সিক্তার সঙ্গে আমার পরিচয় কলেজ থেকেই। সেই থেকেই আমাদের প্রেম। মাঝে মাঝেই আমার মনে হত কোন কুক্ষণে যে সিক্তার প্রেমে পড়েছিলাম! উফ! জান কয়লা কয়লা করে দিল গো! এই মেয়ের মাথার পেছন দিকেও মনে হয় একজোড়া চোখ আছে। পাশ দিয়ে দেখতে সুন্দর, এমন কোনো মেয়ে হেঁটে গেলে নিজের অজান্তেই তো চোখ চলে যায় মেয়েটার দিকে, সন্ন্যাসী তো আর নই! সিক্তা কি করে যেন ঠিক টের পেয়ে যায়। আমাকে বলে ... "
"ওই মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছিলে কেন?"
"কোন মেয়েটা!" আকাশ থেকে পড়ি আমি।
"ন্যাকামি করছ? নিজেকে বেশী চালাক ভাবো?"
"মানে?"
"কি ভেবেছ? ওই পাশটাতে আমি ফুচকা খাচ্ছিলাম বলে দেখতে পাই নি!? আমি সব দেখেছি। শর্টস পরা বেহায়া মেয়েটা পাশ দিয়ে হেঁটে গেল, আর তুমিও হাঁ করে তাকিয়ে থাকলে।"
"আচ্ছা জ্বালা তো! সুন্দর দেখতে, তাই তাকিয়েছি, সুন্দর ফুল দেখলেও তো তাকাই। তাতে কি?"
"ফুল আর ওই মেয়েটা এক হল? মেয়েটা সুন্দর, আর আমি! আমি কি! বল! ওই মেয়েটার মত সুন্দর নই, তাই তো! সেজন্যই তো আমি পাশে থাকতেও মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলে!"
"তুমি কিন্তু ইচ্ছে করে ঝগড়া করছ। চোখ যখন আছে, একটু তাকিয়েছি, তাতে দোষ কোথায়? আমি কি মেয়েটার সাথে প্রেম করতে যাচ্ছি!"
ঝগড়ার এই পর্যায়ে সিক্তার চোখ ছলছল করবে, গলা ভারি হয়ে আসবে, ঠোঁট কাঁপবে, তারপরেই শেষ অস্ত্র এবং একেবারে মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করবে।
"হ্যাঁ, প্রেম করতে যাওয়াই বাকি রাখলে! তাই কর গিয়ে! আমার সাথে আজ থেকে আর কোনো যোগাযোগ রাখবে না। আমি তোমার কেউ হই না।"
কথাটা বলেই সিক্তা হনহন করে হাঁটা দেবে। আমি আকুল হয়ে ডাকলেও আর সাড়া দেবে না। একবারও পেছন ফিরে তাকাবে না।
এর পরের সাত দিন সত্যিই ওর সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করা যাবে না। আর আমার কাছে এই সাত দিন সাত বছরের মত কাটবে। যদিও আমি বুঝি, সিক্তা আমাকে খুব ভালোবাসে বলেই এমন ছেলেমানুষি করে।
বিরহটা যখন আমার কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে, সেই জ্বালায় আমিও সিক্তাকে জব্দ করার নানান ফন্দি আঁটি, তখনই ওর ফোন আসে, এবং অনেক কান্নাকাটি আর অনেকবার স্যরি বলার পরেও সে কিন্তু বলতে ভোলে না,
"আর কখনো কোনো মেয়ের দিকে তাকাবে না তো! আমার একদম ভালো লাগে না।"
দেঁতো হাসি হেসে আমাকে বলতেই হয়, "আর তাকাবো না, ঠিক আছে!"
সবচেয়ে আশ্চর্য এই যে, এত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও আমাদের সম্পর্কটা টিকে আছে পাঁচ বছর ধরে। কারণ আমরা দুজনেই একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতেই পারি না। সিক্তা যতই অবুঝ হোক, আর আমি যতই বিরক্ত হই ওর অবুঝপনায়, তবু সিক্তাকে ছাড়া আমার এক মুহূর্তও চলে না।
এইভাবেই দেখতে দেখতে আরও কয়েকটা বছর পার করে ফেললাম আমরা। আর সেই সময়টায় কখনও মসৃণ রাস্তায় গড়গড় করে ছুটেছি আমরা, আর কখনও উঁচু নিচু রাস্তায় হোঁচট খেতে খেতে ছুটেছি, তবু কেউ কারো হাত ছাড়ি নি।
এখন আমি চাকরি খুঁজছি হন্যে হয়ে, তবু মনের মত একটা চাকরি জোগাড় করতে পারছি না। বাড়িতে এজন্য অনেক কথা শুনতে হচ্ছে। নিজের হাতখরচের জন্যও অন্যের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। বন্ধুদের কাছে প্রচুর ধার করেছি, কিভাবে শোধ করব জানি না।
সেরকম সময়ে একদিন ব্যাঙ্কের একটা চাকরির রিটেন টেস্ট দিয়ে বেরিয়ে আসছি, বাইরে রাস্তায় দেখি সিক্তা দাঁড়িয়ে আছে।
"কি ব্যাপার? তুমি এখানে?"
দুচোখে হাসির ফুলঝুরি নিয়ে সিক্তা বলে, "সারপ্রাইজ!!"
"কেন?" মনে মনে অল্প বিরক্ত হই আমি। কিচ্ছু ভালো লাগে না এখন আমার। কবে যে একটা উপযুক্ত চাকরি পাবো!
"কেমন হয়েছে পরীক্ষা?" সিক্তা জিজ্ঞেস করল।
"ওই প্রতিবারের মতই। জানি না কি আছে কপালে।"
"আরে, এভাবে হতাশ হয়ে পড়ছ কেন? ঠিক একটা কিছু হয়ে যাবে, দেখো!"
আমি আর কিছু বললাম না। রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকলাম দুজনে। একসময় সিক্তা জিজ্ঞেস করল,
"খিদে পেয়েছে তোমার? সকালের পর থেকে নিশ্চয়ই কিছু খাও নি!"
"না না, আমার খিদে পায় নি তো! "তাড়াতাড়ি বললাম আমি।
হঠাত রাস্তার পাশে একটা রেস্টুরেন্ট দেখে সিক্তার আবদার,
"এই, চলো না, ওই রেস্টুরেন্টে কিছু খাই!"
"কি খাবে? আমার খিদে নেই কিন্তু!"
"আমার আছে তো। চল!"
প্রবল অনিচ্ছে সত্বেও সিক্তার আবদার রাখতে আমাকে ঢুকতেই হল ওখানে। মনে মনে সিক্তার মুন্ডুপাত করছি, আমি মরছি নিজের জ্বালায়, আর ওনার আহ্লাদ দেখো! কবে যে ওর বুদ্ধি হবে!
রেস্টুরেন্টের বয় মেনু কার্ড দিয়ে গেল। বাপরে, কত দাম! পকেটে কত টাকা পড়ে আছে, মনে মনে একটা হিসেব করি। সব দেখে টেখে এক প্লেট মোগলাই পরোটা অর্ডার করলাম।
"এক প্লেট কেন?" সিক্তা ভুরু কোঁচকায়।
"আমি খাবো না, খিদে নেই আমার। তুমি খাও।" বিরক্তি চেপে আমি বললাম।
"না না, সে হবে না। আরেক প্লেট অর্ডার কর।"
বলেই আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে সিক্তা নিজেই আরেক প্লেট অর্ডার করে দিল। ওর এই অবুঝপনায় সত্যি আমার খুব রাগ ধরছে এখন। একবার জিজ্ঞেসও করল না, আমার কাছে অতো টাকা আছে কি না! এখন বিল দেব কি করে! সব টাকাই যে খরচ হয়ে যাবে! আমার চলবে কি করে তবে!
মোগলাই পরোটা এল। সিক্তা খুশী খুশী মুখ করে খাচ্ছে। আমিও খাচ্ছি, খুব খিদে পেয়েছিল আসলে। আমার খাওয়া শেষ হতেই সিক্তা বলল,
"আর কিছু খাবে?"
"না না, আর কিছু লাগবে না।"
সিক্তা আমার দিকে তাকিয়েছিল। কি মায়ায় ভরা দুটো চোখ। ও কি বুঝতে পেরেছে, আমার খুব খিদে পেয়েছিল!