জীবনের ঘাত প্রতিঘাত
- Not a so Called LOVE Story Just it helps to realize; Life is flowing river with good and bad times but never back down at bad times
- Not a so Called LOVE Story Just it helps to realize; Life is flowing river with good and bad times but never back down at bad times
সকাল নয়টা পঁয়তাল্লিশে রিনি পৌঁছে গেল অঙ্কিতার নির্দেশিত অফিসে। ইণ্টারভিউ যদিও সাড়ে দশটায় তবু কলকাতার জ্যামে পড়লে তা এগারোটা বাজলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মা বারবার বলেছিল প্রথমদিন বাবাকে সঙ্গে নিয়ে আসার জন্য কিন্তু রিনিই জেদ ধরেছিল সে একা আসবে। আসলে সে বরাবরই স্বনির্ভরশীল মেয়ে। তাই চাকরি জীবনেও সে নিজেই নিজের পরিচিতি বানাতে চায়। মুখে যদিওবা তখন বড় বড় বুলি আউড়ে বাবা মাকে শান্ত করেছিল কিন্তু এখন কেন জানি মনে হচ্ছে সেল্ফ কন্ফিডেন্সটা একটু হলেও ওর সাথে বেইমানি করছে। তা ওই বেচারারও বা কি দোষ!!! রিনি থোড়াই না তখন বুঝতে পেরেছিল এরকম হবে। সাততলা বিল্ডিংয়টার সামনে আসতেই হাটুঁতে অল্প কাঁপুনির অনুভব করেছিল। যাইহোক এখন আর কিইবা করা যাবে, বসে বসে তাই তাপানুকুল কক্ষেও রুমাল দিয়ে কপালের হাল্কা ঘাম মুছছিল।
দশটা বেজে পনেরো মিনিট নাগাদ রিসেপশনিস্ট মহিলা ওকে নিজের সমস্ত ডকুমেন্ট সমেত দোতলায় সি.ই.ওর কেবিনে যেতে বললেন। এই বিল্ডিংয়ে মোট চারটি অফিস আছে তাই দোতলায় পৌঁছে সারি সারি এতোগুলো রুমের মধ্যে কোনটা সি.ই.ওর কেবিন বুঝতে না পেরে কাকে জিজ্ঞেস করবে ভাবছিল এমন সময় দেখে স্যুট টাই পরিহিত এক যুবক ওকে পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বয়স প্রায় আঠাশ ঊনত্রিশের কাছাকাছি হবে। মনে সাহস সন্চয় করে রিনি ওকেই জিজ্ঞেস করল,
"এক্সকিউজ মি!!"
"ইয়েস" ঘাড় ঘুরিয়ে হাল্কা ভ্রু কুচঁকে জিজ্ঞেস করল ছেলেটা।
"আপনি কি একটু বলে দিতে পারবেন "চ্যাটার্জী এন্ড সনস্" এর সি.ই.ওর কেবিনটা কোথায়?" নার্ভাস স্বরে বলল রিনি।
ছেলেটি একবার রিনিকে আপাতমস্তক জরিপ করে বাঁদিকে একটা রুম দেখিয়ে দিল।
"থ্যাংক ইউ"।
ভদ্রতাস্বরূপ ছেলেটি হাল্কা হেসে চলে গেল।
রিসেপশনিস্ট মহিলা আগেই রিনিকে বলেছিলেন স্যার যেহেতু একটা মিটিংএ আছেন তাই সে যেন কেবিনে একটু ওয়েট করে।
এই আর্কিটেকচারাল ফার্মটার যে ভালোই নামডাক আছে তা এই কেবিন দেখেই বোঝা যায়। ঝাঁ চকচকে মর্ডান ইন্টেরিয়রে তৈরি রুমটি আভিজাত্যে মোড়া। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে ঘুরে আগুন্তূককে দেখে হতভম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে রিনি। এতো সেই ছেলেটা যে ওকে রুমটি দেখিয়ে দিয়েছিল।
"বসুন"। বলে ছেলেটি সি.ই.ওর চেয়ারে গিয়ে বসল।
"নমস্কার, আমি রিনি সেনগুপ্ত।" গলার স্বর যথাসম্ভব নরমাল রাখার চেষ্টা করে বলে সে।
"দেখুন, এমনিতে আমি কাউকে বিনা ইন্টারভিউয়ে সিলেক্ট করি না, কিন্তু যেহেতু আপনি আমার বোনের চাইলহুড ফ্রেন্ড আর ও রিকোয়েস্ট করছিল তাই...." গম্ভীরস্বরে কথাগুলো বলে থামল ছেলেটি।
রিনির মুখে স্পষ্ট অসন্তুষ্টির ছাপ। শুধুমাত্র বোনের বেস্টফ্রেন্ড মানে!! ওর রেজাল্টের কোনো ভ্যালু নেই নাকি!! পইপই করে অঙ্কিতাকে বলেছিল কোনো ধরনের কোনো পার্সোনাল রেফারেন্স না দিতে কিন্তু মেয়েটা শুনলে, তবে তো !!!
"আপনি চাইলে আমার একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন চেক করতে পারেন।" রিনি শান্তস্বরে উত্তর দিয়ে ওর বায়োডাটার ফাইল এগিয়ে দিল।
"নো নিড, আমার যা যা জানা দরকার আমি অঙ্কিতার কাছে জেনে নিয়েছি। আপনি আজ থেকেই কাজে জয়েন করতে পারেন।" বলে টেবিলের ল্যান্ডফোনে ওপ্রান্তের কাকে যেন কেবিনে আসতে বলল।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মাঝবয়েসী এক ভদ্রমহিলা চলে এলেন।
"মিসেস মিত্র, ইনি হচ্ছেন আমাদের ফার্মের নতুন প্রজেক্ট ডিজাইনার মিস্ রিনি সেনগুপ্ত ।আজই জয়েন করেছেন। আপনি উনাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিন।"
"সিওর স্যার"। বলে মহিলাটি রিনিকে নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন।
কেবিন থেকে বেরিয়ে প্রায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল রিনি। সত্যি বাবা, মানুষকে যে প্রথম দেখায় চেনা যায় না তা আজ হাড়ে হাড়ে টের পেল সে। ছেলেটিকে প্রথম দেখায় কি মিষ্টি মনে হয়েছিল আর এখন মনে হচ্ছে ব্রেকফাস্টে করলাসেদ্ধ খেয়ে এসেছে। মিসেস মিত্র ওর অবস্থা দেখে অল্প হেসে বললেন,
"চিন্তা করো না, অর্কস্যার বাইরে এমন কিন্তু মানুষ ভালো। ভীষণ হেল্পফুল। তবে কাজের ব্যাপারে খুব স্ট্রিক্ট। তুমি নিজের কাজগুলো ঠিকমতো করো, তাহলেই দেখবে কোনো প্রবলেম হবে না।"
এই মহিলাকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগেছিল রিনির। অদ্ভুত এক আন্তরিকতা আছে উনার মধ্যে। খুব সুন্দর ভাবে সবকিছু বুঝিয়ে দিলেন। রিনিও মনোযোগ দিয়ে সবকিছু বুঝে নিতে লাগল। ওকে প্রুভ করতেই হবে শুধুমাত্র অঙ্কিতার বান্ধবী ছাড়াও ওর যথেষ্ট যোগ্যতা আছে এই পোস্টে কাজ করার।
দিনগুলো ভালোই কাটছিল রিনির। শুরুতে অর্কদীপ চ্যাটার্জীকে যতটা খারাপ ভেবেছিল, ততটা খারাপ নয়। তবে অসম্ভব পাংচুয়াল আরকি। রিনি এক এক সময় ভাবে ছেলেটি যেন বয়সের তুলনায় একটু বেশিই ম্যচিয়র। অবশ্য ওর তাতে কি!!!
এমনই একদিন রিনি অফিসের ক্যান্টিনে বসে কফি খাচ্ছিল, শুনতে পেল দুজন মেয়ে অর্কদীপকে নিয়ে আড্ডায় মশগুল। ব্যাপারটা নতুন কিছু না।এই অফিসে জয়েন করার পর থেকেই সে দেখে আসছে মেয়েদের কাছে অর্কদীপ চ্যাটার্জী 'হট টপিক'। অবশ্য তা ভুল কিছু না। 'টল,ফেয়ার এন্ড হ্যন্ডস্যম' বলতে যা বোঝায়, অর্কদীপ হচ্ছে তারই সংমিশ্রণ। রিনিও যে ওর 'কিলিং স্মাইলে' হঠাৎ হঠাৎ হোঁচট খায় না, এমনটা নয়। কিন্তু ও নিজের সীমানা মাপতে জানে। তাই এই বিষয়টি সে এড়িয়েই চলে।
মেয়ে দুটোর কথাতে বিশেষ পাত্তা না দিলেও হঠাৎ একটা কথা এসে ওর কানে লাগল। অর্কস্যার নাকি একটা নতুন প্রজেক্টের কাজে বাইরে যাচ্ছেন আর উনাকে এসিস্ট করার জন্য মনোজ বলে অফিসেরই একজন যাচ্ছে। মানে!!! প্রজেক্ট ডিজাইনার রিনি না মনোজ? আর মনোজ তো একাউন্ট ডিপার্টমেণ্টের!!
"আসতে পারি স্যার?" দরজায় হাল্কা টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করে রিনি।
"আসুন" ল্যপটপ থেকে চোখ না সরিয়ে বলে অর্কদীপ।
"যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা জিজ্ঞেস করব?"
রিনির গলায় উষ্মা অনুভব করেই হয়তো অর্কদীপ ল্যপটপ ছেড়ে ওর দিকে তাকাল।
"আমি কি জানতে পারি প্রজেক্ট ডিজাইনার আমি হওয়া সত্বেও মনোজ কেন আপনাকে এসিস্ট করবে? আপনি কি এখনো মনে করেন শুধুমাত্র অঙ্কিতার বান্ধবী বলে আমি এই চাকরি পেয়েছি? সত্যিই আমার কোনো যোগ্যতা নেই। নাকি মেয়ে বলে আমার সঙ্গে এই পক্ষপাতিত্ব?" বলতে বলতে চোখে জল এসে গেল রিনির।
অর্ক কিছুক্ষণ রিনির দিকে তাকিয়ে হাল্কা হেসে বলল, "মিস সেনগুপ্ত, আপনাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আপনার বাড়ি থেকে মানবে কি দুদিনের জন্য শহর ছেড়ে অন্য জায়গায় যেতে?"
সত্যিই তো। এই কথাটা তো রিনি ভেবে দেখেনি একবারও। যে মা একরাতের জন্যও রিনিকে কাছছাড়া করে না, দুদিনের জন্য পারমিশন চাওয়া তো রীতিমতো বাঘের মুখে হাত ঢোকানোর বরাবর। কিন্তু এই কথাটা অর্ক বুঝলো কিভাবে? ও হ্যাঁ, মা যে দিনে মিনিমাম তিরিশবার ফোন করে সেটা দেখেই হয়তো বুঝেছে। কিন্তু এখন পিছিয়ে যাওয়া মানে তো অর্কদীপ চ্যাটার্জীর সামনে নিজের হাতে প্রেস্টিজটাকে পাংচার করা!! অগত্যা মাকে যেনতেন প্রকারেন রাজি করাতেই হবে।
বাড়িতে প্রায় কার্গিল যুদ্ধ বাঁধিয়ে, অবশেষে মাকে রাজি করিয়ে, নির্দিষ্ট দিনে সন্ধে নাগাদ পুরী পৌঁছালো অর্ক আর রিনি। পরদিন প্রজেক্টের যাবতীয় কাজ শেষ করতে করতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে গেল। হোটেলে ফিরে লাঞ্চ সেরে অর্ক রিনিকে রেস্ট নিতে বলে নিজের রুমে চলে গেল।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে রিনি ভাবছিল, আগামীকাল সকালেই তো ফিরে যাওয়া তাই আজকের সূর্যাস্তটা মিস করা চলবে না কোনোমতেই। সমুদ্রনগরীতে এসে বিকেলের সূর্যাস্ত না দেখে থাকা যায়!!! আর এখন তো কোনো কাজও নেই।
তন্ময় হয়ে সমুদ্র আর সূর্যের লুকোচুরি খেলা দেখছিল রিনি, হঠাৎ একটা পরিচিত আওয়াজে পিছন ফিরে দেখল অর্ক ওরই দিকে তাকিয়ে আছে। আজ অবধি অর্ককে শুধু অফিসের ফরমাল পোশাকেই দেখেছে রিনি, এই প্রথম ক্যাজুয়াল পোশাকে দেখল। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় কি অপূর্ব লাগছে অর্ককে। কিছুক্ষণের জন্য রিনির মনে হলো পৃথিবীটা যেন থমকে গেছে।
"আপনার কি সানসেট ভালো লাগে?"
অর্কর প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরে এলো রিনির। তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিল।ভীষন লজ্জা লজ্জা লাগছিল রিনির। ইসসস...না জানি কি ভাবলো অর্ক। হয়তো ভাবছে রিনিও অফিসের অন্য মেয়েদের মতো হ্যাংলা।
"বললেন না তো?" আবার জিজ্ঞেস করল অর্ক।
"হ্যাঁ। ছোটবেলা অনেকবার এসেছি বাবা মায়ের সঙ্গে। সমুদ্র বরাবরই আমার ভীষণ প্রিয়। আপনারও কি তাই?" হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল রিনি।
"অতোটা না। একচ্যুয়ালি আমার পাহাড় পছন্দ। কলেজ লাইফে সময় পেলেই পাহাড়ে ট্রেকিং করতে বেরিয়ে পড়তাম"।
"আর এখন?" রিনি লক্ষ্য করল মুহুর্তের জন্য যেন একটুকরো কালো মেঘ এসে আবার মিলিয়ে গেল অর্কর মুখ থেকে।
"এখন আর হয়ে ওঠে না।" হাল্কা হেসে বলল অর্ক।
গল্পে গল্পে কখন যে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হয়ে এলো দুজনেই বুঝতে পারল না। এই প্রথম রিনি অর্ককে এতো কথা বলতে শুনলো, প্রাণ খুলে হাসতে দেখলো। অদ্ভুত এক ভালোলাগা ঘিরে ধরলো রিনিকে।