১৫৩৮ সাল নাগাদ বাংলায় শুরু হয়েছিল পাঠান আফগানদের রাজত্ব৷ আফগান নেতা শের খান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহকে ১৫৩৮ সালের এক যুদ্ধে পরাজিত করে সর্বপ্রথম গৌড় দখল করেন। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দের শেষ পর্যন্ত মুঘলদের কাছে পরাজিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দাউদ খান কররানী ছিলেন বাংলার শেষ আফগান শাসক। এ সময় আফগানদের রাজ্যসীমা দক্ষিণ চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৫৭৬ সালে মুঘল সেনাপতি খান জাহানের কাছে দাঊদ খান পরাজিত হলে পুরো চট্টগ্রাম ত্রিপুরা এবং আরাকান রাজদের লোলুপ দৃষ্টিতে পড়ে। আর এরই সাথে শুরু হয় চট্টগ্রাম দখলের চোর পুলিশ খেলা। গোলমাল বাঁধে ত্রিপুরা এবং আরাকান রাজ্যদ্বয়ের মধ্যে। মধ্যযুগের চট্টগ্রাম দখল নিয়ে ত্রিপুরা-আরাকান যুদ্ধ এর গল্পই আজকের নিবেদন।
মুঘলদের হাত হতে বাংলা বেহাত হওয়ার ফলে চট্টগ্রামে যে একটা শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিরক্ষা ছিল তা ভেস্তে যায়। সমসাময়িক সময়ে ত্রিপুরা এবং আরাকান দুই রাজ্যেই পরম সাহসী দুই রাজার উত্থান হয় এবং দুজনেই চটগ্রামকে তাদের স্বীয় সাম্রাজ্যভুক্ত করতে পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তাভাবনা করতে থাকেন। ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে অমর মাণিক্য নামে এক রাজা ত্রিপুরার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হোন।
অমর মাণিক্য
তিনি ১৫৮৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। রাজমালা থেকে জানা যায় তিনি তার ছেলে রাজধর নারায়ণকে প্রধান সেনাপতি করে আরাকান দখলে এক অভিযান প্রেরণ করেন। এই অভিযানে রাজধরের ছোটভাই অমর দুর্লভ নারায়ণ, সেনাপতি চন্দ্রদর্প নারায়ণ এবং ছত্রজিত নাজিরকে প্রধান সেনাপতির সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়৷ এ বাহিনী সঙ্গে দ্বাদশ বাঙ্গালা এবং ফিরিংগী সৈন্যরাও ছিল৷ এ বাহিনী কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে সহজেই নদী পার হয়ে রামু, দেয়াং, উড়িয়া ইত্যাদি অঞ্চল জয় করে নেয়৷ এ সংবাদ পেয়ে এক বিশাল আরাকানী বাহিনী ত্রিপুরাদের গতিরোধ করে৷ এতে ত্রিপুরা বাহিনী ভীত হয়ে পড়ে এবং ফিরিংগীরা যুদ্ধে অংশ নিতে অনীহা প্রকাশ করে। ফলে সহজেই আরাকানীরা তাদের হারানো অঞ্চল পুনরূদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এ সময় আরাকানের মসনদে ছিলেন রাজা মেং ফলৌং৷ শুনা যায় তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং তার নাম ছিল সিকান্দার শাহ৷ ত্রিপুরা বাহিনীর সাথে তার রননৈপূণ্যের প্রমাণ পাওয়া যায়৷ ওদিকে ত্রিপুরা বাহিনী আরাকানীদের নিকট পরাজিত হলেও তারা যুদ্ধে ক্ষান্ত না দিয়ে নতুন করে যুদ্ধে জড়ানোর প্রস্তুতি নিতে থাকে। আরাকানী গোয়েন্দাবাহিনী খবর পায় যে ত্রিপুরা বাহিনী পর্যাপ্ত রসদ না নিয়েই এ যুদ্ধে এসেছে। এই তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে ত্রিপুরা বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে এবং আরাকানীদের প্রথম আক্রমণেই দিশেহারা হয়ে যায়। আরাকানী সৈন্যরা ত্রিপুরাদের তাড়িয়ে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত ধাওয়া দিয়ে আসে৷ এসময় ত্রিপুরাদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়, অনেক সৈন্য মারা যায়। আরাকানী বাহিনী নদী পার হয়ে উত্তর চট্টগ্রাম পর্যন্ত ত্রিপুরাদের ধাওয়া দিয়ে আসে। ধাওয়া খাওয়ার পরও ত্রিপুরা বাহিনী দমে না গিয়ে তাদের সেনাপতি দ্বারা আবার সুশৃঙ্খল হয়৷ যুদ্ধবাজ ত্রিপুরারা এসময় পালটা আঘাত হেনে আরাকানী বাহিনীকে পরাজিত করে ফেলে৷ এ পালটা আঘাতে অনেক আরাকানী সৈন্য নিহত হয়। এ পরাজয়ে ধূর্ত আরাকান রাজ মেং ফলৌং (সিকান্দার শাহ) তাঁর অধীনস্থ উড়িয়া রাজাকে সন্ধির প্রস্তাব টানেন। ত্রিপুরারাজও ছিলেন ক্লান্ত, তিনি নিজেও মনে মনে চেয়েছিলেন যুদ্ধবিরতির। তাই রাজা অমর মাণিক্য তার সেনাপতি রাজধর মাণিক্যকে যুদ্ধ বন্ধ করে ত্রিপুরায় ফিরে আসার নির্দেশ দেন। প্রকৃতপক্ষে আরাকান রাজ মেং ফলৌং সন্ধির ফাঁকেতালে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন এবং পর্তুগীজদের সাথে হাত মিলিয়ে পরবর্তী আঘাতের দিনগণনা করতে থাকেন৷ ওদিকে ত্রিপুররাজ এই খবর জানতে পেরে তার পুত্র যুবরাজ রাজধর মাণিক্যকে প্রধান সেনাপতি বানিয়ে আরাকানীদের বিরুদ্ধে এক অভিযান প্রেরণ করেন। ত্রিপুরার বাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে চতুর আরাকানরাজ মেং ফলৌং স্বর্ণ খচিত হাতির দাঁতের টোপর ও একটা চিঠিসহ দুজন দূতকে ত্রিপুরা শিবিরে পাঠান। এসময় রাজধর নারায়ণ মুকুট এবং তার ছোটভাই রাজদুর্লভ চিঠি পান। রাজদুর্লভ মুকুট না পেয়ে খুবই রাগান্বিত হোন এবং রাগে ফুঁসলাতে থেকে বলতে থাকেন, মগদেরকে শৃগালের মত হত্যা করে এরকম হাজার টোপর ছিনিয়ে নিয়ে আসব। দূত ফিরে গিয়ে এই কথা আরাকান শিবিরে জানালে রাজা মেং ফলৌং ত্রিপুরা শিবিরে হানা দিতে তার সেনাপতিকে নির্দেশ দেন এবং আবার ত্রিপুরা-আরাকান নতুন আরেকটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে৷ যুদ্ধের শুরুতেই রাজদুর্লভ হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে মারা যান। সেনাপতি শেলের আঘাতে আহত হন। আর এতে করেই ত্রিপুরা বাহিনী বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে এবং পরাজিত হয়ে যায়।
ফের যুদ্ধ এবং আরাকানীদের চট্টগ্রাম বিজয়
আরাকানীদের হাতে ছিল তখন রামু। রামুর শাসনকর্তা ছিলেন আদম শাহ৷ আরাকানীদের সাথে বিরোধের জের ধরে আদম শাহ পালিয়ে ত্রিপুরায় আশ্রয় নেন। আদম শাহকে ফিরিয়ে দিতে ত্রিপুরার রাজা অমর মাণিক্যের কাছে আরাকান রাজ আবেদন করলে তা প্রত্যাখান করেন অমর মাণিক্য৷ যার ফলে আবার আরেকটি যুদ্ধের দামামা বাজতে থাকে। চূড়ান্ত এ যুদ্ধে ত্রিপুরা রাজ্যের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। রাজা অমর মাণিক্য স্বয়ং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পরাজিত হয়ে জংগলে আশ্রয় নেন। আর ত্রিপুরার উদয়পুর পর্যন্ত আরাকানীরা দখল করে নেয়৷ রামুর শাসনকর্তা আদম শাহের ভাগ্যে কি ঘটেছিল তা অবশ্য জানা যায়নি। ব্রিটিশ পর্যটক রাল্ফ রিচ তার এক বিবরণীতে বলেছেন ১৫৮৬ সাল রামু ও চট্টগ্রাম আরাকানীদের অধীনে ছিল। সুনীতিভূষণ কানুনগো মনে করেন ১৫৮০ সালের আগেই আরাকানীরা চূড়ান্তভাবে চট্টগ্রাম বিজয় করে।
তথ্যসূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস-জামাল উদ্দিন, পৃষ্ঠা ৫০-৫১
মুঘলদের হাত হতে বাংলা বেহাত হওয়ার ফলে চট্টগ্রামে যে একটা শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিরক্ষা ছিল তা ভেস্তে যায়। সমসাময়িক সময়ে ত্রিপুরা এবং আরাকান দুই রাজ্যেই পরম সাহসী দুই রাজার উত্থান হয় এবং দুজনেই চটগ্রামকে তাদের স্বীয় সাম্রাজ্যভুক্ত করতে পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তাভাবনা করতে থাকেন। ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে অমর মাণিক্য নামে এক রাজা ত্রিপুরার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হোন।
অমর মাণিক্য
তিনি ১৫৮৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। রাজমালা থেকে জানা যায় তিনি তার ছেলে রাজধর নারায়ণকে প্রধান সেনাপতি করে আরাকান দখলে এক অভিযান প্রেরণ করেন। এই অভিযানে রাজধরের ছোটভাই অমর দুর্লভ নারায়ণ, সেনাপতি চন্দ্রদর্প নারায়ণ এবং ছত্রজিত নাজিরকে প্রধান সেনাপতির সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়৷ এ বাহিনী সঙ্গে দ্বাদশ বাঙ্গালা এবং ফিরিংগী সৈন্যরাও ছিল৷ এ বাহিনী কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে সহজেই নদী পার হয়ে রামু, দেয়াং, উড়িয়া ইত্যাদি অঞ্চল জয় করে নেয়৷ এ সংবাদ পেয়ে এক বিশাল আরাকানী বাহিনী ত্রিপুরাদের গতিরোধ করে৷ এতে ত্রিপুরা বাহিনী ভীত হয়ে পড়ে এবং ফিরিংগীরা যুদ্ধে অংশ নিতে অনীহা প্রকাশ করে। ফলে সহজেই আরাকানীরা তাদের হারানো অঞ্চল পুনরূদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এ সময় আরাকানের মসনদে ছিলেন রাজা মেং ফলৌং৷ শুনা যায় তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং তার নাম ছিল সিকান্দার শাহ৷ ত্রিপুরা বাহিনীর সাথে তার রননৈপূণ্যের প্রমাণ পাওয়া যায়৷ ওদিকে ত্রিপুরা বাহিনী আরাকানীদের নিকট পরাজিত হলেও তারা যুদ্ধে ক্ষান্ত না দিয়ে নতুন করে যুদ্ধে জড়ানোর প্রস্তুতি নিতে থাকে। আরাকানী গোয়েন্দাবাহিনী খবর পায় যে ত্রিপুরা বাহিনী পর্যাপ্ত রসদ না নিয়েই এ যুদ্ধে এসেছে। এই তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে ত্রিপুরা বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে এবং আরাকানীদের প্রথম আক্রমণেই দিশেহারা হয়ে যায়। আরাকানী সৈন্যরা ত্রিপুরাদের তাড়িয়ে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত ধাওয়া দিয়ে আসে৷ এসময় ত্রিপুরাদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়, অনেক সৈন্য মারা যায়। আরাকানী বাহিনী নদী পার হয়ে উত্তর চট্টগ্রাম পর্যন্ত ত্রিপুরাদের ধাওয়া দিয়ে আসে। ধাওয়া খাওয়ার পরও ত্রিপুরা বাহিনী দমে না গিয়ে তাদের সেনাপতি দ্বারা আবার সুশৃঙ্খল হয়৷ যুদ্ধবাজ ত্রিপুরারা এসময় পালটা আঘাত হেনে আরাকানী বাহিনীকে পরাজিত করে ফেলে৷ এ পালটা আঘাতে অনেক আরাকানী সৈন্য নিহত হয়। এ পরাজয়ে ধূর্ত আরাকান রাজ মেং ফলৌং (সিকান্দার শাহ) তাঁর অধীনস্থ উড়িয়া রাজাকে সন্ধির প্রস্তাব টানেন। ত্রিপুরারাজও ছিলেন ক্লান্ত, তিনি নিজেও মনে মনে চেয়েছিলেন যুদ্ধবিরতির। তাই রাজা অমর মাণিক্য তার সেনাপতি রাজধর মাণিক্যকে যুদ্ধ বন্ধ করে ত্রিপুরায় ফিরে আসার নির্দেশ দেন। প্রকৃতপক্ষে আরাকান রাজ মেং ফলৌং সন্ধির ফাঁকেতালে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন এবং পর্তুগীজদের সাথে হাত মিলিয়ে পরবর্তী আঘাতের দিনগণনা করতে থাকেন৷ ওদিকে ত্রিপুররাজ এই খবর জানতে পেরে তার পুত্র যুবরাজ রাজধর মাণিক্যকে প্রধান সেনাপতি বানিয়ে আরাকানীদের বিরুদ্ধে এক অভিযান প্রেরণ করেন। ত্রিপুরার বাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে চতুর আরাকানরাজ মেং ফলৌং স্বর্ণ খচিত হাতির দাঁতের টোপর ও একটা চিঠিসহ দুজন দূতকে ত্রিপুরা শিবিরে পাঠান। এসময় রাজধর নারায়ণ মুকুট এবং তার ছোটভাই রাজদুর্লভ চিঠি পান। রাজদুর্লভ মুকুট না পেয়ে খুবই রাগান্বিত হোন এবং রাগে ফুঁসলাতে থেকে বলতে থাকেন, মগদেরকে শৃগালের মত হত্যা করে এরকম হাজার টোপর ছিনিয়ে নিয়ে আসব। দূত ফিরে গিয়ে এই কথা আরাকান শিবিরে জানালে রাজা মেং ফলৌং ত্রিপুরা শিবিরে হানা দিতে তার সেনাপতিকে নির্দেশ দেন এবং আবার ত্রিপুরা-আরাকান নতুন আরেকটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে৷ যুদ্ধের শুরুতেই রাজদুর্লভ হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে মারা যান। সেনাপতি শেলের আঘাতে আহত হন। আর এতে করেই ত্রিপুরা বাহিনী বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে এবং পরাজিত হয়ে যায়।
ফের যুদ্ধ এবং আরাকানীদের চট্টগ্রাম বিজয়
আরাকানীদের হাতে ছিল তখন রামু। রামুর শাসনকর্তা ছিলেন আদম শাহ৷ আরাকানীদের সাথে বিরোধের জের ধরে আদম শাহ পালিয়ে ত্রিপুরায় আশ্রয় নেন। আদম শাহকে ফিরিয়ে দিতে ত্রিপুরার রাজা অমর মাণিক্যের কাছে আরাকান রাজ আবেদন করলে তা প্রত্যাখান করেন অমর মাণিক্য৷ যার ফলে আবার আরেকটি যুদ্ধের দামামা বাজতে থাকে। চূড়ান্ত এ যুদ্ধে ত্রিপুরা রাজ্যের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। রাজা অমর মাণিক্য স্বয়ং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পরাজিত হয়ে জংগলে আশ্রয় নেন। আর ত্রিপুরার উদয়পুর পর্যন্ত আরাকানীরা দখল করে নেয়৷ রামুর শাসনকর্তা আদম শাহের ভাগ্যে কি ঘটেছিল তা অবশ্য জানা যায়নি। ব্রিটিশ পর্যটক রাল্ফ রিচ তার এক বিবরণীতে বলেছেন ১৫৮৬ সাল রামু ও চট্টগ্রাম আরাকানীদের অধীনে ছিল। সুনীতিভূষণ কানুনগো মনে করেন ১৫৮০ সালের আগেই আরাকানীরা চূড়ান্তভাবে চট্টগ্রাম বিজয় করে।
তথ্যসূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস-জামাল উদ্দিন, পৃষ্ঠা ৫০-৫১