোটবেলা থেকে নিজের মাকে দেখলাম, বাবার প্রেমে পাগল হয়ে নিত্য নতুন পাগলামী করতে। মায়ের সেই একই রোগ নিয়ে বড়বোন নীরাও সংসার শুরু করলো।
আমি নিজে একটা সূস্থ জীবনের প্রত্যাশায় সাজিদকে নিয়ে জীবন শুরু করলাম।বিয়ের রাতে যখন সে আমাকে বললো,
মীরু, আমার পাজামার ফিতায় গিট্টু লেগে গেছে ! প্লিজ, হেল্প মি...!! তখনই বুঝে গিয়েছিলাম, পাগল! সব পাগল!!
সাজিদ আর কাব্যকে অনেক বুঝিয়ে বাসায় রেখে আমি রওনা দিলাম। ছুটির দিনে রাজপথ এতো ফাঁকা ! রিক্সা চলছে পঙ্খীরাজ ঘোড়ার মত। বাতাসে আমার ভেজা চুল উড়ছে ! কি অনাবিল ভাললাগায় আমার মন ভরে যাচ্ছে, শুধু এই খোলা বাতাসের ছোঁয়াটুকু পেয়ে। কিছু ভাল লাগা শুধুই একান্ত নিজের জন্য হওয়া উচিৎ !
মায়ের কাছে বসে যা কিছু শুনলাম তার সারমর্ম হলো, বাবা এমন কিছু একটা আলমারীতে রেখেছেন যা মাকে দেখাচ্ছেন না। মা দেখে ফেলবেন এই কারনে বাবা আলমারীর চাবীটাও লুকিয়ে রাখছেন। মা আমাকে পাশে বসিয়ে এমনভাবে কথাগুলো বলছেন, যেন একজন ডাক্তারের কাছে কোন রোগী তার সমস্যার বর্ননা দিচ্ছেন।
আর আমিও খুব ধৈর্য্য নিয়ে মায়ের কথাগুলো শুনছি।
-শোন মীরা, প্রথম খটকা খেলাম গত সপ্তায়। বিয়ের চল্লিশ বছর পর কোন উপলক্ষ্য নেই অথচ তোর বাবা আমার জন্য এক তোড়া লাল গোলাপ নিয়ে হাজির ! সাত সকালে হাটতে গিয়ে লাল গোলাপ হাতে ফিরলো ! মুখে মুচকি হাসি দিয়ে আমার হাতে গোলাপ তুলে দিল ! যে মানুষ জীবনে আমার জন্য একটা কচুপাতাও হাতে করে আনেনি, সে আনলো কিনা লাল গোলাপ!!
-মা, মানুষের মন একেক বয়সে একেক রং ধরে। বাবা যা আগে করেনি তা এখন করতে তার মন বলছে। এতে সমস্যা কেন খুঁজছো?
-কিন্তু গতকাল? আমি দরজা খুলতেই উনি গাল মুখ লজ্জায় লাল করে আমাকে বলে, আই লাভ ইউ, শেফু !
বিয়ের আগেও তো এমন করে লাভ ইউ বলেনি ! আর আমার নাম শেফালী আকতার। উনি আমাকে এতোকাল পরে বলে,শেফু !! কি নাটক !
-মা, মানুষের প্রথম জীবনটা কত সংগ্রাম করে সংসার করতে হয় ! বাচ্চারা ছোট, তাদের ভবিষ্যৎ চিন্তা, টাকা পয়সার টানাটানি, তখন ইচ্ছে করলেও মানুষ হয়তো ভালবাসার কথা মুখে বলতে পারেনা। মনের ক্লান্তির কাছে অনেক কিছু চুপ হয়ে যায়, মা। এখন বাবার অবসর, দুটো মেয়েকে ভাল বিয়ে দিয়ে নির্ভার জীবন শুধু তোমাদের দুজনের। এখন তো বাবা একটু রোমান্টিক হতেই পারেন! যে কথা এতোদিন বলা হয়নি, তা আজও বলতে হবেনা এমন তো কোন কথা নেই।
-আর আলমারী ? কি আছে ওখানে ? দিনের মধ্যে তিন-চারবার আলমারী খুলে চুপিচুপি কি যেন দেখে ! আমাকে দেখলেই ধপ্ করে চাবী মেরে অন্যদিকে হাটে ! প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যায় !
-আলমারীতে হয়তো বাবার কোন জরুরী কাগজ থাকতে পারে যা তোমার না দেখলেও চলবে। তাই বাবা তোমাকে শেয়ার করে না।
-বললেই হলো? যে মানুষের রুমালটাও আমি ভাজ করে আলমারীতে রাখতাম, বের করে দিতাম, সে আজ আমাকে তার আলমারীর চাবী লুকায়? কেন? কি এমন রত্ন আছে সেখানে?
-তোমার কি মনে হচ্ছে? কি আছে বলে তোমার ধারনা হচ্ছে, মা?
-আমার ধারনা মিথ্যা হবে না, মীরা । খুবই লজ্জার কথা, তবু শোন, তোর বাবার অপকর্মের সাক্ষী আছে ওখানে ! হয়তো কারো ছবি, গোপনে বিয়ের কাবিননামা, কিংবা চাপে পড়ে সহায় সম্বল সব উইল করে দেবার দলিল !
-মা, এ জীবনে কতবার তুমি বাবাকে সন্দেহের কাঠগড়ায় দাড় করালে ভেবে দেখো ! প্রতিবারই তুমি ভুল প্রমানিত হলে, তবু তোমার ভুল ভাঙ্গলো না?
-আমি ভুল? তোর বাবা তুলসী পাতা?
-আমার বাবা তুলসী পাতা কিনা জানিনা, তবে আমার কাছে আমার বাবা নিম পাতা। তিতা হলেও শুদ্ধ।
-আর আমি?
-তুমি আমার বাবার লাল গোলাপ! কোমলতায় ভরা কিন্তু সন্দেহের কাঁটায় ভরপুর..! হি হি হি...
-মীরা !!
-মা, মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে তুমি রাতের অন্ধকারে তোমার বাবার রাজপ্রাসাদ থেকে আমার বাবার টিনের ঘরে নেমে এসেছিলে !! কতটা ভালো তুমি বাবাকে বাসো আমরা দু'বোন তা জানি । এই অতি ভালবাসা আর জীবনটা কেবলমাত্র বাবাকেন্দ্রীক করাতে তুমি ভালবেসেও সবসময় বাবাকে হারানোর ভয়ে থেকেছো, পাওয়ার আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখেছো।সন্দেহ খুব খারাপ অসুখ, মা। এ অসুখের ওষুধ হলো বিশ্বাস আর আস্থা !
-তুই এতো বড়দের মত কথা বলছিস কেন, মীরা?
-সময় আমাকে বড় করে দিয়েছে তাই। আমার এখন পয়ত্রিশ, আপার আটত্রিশ। আমরা তো বড়ই হয়ে গেলাম ! এবার তুমি একটু বড় হও, মা। বাবা সারাজীবন শুধু তোমাকেই ভালবেসেছেন, এখনও। তাই তো তোমরা চল্লিশ বছর পাশাপাশি আছো। বাবার লাল গোলাপ, আই লাভ ইউ বলার মাঝে কোন রহস্য নেই, আছে ভালবাসা !
-আর আলমারী?
-ওখানেও হয়তো ভালবাসা আছে। আমি সেটা দেখছি ।
আমি বাবার কাছে গেলাম। বাবা বললেন,
-আমি তোদের সব কথা শুনেছি। সোফার গদির তলে আলমারীর চাবী আছে, তোর মাকে সাথে করে খোল। আর শোন্ মীরা, মাকে বেশী শক্ত কথা বলিস না, কষ্ট পাবে! খুব সাদা মনের মানুষ রে !
মাকে নিয়ে আলমারীর চাবী খুললাম। প্রথমেই চোখে পড়লো এক কিশোরী কন্যার সাদাকালো ছবি, স্টুডিওতে তোলা। মা লজ্জায় বেগুনী ! তার কৈশরের ছবি দেখে। বাবার সাজানো কাপড়ের মাঝে মা-ই উদ্ধার করলেন সেই রহস্য, যা নিয়ে এতো কাহিনী ! সেটা হলো একটা বই । বইয়ের নাম, "স্বামী-স্ত্রী সুখী হবার গুরুত্বপূর্ন পরামর্শ"!! মা প্রথম পাতা উল্টিয়েই লাল গোলাপ আর লাভ ইউ বলার ফজীলত খুঁজে পেয়ে আবার বেগুনী হতে থাকলেন।
এখন আমাকে বাসায় ফিরতে হবে। মাকে বললাম,
-প্রতিটা মানুষের নিজস্ব একটা জগৎ থাকতে হয়,মা । সে জগতের বাসিন্দা শুধু সে একা। স্বামী-সংসার, ছেলেমেয়ে সব কিছুর মাঝেও নিজের জন্য একটা ভুবন । নিজের সাথে কথা বলা, নিজের মনে পথচলা...। একজন মানুষকে ভালবেসে এভাবে আকড়ে ধরতে নেই যাতে মানুষটার দম বন্ধ হয়ে আসে, আবার নিজেরও দম ফুরিয়ে যায়। তাকে মুক্ত আকাশে ছড়িয়ে দাও, যদি ভালবাসা খাঁটি হয় তবে দিনশেষে সে তোমার কাছে ফিরবেই।
-এতো পেকে গেলি কবে রে?
-এই গরমে পেকে গেলাম!
-আবার কবে আসবি?
-কাল আসবো। তোমার জন্য কিছু ফুলগাছের টব, আর বই নিয়ে আসবো। তুমি গাছের চর্চা করবে, ফুল ফুটলে মন ভালো হবে! বই পড়লেও মন ভাল হবে! সেই ভালো মনের কোনে দুস্টু সন্দেহগুলো উঁকি দেবার সুযোগই পাবে না !!
-বাইরে তো ঝুম্ বৃষ্টি, মীরা !
-তাতে কি? ঝড় হলে ভাবতাম বের হবো কিনা? বৃষ্টির মোহনীয়তা আমি উপেক্ষা করবো কেন, মা !
রিক্সার হুড ফেলে ঝুম্ বৃষ্টিতে ভেজার কি যে আনন্দ ! সে আনন্দ উপভোগ করতে হয় নিজর মনে, নিজের সনে ! পাশে আরেকজন থাকলে হয়তো আরো ভাল লাগতো ! কিন্তু তার তো সাইনাসের প্রবলেম থাকতেই পারে। আমি কেন আমাকে বঞ্চিত করবো? অন্যে কি করে বুঝবে আমার আনন্দের উৎস কোথায়?
(সমাপ্ত)
-হ্যালো, মা?
-মীরা, তোর ঘুম ভাঙ্গালাম রে !
-কোন সমস্যা?
-না, মানে সমস্যা তো বটেই ! নইলে ছুটির দিন তোকে এতো সকালে ফোন করি?
-কি সমস্যা?
-তোর বাবা...
-কি হয়েছে বাবার? শরীর খারাপ?
-না..
-তো? কাঁদছো কেন, মা?
-তোর বাবা...
-কি, মা?
-মীরা, তোর বাবা........
-কি শুধু তোর বাবা, তোর বাবা করছো ! বাবা কই?
-হাটতে গেছে। ও মীরা, তোর বাবা...
-হুম, আমার বাবা ! কি করেছে? বিয়ে করে ফেলেছে?
-আমি কি তাই বলেছি?
সাজিদ এতোক্ষনে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো ! তার মানে সে কান খাড়া করে রেখেছিল! কানের কাছে মুখ এনে,
-আব্বা বিয়ে করে ফেলেছে? গুড !
আমি ডান হাতের কনুই দিয়ে সাজিদকে গুতো মারতেই ও ধপ করে শুয়ে পড়লো। আমি মায়ের কথায় কান দিলাম। সাজিদকে মুখে আঙুল দিয়ে চুপ থাকতে বললাম।
-মা, তাহলে বাবার কি হয়েছে সেটা বলো ! আমি আরেকটু ঘুমাবো।
-আমার এতো বড় সর্বনাশ, আর তোর ঘুম ? তাড়াতাড়ি চলে আয়!
-এসে কি করবো?
-তালা খুলবি ! তোর বাবার আলমারীর তালা ! তার আগে চাবি উদ্ধার করবি! প্রয়োজনে আলমারী ভাঙবি !
-কিন্তু আলমারীতে কি?
-রহস্য ! বিরাট রহস্য, ঐ আলমারীর ভেতর। যার চাবি কোথায় আমি তা জানিনা !
সাজিদ আবার ধড়মড় করে উঠে বসলো। আমি চুপ থাকতে ইশারা করছি।সে কোন কথায় শুনছে না। আমার ডান কানের কাছে ফিশফিশ করছে।
-আব্বা বিয়ে করে বৌকে আলমারীতে রেখেছে, মীরু? চাবি হারিয়ে গেছে? আমার কাছে চাবিওয়ালার নাম্বার আছে !
আমি আবার ডান কনুই দিয়ে ওর পেটে গুতো মারলাম। সাজিদ শুয়ে পড়লো।মায়ের সাথে কথা শেষ করে আজ সাজিদকে ভালমতো সাইজ করতে হবে। খুব বেশী বেড়েছে!
-মা, আমার বুয়া নয়টায় আসবে। তাকে কাজগুলো বুঝিয়ে দিয়ে আমি আসছি।
-আমার প্রতি তোদের এতো অবহেলা? অসহায় অবস্থায় পড়েছি বলেই তো ডাকছি ! আর তুই আমাকে তোর ঘুম, তোর বুয়া নানারকম উছিলা দেখাচ্ছিস?
-আচ্ছা, আসছি। এখন একটু শান্ত থাকো।
ফোনের লাইন কেটে মাত্র বিছানা থেকে মাটিতে পা রাখবো, সাজিদ তখনই পেছন থেকে জাপটে ধরলো !
-মীরু, ঘটনা তাহলে সত্য?
-কোন ঘটনা?
-আব্বার বিয়ে..?
-আমার বাপ যদি বিয়ে করেও থাকে, উনার নিজ যোগ্যতায় করেছেন ! তুমি এতো লাফাচ্ছো কেন? আর ফোনে কথা বলার সময় কান খাড়া করে অন্যের কথা শোনা, সাইড টোন করা, এসব অভদ্রতাগুলো ছাড়তে পারো না? বদ লোক কোথাকার !
-রেগে যাচ্ছো কেন, মীরু? রাগলে তোমাকে মীর জাফর লাগে। আজ তো আনন্দের দিন !
-চুপ ! একদম বাজে বকবে না !
-আব্বা বিয়ে করলেন এই বয়সে সেটা বাজে হলো না, আর আমি মুখে বলেই বাজে হয়ে গেলাম? তোমরা মহিলারা আসলেই আজব ! আব্বা উচিৎ কাজ করেছেন ! আমিও...!
আমি বাথরুমের দরজার কাছে দাড়িয়ে গেলাম। মাথায় ধপ্ করে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো সাজিদের কথায় !
-ঐ, তুমি কি বললে?
-কিছু না।মানে বলছিলাম, আমারও তো যাওয়া উচিৎ ! কাব্যকেও ঘুম থেকে উঠায় ? নানাভাইয়ের বিয়ে দেখার সৌভাগ্য হলো আমাদের ছেলেটার !
আমি সাজিদের কথায় আর কান করলাম না। বাথরুমে ঢুকে গেলাম। তাড়াতাড়ি করে গোসলটা সেরে বের হয়ে দেখি সাজিদ ঘরে নেই। কাব্যের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি সাজিদ নীল রঙের পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে কাব্যকেও একটা পাঞ্জাবী পরাচ্ছে। কাব্যের চোখে রাজ্যের ঘুম ! সে তার বাবাকে ঘুম জড়ানো গলায় বলছে,
-আমরা কোথায় যাবো, বাবা?
-বিয়েতে।
-কার বিয়ে?
-গেলেই দেখবে কার বিয়ে !
-আমার বিয়ে কবে হবে, বাবা?
-যত দেরীতে হয়, ততই ভালো রে, বাপ !-
-তুমি বিয়ে করবে না?
-না রে বাপ ! একই ভুল মানুষ কয়বার করে...!!!
সাজিদকে ডেকে আমাদের ঘরে এসে আমি খাটের উপর বসে পড়লাম। পৃথিবীটা দিনদিন পাগলে ভরে যাচ্ছে ! সেই ছোটবেলা থেকে নিজের মাকে দেখলাম, বাবার প্রেমে পাগল হয়ে নিত্য নতুন পাগলামী করতে। মায়ের সেই একই রোগ নিয়ে বড়বোন নীরাও সংসার শুরু করলো।
আমি নিজে একটা সূস্থ জীবনের প্রত্যাশায় সাজিদকে নিয়ে জীবন শুরু করলাম।বিয়ের রাতে যখন সে আমাকে বললো,
মীরু, আমার পাজামার ফিতায় গিট্টু লেগে গেছে ! প্লিজ, হেল্প মি...!! তখনই বুঝে গিয়েছিলাম, পাগল! সব পাগল!!
সাজিদ আর কাব্যকে অনেক বুঝিয়ে বাসায় রেখে আমি রওনা দিলাম। ছুটির দিনে রাজপথ এতো ফাঁকা ! রিক্সা চলছে পঙ্খীরাজ ঘোড়ার মত। বাতাসে আমার ভেজা চুল উড়ছে ! কি অনাবিল ভাললাগায় আমার মন ভরে যাচ্ছে, শুধু এই খোলা বাতাসের ছোঁয়াটুকু পেয়ে। কিছু ভাল লাগা শুধুই একান্ত নিজের জন্য হওয়া উচিৎ !
মায়ের কাছে বসে যা কিছু শুনলাম তার সারমর্ম হলো, বাবা এমন কিছু একটা আলমারীতে রেখেছেন যা মাকে দেখাচ্ছেন না। মা দেখে ফেলবেন এই কারনে বাবা আলমারীর চাবীটাও লুকিয়ে রাখছেন। মা আমাকে পাশে বসিয়ে এমনভাবে কথাগুলো বলছেন, যেন একজন ডাক্তারের কাছে কোন রোগী তার সমস্যার বর্ননা দিচ্ছেন।
আর আমিও খুব ধৈর্য্য নিয়ে মায়ের কথাগুলো শুনছি।
-শোন মীরা, প্রথম খটকা খেলাম গত সপ্তায়। বিয়ের চল্লিশ বছর পর কোন উপলক্ষ্য নেই অথচ তোর বাবা আমার জন্য এক তোড়া লাল গোলাপ নিয়ে হাজির ! সাত সকালে হাটতে গিয়ে লাল গোলাপ হাতে ফিরলো ! মুখে মুচকি হাসি দিয়ে আমার হাতে গোলাপ তুলে দিল ! যে মানুষ জীবনে আমার জন্য একটা কচুপাতাও হাতে করে আনেনি, সে আনলো কিনা লাল গোলাপ!!
-মা, মানুষের মন একেক বয়সে একেক রং ধরে। বাবা যা আগে করেনি তা এখন করতে তার মন বলছে। এতে সমস্যা কেন খুঁজছো?
-কিন্তু গতকাল? আমি দরজা খুলতেই উনি গাল মুখ লজ্জায় লাল করে আমাকে বলে, আই লাভ ইউ, শেফু !
বিয়ের আগেও তো এমন করে লাভ ইউ বলেনি ! আর আমার নাম শেফালী আকতার। উনি আমাকে এতোকাল পরে বলে,শেফু !! কি নাটক !
-মা, মানুষের প্রথম জীবনটা কত সংগ্রাম করে সংসার করতে হয় ! বাচ্চারা ছোট, তাদের ভবিষ্যৎ চিন্তা, টাকা পয়সার টানাটানি, তখন ইচ্ছে করলেও মানুষ হয়তো ভালবাসার কথা মুখে বলতে পারেনা। মনের ক্লান্তির কাছে অনেক কিছু চুপ হয়ে যায়, মা। এখন বাবার অবসর, দুটো মেয়েকে ভাল বিয়ে দিয়ে নির্ভার জীবন শুধু তোমাদের দুজনের। এখন তো বাবা একটু রোমান্টিক হতেই পারেন! যে কথা এতোদিন বলা হয়নি, তা আজও বলতে হবেনা এমন তো কোন কথা নেই।
-আর আলমারী ? কি আছে ওখানে ? দিনের মধ্যে তিন-চারবার আলমারী খুলে চুপিচুপি কি যেন দেখে ! আমাকে দেখলেই ধপ্ করে চাবী মেরে অন্যদিকে হাটে ! প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যায় !
-আলমারীতে হয়তো বাবার কোন জরুরী কাগজ থাকতে পারে যা তোমার না দেখলেও চলবে। তাই বাবা তোমাকে শেয়ার করে না।
-বললেই হলো? যে মানুষের রুমালটাও আমি ভাজ করে আলমারীতে রাখতাম, বের করে দিতাম, সে আজ আমাকে তার আলমারীর চাবী লুকায়? কেন? কি এমন রত্ন আছে সেখানে?
-তোমার কি মনে হচ্ছে? কি আছে বলে তোমার ধারনা হচ্ছে, মা?
-আমার ধারনা মিথ্যা হবে না, মীরা । খুবই লজ্জার কথা, তবু শোন, তোর বাবার অপকর্মের সাক্ষী আছে ওখানে ! হয়তো কারো ছবি, গোপনে বিয়ের কাবিননামা, কিংবা চাপে পড়ে সহায় সম্বল সব উইল করে দেবার দলিল !
-মা, এ জীবনে কতবার তুমি বাবাকে সন্দেহের কাঠগড়ায় দাড় করালে ভেবে দেখো ! প্রতিবারই তুমি ভুল প্রমানিত হলে, তবু তোমার ভুল ভাঙ্গলো না?
-আমি ভুল? তোর বাবা তুলসী পাতা?
-আমার বাবা তুলসী পাতা কিনা জানিনা, তবে আমার কাছে আমার বাবা নিম পাতা। তিতা হলেও শুদ্ধ।
-আর আমি?
-তুমি আমার বাবার লাল গোলাপ! কোমলতায় ভরা কিন্তু সন্দেহের কাঁটায় ভরপুর..! হি হি হি...
-মীরা !!
-মা, মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে তুমি রাতের অন্ধকারে তোমার বাবার রাজপ্রাসাদ থেকে আমার বাবার টিনের ঘরে নেমে এসেছিলে !! কতটা ভালো তুমি বাবাকে বাসো আমরা দু'বোন তা জানি । এই অতি ভালবাসা আর জীবনটা কেবলমাত্র বাবাকেন্দ্রীক করাতে তুমি ভালবেসেও সবসময় বাবাকে হারানোর ভয়ে থেকেছো, পাওয়ার আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখেছো।সন্দেহ খুব খারাপ অসুখ, মা। এ অসুখের ওষুধ হলো বিশ্বাস আর আস্থা !
-তুই এতো বড়দের মত কথা বলছিস কেন, মীরা?
-সময় আমাকে বড় করে দিয়েছে তাই। আমার এখন পয়ত্রিশ, আপার আটত্রিশ। আমরা তো বড়ই হয়ে গেলাম ! এবার তুমি একটু বড় হও, মা। বাবা সারাজীবন শুধু তোমাকেই ভালবেসেছেন, এখনও। তাই তো তোমরা চল্লিশ বছর পাশাপাশি আছো। বাবার লাল গোলাপ, আই লাভ ইউ বলার মাঝে কোন রহস্য নেই, আছে ভালবাসা !
-আর আলমারী?
-ওখানেও হয়তো ভালবাসা আছে। আমি সেটা দেখছি ।
আমি বাবার কাছে গেলাম। বাবা বললেন,
-আমি তোদের সব কথা শুনেছি। সোফার গদির তলে আলমারীর চাবী আছে, তোর মাকে সাথে করে খোল। আর শোন্ মীরা, মাকে বেশী শক্ত কথা বলিস না, কষ্ট পাবে! খুব সাদা মনের মানুষ রে !
মাকে নিয়ে আলমারীর চাবী খুললাম। প্রথমেই চোখে পড়লো এক কিশোরী কন্যার সাদাকালো ছবি, স্টুডিওতে তোলা। মা লজ্জায় বেগুনী ! তার কৈশরের ছবি দেখে। বাবার সাজানো কাপড়ের মাঝে মা-ই উদ্ধার করলেন সেই রহস্য, যা নিয়ে এতো কাহিনী ! সেটা হলো একটা বই । বইয়ের নাম, "স্বামী-স্ত্রী সুখী হবার গুরুত্বপূর্ন পরামর্শ"!! মা প্রথম পাতা উল্টিয়েই লাল গোলাপ আর লাভ ইউ বলার ফজীলত খুঁজে পেয়ে আবার বেগুনী হতে থাকলেন।
এখন আমাকে বাসায় ফিরতে হবে। মাকে বললাম,
-প্রতিটা মানুষের নিজস্ব একটা জগৎ থাকতে হয়,মা । সে জগতের বাসিন্দা শুধু সে একা। স্বামী-সংসার, ছেলেমেয়ে সব কিছুর মাঝেও নিজের জন্য একটা ভুবন । নিজের সাথে কথা বলা, নিজের মনে পথচলা...। একজন মানুষকে ভালবেসে এভাবে আকড়ে ধরতে নেই যাতে মানুষটার দম বন্ধ হয়ে আসে, আবার নিজেরও দম ফুরিয়ে যায়। তাকে মুক্ত আকাশে ছড়িয়ে দাও, যদি ভালবাসা খাঁটি হয় তবে দিনশেষে সে তোমার কাছে ফিরবেই।
-এতো পেকে গেলি কবে রে?
-এই গরমে পেকে গেলাম!
-আবার কবে আসবি?
-কাল আসবো। তোমার জন্য কিছু ফুলগাছের টব, আর বই নিয়ে আসবো। তুমি গাছের চর্চা করবে, ফুল ফুটলে মন ভালো হবে! বই পড়লেও মন ভাল হবে! সেই ভালো মনের কোনে দুস্টু সন্দেহগুলো উঁকি দেবার সুযোগই পাবে না !!
-বাইরে তো ঝুম্ বৃষ্টি, মীরা !
-তাতে কি? ঝড় হলে ভাবতাম বের হবো কিনা? বৃষ্টির মোহনীয়তা আমি উপেক্ষা করবো কেন, মা !
রিক্সার হুড ফেলে ঝুম্ বৃষ্টিতে ভেজার কি যে আনন্দ ! সে আনন্দ উপভোগ করতে হয় নিজর মনে, নিজের সনে ! পাশে আরেকজন থাকলে হয়তো আরো ভাল লাগতো ! কিন্তু তার তো সাইনাসের প্রবলেম থাকতেই পারে। আমি কেন আমাকে বঞ্চিত করবো? অন্যে কি করে বুঝবে আমার আনন্দের উৎস কোথায়?
(সমাপ্ত)