ওই, তোরে না সকালে বলে গেছিলাম আজ
তোর রান্নার পালা। রাঁধিস নাই ক্যান? তুই কি আজ
ক্লাসে না গিয়ে সকাল থেকেই ঘুমাচ্ছিস নাকি ? ওই
ওঠ ওঠ। নাইলে আজ দুপুরে তোর খাওয়া নাই।
আনিকা নামক এমপ্লিফায়ারের এহেন চিল্লাপাল্লায়
আমার ঘুম মাথায় উঠল। অবশ্য না খেতে দেয়ার হুমকি
আমার উঠে পড়ার জন্য যথেষ্ট। এমনিতেই আজ
সকালে ঘুম থেকে উঠে রাক্ষসের মত খিদা
লেগে গেছিল। ঘুম থেকে উঠে ঘড়ির দিকে
তাকাতেই মুখ হাসি হাসি হয়ে গেল। কারণ হল, তখন
নয়টা বাজতে দশ মিনিট বাকি । তার মানে ক্লাসে যাওয়া
লাগবেনা।
সুপারম্যানের মত কিংবা আয়রনম্যানের মত স্পিড
পাইলে হয়ত চিন্তা ভাবনা করতে দেখতাম। কিন্তু
আমার মত আলসেমির রেটিং এ ফাইভ স্টার পাওয়া
মেয়ের পক্ষে তা একেবারেই বেসম্ভব। মহা
আনন্দে আমি আবার বালিশে মাথা দিলাম , যদিও খিদায়
পেটের মধ্যে চো চো শুরু হইছে। ঘুমাইতে
পারলে খাওয়ার দুঃখ ভুলতেও রাজি আছি আমি।
সপ্তাহে একটা ছুটির দিন,তাও আবার কম্পিউটার
কোর্সের ক্লাসে যাওয়ার জন্য সকালবেলার অতি
শান্তির ঘুমটা হয়না ঠিকমত। ক্লাসে যাওয়ার আগে
আনিকা মনে হয় বলে গেছিল আমাকে রান্না করে
রাখার কথা, ঘুমের মধ্যে শুনেছি কি শুনিনাই আল্লাহ
মালুম। তাই আনিকা ফিরে চিল্লাপাল্লা শুরু করায় বেশিক্ষণ
বিছানায় থাকা নিরাপদ মনে হল না। তাই তাড়াতাড়ি উঠে রান্না
নামক ঝামেলাটা সেরে ফেলায় মন দিলাম।
..
আনিকা আমার রুমমেট, একটা হোস্টেলে থাকি
আমরা। দুজনেই বছর খানেক হল চাকুরী করি।
আনিকা ,যাকে বলে সেইরাম সুন্দরী। বিয়ে
হয়েছে কিছুদিন , তবে ওর হাজব্যান্ডের বদলির
চাকুরী হওয়ার কারণে এখন আপাতত অন্য জেলায়
আছে।কিছুদিনেই নাকি বদলি হয়ে আসবে,তখন
আনিকা সংসার শুরু করবে।
তবে এই বেসম্ভব সেইরাম সুন্দরী মেয়েটা
এক বছরেই আমার উপর ভালমত প্রভাব বিস্তার
করেছে বলা যায় ।
আনিকা আমার জন্য মুশকিল আসান বুবু। যেকোন
ঝামেলায় পড়লেই আগে আনিকাকে বলি। ভ্রু
কুঁচকে শুনে মেয়েটা দৃঢ়তার সাথে এমন একটা
সমাধান বের করে দেয়, আমার মনে হয় আমি
ওকে রুমমেট হিসাবে পেয়ে ধন্য।
...
আজ রান্না করতে করতে হঠাৎ ছোট খালার
ফোন। ফোন ধরতেই খালা শুরু করল প্যাচাল, আমি
খোঁজখবর নেইনা, শহরে পড়ালেখা করে পাঙ্খা
গজাইছে, মেয়েমানুষ বেশিদিন বিয়ে না করে
হোস্টেলে থাকলে বেয়াদব হয়ে যায়, এইসব
হাবিজাবি।
কিছুক্ষণ চুপচাপ শুনে জিজ্ঞেস করলাম,
"কিছু বলবা খালা"? খালা তখন ইনিয়ে বিনিয়ে বলল, একটা
চমৎকার ফার্স্ট ক্লাস ছেলের খোঁজ পাইছে
খালা,এমন ছেলে নাকি সারা দুনিয়া খুঁজেও মিলবেনা।
আজ বিকালে সেই রাজপুত্র নাকি আমার সাথে দেখা
করতে চাইছে একটা রেস্টুরেন্টে ।আমি যেন
সুন্দর মত সেজেগুজে ছেলের সাথে দেখা
করতে যাই।
.
মনে মনে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। এই নিয়ে
গোটাপাচেক ছেলের সাথে দেখা করা হয়ে
গেছে। প্রত্যেকবারই ছেলের সামনে গিয়ে
হাজির হই। ছেলে দেখতে যেমনই হোক না
কেন, আশা করে হয়ত একটা ডানা কাটা কিংবা ডানাওয়ালা
পরী হাজির হবে তার সামনে। তার বদলে খাটো,
শুকনা , জৌলুসহীন চেহারার আমাকে দেখে
যারপরনাই হতাশ হয়।
সেই হতাশাটা তাদের চোখে স্পষ্ট দেখতে পাই
আমি। কেউ কেউ ভদ্রতাবশে কিছুক্ষণ এদিক
সেদিকের গল্প করে তাদের সিদ্ধান্ত পরে
জানিয়ে দেবে বলে বিদায় নেয় । আমিও খুব
ভালভাবেই জানি তাদের হ্যাঁ সুচক ফোনকলটার আশা
দুরাশা মাত্র।
আবার কেউ কেউ ভদ্রতার ধারটাও ধারে না। তাদের
হাতে সময় কম বলে উঠে চলে যায়।
...
আনিকাকে আমার সাথে যেতে রাজি করাতে একটুও
বেগ পেতে হয়নি। আনিকাও জানে, আমাদের মত
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের রূপের ধার না
থাকলেও, বিয়ের আগে কতবার যে বাজারের সব্জি
কেনার মত বউ খুঁজতে আসা মানুষগুলোর সামনে
হাজির হতে হয়, তার হিসাব রাখলে চলে না। লাউ
কেনার আগে মানুষ যেমন নখ দিয়ে পরখ করে
দেখে,পছন্দ না হলে মুখ ঘুরিয়ে আরেক
দোকানে চলে যায়, নিজেকে মাঝে মাঝে
সেরকম সব্জির মত লাগে।
...
বিকাল হতেই আনিকাকে নিয়ে খালা যেই
রেস্টুরেন্টে যেতে বলেছিল, ওখানে হাজির
হলাম। তার আগে আনিকা খালার দেয়া ফোন নাম্বারে
কথা বলে নিয়েছে। পাত্রের বোনের সাথে
কথা হয়েছে। পাত্রের বোন বলেছিল, "চারটায়
রেস্টুরেন্টে থাকতে, উনাদের দেরি হলেও
আমরা যাতে মনে না করি উনারা আসবেনা"।
সোজা বাংলায় যাকে বলে, আমাদের ওখানে চারটার
মধ্যে গিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। উনারা যখন
মর্জি আসবেন, এতে উতলা হলে চলবেনা। কারণ,
আমরা মেয়েপক্ষ।
সাড়ে চারটায় পাত্র, পাত্রের বোন আর এক বন্ধু
আসল।পাত্রের বোন আমাদের দুজনকে এক
ঝলক দেখে নিয়ে নিজের আর বাকি দুজনের
পরিচয় দিলেন।
তারপরে আনিকার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস
করলেন,
"তুমিই নিশ্চয় রুমানা?"
আনিকা মাথা নেড়ে "না" জানিয়ে আমাকে দেখিয়ে
দিতেই মজার একটা জিনিস খেয়াল করলাম। হাসি হাসি
মুখের পাত্রের বড়বোনের চেহারা নিমেষেই
কঠিন হয়ে গেল। অনেকটা গম্ভীরভাবে উনি
বললেন,
"ও"...!!
উনার ভ্যাবাচ্যাকা চেহারা দেখে অপমানিত না হয়ে
প্রথম বারের জন্য কেন যেন খুব হাসি পেয়ে
গেল। বুঝেই গিয়েছি আমাকে দেখে উনার
পছন্দ হবার কথা না। হাসিমুখে নিজের পরিচয় দিয়ে
আনিকাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম আমার বান্ধবী
হিসাবে ।
.
সুপাত্রের নাম মাহমুদ। উনার বড়বোন কিছুক্ষণ পর
আমাদের আলাদা কথা বলার জন্য পাশের টেবিলে
পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, "তোমরা নিজেরা কথা
বলে নাও"।
কথা বলে জানলাম মাহমুদ সাহেব আমার চেয়ে বছর
চারেকের বড়, একটা নামকরা প্রাইভেট
কোম্পানীতে চাকরি করেন। উনি নাকি বউ এর
ব্যাপারে খুব "খুতখুতে", তাই দুই এক বছর ধরে
বিয়ের ইচ্ছা থাকলেও ব্যাটে বলে তেমন মিলছে
না। আমি কিছু বলার চেয়ে উনার কথা শুনছিলাম বেশি।
...
যে কয়েকটা ছেলের সামনে গিয়ে বসতে
হয়েছে, প্রত্যেকবার একটা জিনিস খেয়াল করেছি
আমি। আমার চেহারাটা কারো পছন্দ হয়নি বলেই হয়ত
কেউ ঠিক আমাকে জানতে চায়নি। শুধু তারা যে আমার
চেয়ে আরো অনেক "ভাল" মেয়েকে
জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পাওয়ার যোগ্য তার
স্বপক্ষে নিজের গুণগান করে গেছে বেশি।
সেইখানে নিতান্ত "দেখতে তেমন ভাল না" টাইপ
আমাকে দেখে কেউ জিজ্ঞেস করেনি-
"রুমানা,তুমি কি বৃষ্টিতে ভিজতে ভালবাসো?
তুমি কার গান শুনতে পছন্দ করো?
তোমার পছন্দের রঙ কি?
কোন কবিতাটা পড়লে মন বিষণ্ণ হয়?
অধরা কোন স্বপ্ন আছে নাকি"?
.
তার বদলে সবাই জানতে চেয়েছে রাঁধতে পারি কি
না?বিয়ের পর চাকরি করব কি না? বড় ফ্যামিলিতে মানিয়ে
নিতে পারব কি না ! মুখেই জিজ্ঞেস করেছে কি
ধরনের ছেলে পছন্দ কিন্তু নিজেকে তার সাথে
মিলিয়ে দেখার ফুরসত মেলেনি কারোরই ।
আমি জানি, একদিনে দুই এক ঘন্টায় কোন প্রশ্নের
উত্তরেই কাউকে জানা যায়না। কিন্তু দুধে আলতা
গায়ের রঙ, মাপা হাসি, চোখে পড়ার মত হাইট
সর্বোপরি আমার চেহারা পছন্দ না করে যারা ফিরে
গেছে, আমার শিক্ষা, রুচি, সংস্কার যাদের কাছে বাড়তি
একেকটা উপাদান মাত্র, তারা হয়ত ফিরে গিয়ে পরিবার
বন্ধুদের সাথে গল্প করতে গিয়ে বলেছে,-নাহ,
এমন মেয়ে চলবে না।চেহারা পছন্দ হয়নি।
.
তারা কি জানে, প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অপমান কতটা বিঁধে??
সৌন্দর্যের সংজ্ঞাটা তাদের কাছে এমন অদ্ভুত
কেন খুব জানতে ইচ্ছে করে।
...
ছেলেবেলা থেকেই চেহারা খারাপ বলে মা আর
দাদীর আক্ষেপের শেষ ছিলনা। অন্য
ভাইবোনের চেয়ে রেজাল্ট ভাল করে যখন
একটু ভালোবাসা কিংবা বাহবা পাবার আশায় মায়ের সামনে
দাঁড়াতাম, মা পাত্তা না দিয়ে কাঁচা হলুদ আর নিমপাতা বাটা
ধরিয়ে দিয়ে মাখতে বলতেন। তাতে নাকি চেহারায়
জৌলুস আসবে। আমার আচরণ,
সামাজিক অবস্থান, চিন্তাভাবনা, কিচ্ছু না, শুধু এই বাইরের
আমাকে দেখেই কিভাবে কিছু মানুষ বাতিলের
তালিকায় ফেলে দেয় !
এটা চিন্তা করে সেসব কোন রাতেই আমি ঘুমাতে
পারিনি। যারা আমাকে দেখতে এসেছিল, তাদের
মাঝে অনেক কে আমার নিজেরই পছন্দ হয়নি।
কথাবার্তা, আচার আচরণ ঠিক কোনটাই আমার সাথে
মেলেনি। তারপরও তারাই যখন উপেক্ষা করে
গেছে, একটা অপ্রতিরোধ্য অপমানবোধে
বিষাক্ত হয়েছি আমি। আর হিসাব করেছি আরো
কতবার এভাবে সব্জি বাজারের খারাপ সব্জির মত
ক্রেতার পছন্দ না হওয়ায় ফিরে যাবেো!!
.
নির্ঘুম রাতে বারবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে
নিজেকে ধিক্কার দিতে গিয়েও থেমে
গেছি,উপহাস করেছি নিজের প্রতিবিম্ব কে।
তারপরেই একটা নতুন ভোরের আলোতে সব
ভুলে গেছি।
...
"কি হল, কিছু বলছেন না যে" , এই কথা শুনেই সম্বিত
ফিরল। সামনে নিজের গুণগান করতে থাকা মাহমুদ
সাহেবের কথায় মনোযোগ না দিয়ে এতক্ষণ
কিসব চিন্তা করছিলাম! মাহমুদ সাহেব আবার বললেন,
"দেখুন, বিয়ের ডিসিশন টা তো খুব বড় ব্যাপার, আমরা
আপনাকে জানিয়ে দেব আমাদের মতামত। একটু
ধৈর্য ধরবেন। আমাদের বাসায় বারবার ফোন করে
খোঁজ নেয়ার দরকার নেই" ।
তারপরেই তিনি বলা শুরু করলেন, তাদের বাসায়
মেয়ের অভিভাবকরা দিন রাত কত ফোন করেন।
এর আগে কোন একটা মেয়ে দেখতে গিয়ে
ঠিকমত তাদের যত্ন নেওয়া হয়নি বলে তাদের
পরিবারকে উনার খালা কিভাবে টাইট দিয়েছিলেন সেই
গল্প করতেও ভুললেন না।
হঠাৎ আমার কি যেন হয়ে গেল। উনাকে মাঝপথে
থামিয়ে আমার ভেতর থেকে অন্য এক আমি বলা
শুরু করল,
" দেখুন মাহমুদ সাহেব, আমি কিছু কথা বলতে চাই।
বিয়ে তো হয় দুই পক্ষের মতানুযায়ি । আমারো কিছু
মতামত আছে। আমি আপনার মত কাউকে অপেক্ষায়
রাখতে চাইনা। আমার মতামত আজকেই জানিয়ে দিচ্ছি
আপনাকে। আপনার এরকম হাম্বুড়া স্বভাব আমার পছন্দ
হয়নি, আমার এই বিয়েতে মত নেই। আপনি আপনার
পছন্দমত সুন্দরী মেয়ে খুঁজে নিন"।
এই কথা শুনেই মাহমুদ সাহেব বিস্ফোরিত চোখে
আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। মোটামুটি বিচ্ছিরি
দেখতে একটা মেয়ে, যাকে উনি এতক্ষণ উনার
বউ হবার যোগ্য মনে করেন নি বলে ইঙ্গিত
দিয়েছেন, সেই মেয়েটা মুখের উপর এই কথা
বলে বসবে, উনি যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস
করতে পারছিলেন না। উনি তৎক্ষণাৎ বোনের
কাছে গিয়ে ফিসফিস করে কি বললেন আর তাতে
সবাই তাদের শেষ অবলম্বন অগ্নিদৃষ্টিতে আমাকে
ভস্ম করে চলে গেলেন।
আনিকা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
"কি হয়েছে রে"?
ক্রুর একটা হাসি হেসে বললাম, "তেমন কিছু না।
তবে এই লোকটার আজকের রাতের আরামের
ঘুম হারাম করে দিয়েছি "।
...
আমি জানি হোস্টেলে ফেরার আগেই ছোটখালা
ফোন দিয়ে গালিগালাজ করে আমার গোষ্ঠী
উদ্ধার করবে , মা এক প্রস্থ কান্নাকাটি করবে। আবার
দশদিন পরেই এরকম কোন মাহমুদের সামনে
এসে আমাকে বসতে হবে। তাতে কি ! আজ
পৃথিবীর কোনকিছুই কিছু না। আজ রাতটা অন্যবারের
মত আমার নির্ঘুম কাটবেনা।
একগাল হেসে আনিকাকে বললাম, "আনিকা, চল
আজকে আমরা দুজন ঘুরি"।
আনিক মাথা নেড়ে সায় দিতেই বিকেলটা হয়ে গেল
আমার জীবনের সুন্দরতম বিকেল।
.. ..
সেই বিকেলের গোধুলীর আলোতে ছিল বাঁধ
ভাঙ্গার আনন্দ,সেই বিকেলের ভাজে লুকিয়ে
রেখে এসেছি জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস আর সন্ধ্যা
খুঁড়ে ঘরে তুলে এনেছি অন্যরকম একটা
আত্মবিশ্বাস।
... ....
আমি জানি, স্বপ্ন দেখার উপলক্ষ লাগেনা। তবুও
ভাবতে ভীষণ ভাল লাগে, আজ দুঃস্বপ্নের বদলে
আমার ঘুমের আঙিনাতে পা রাখবে অন্য একটা
স্বপ্ন।
যেই স্বপ্নে আসা রাজপুত্র বিষণ্ণ এক বিকেলের
কনে দেখা আলোয় কোন বনলতা সেনের
মুখে খুঁজে ফিরবেনা পাখির নীড়ের মত চোখ !!
....*.*.*.*....
তোর রান্নার পালা। রাঁধিস নাই ক্যান? তুই কি আজ
ক্লাসে না গিয়ে সকাল থেকেই ঘুমাচ্ছিস নাকি ? ওই
ওঠ ওঠ। নাইলে আজ দুপুরে তোর খাওয়া নাই।
আনিকা নামক এমপ্লিফায়ারের এহেন চিল্লাপাল্লায়
আমার ঘুম মাথায় উঠল। অবশ্য না খেতে দেয়ার হুমকি
আমার উঠে পড়ার জন্য যথেষ্ট। এমনিতেই আজ
সকালে ঘুম থেকে উঠে রাক্ষসের মত খিদা
লেগে গেছিল। ঘুম থেকে উঠে ঘড়ির দিকে
তাকাতেই মুখ হাসি হাসি হয়ে গেল। কারণ হল, তখন
নয়টা বাজতে দশ মিনিট বাকি । তার মানে ক্লাসে যাওয়া
লাগবেনা।
সুপারম্যানের মত কিংবা আয়রনম্যানের মত স্পিড
পাইলে হয়ত চিন্তা ভাবনা করতে দেখতাম। কিন্তু
আমার মত আলসেমির রেটিং এ ফাইভ স্টার পাওয়া
মেয়ের পক্ষে তা একেবারেই বেসম্ভব। মহা
আনন্দে আমি আবার বালিশে মাথা দিলাম , যদিও খিদায়
পেটের মধ্যে চো চো শুরু হইছে। ঘুমাইতে
পারলে খাওয়ার দুঃখ ভুলতেও রাজি আছি আমি।
সপ্তাহে একটা ছুটির দিন,তাও আবার কম্পিউটার
কোর্সের ক্লাসে যাওয়ার জন্য সকালবেলার অতি
শান্তির ঘুমটা হয়না ঠিকমত। ক্লাসে যাওয়ার আগে
আনিকা মনে হয় বলে গেছিল আমাকে রান্না করে
রাখার কথা, ঘুমের মধ্যে শুনেছি কি শুনিনাই আল্লাহ
মালুম। তাই আনিকা ফিরে চিল্লাপাল্লা শুরু করায় বেশিক্ষণ
বিছানায় থাকা নিরাপদ মনে হল না। তাই তাড়াতাড়ি উঠে রান্না
নামক ঝামেলাটা সেরে ফেলায় মন দিলাম।
..
আনিকা আমার রুমমেট, একটা হোস্টেলে থাকি
আমরা। দুজনেই বছর খানেক হল চাকুরী করি।
আনিকা ,যাকে বলে সেইরাম সুন্দরী। বিয়ে
হয়েছে কিছুদিন , তবে ওর হাজব্যান্ডের বদলির
চাকুরী হওয়ার কারণে এখন আপাতত অন্য জেলায়
আছে।কিছুদিনেই নাকি বদলি হয়ে আসবে,তখন
আনিকা সংসার শুরু করবে।
তবে এই বেসম্ভব সেইরাম সুন্দরী মেয়েটা
এক বছরেই আমার উপর ভালমত প্রভাব বিস্তার
করেছে বলা যায় ।
আনিকা আমার জন্য মুশকিল আসান বুবু। যেকোন
ঝামেলায় পড়লেই আগে আনিকাকে বলি। ভ্রু
কুঁচকে শুনে মেয়েটা দৃঢ়তার সাথে এমন একটা
সমাধান বের করে দেয়, আমার মনে হয় আমি
ওকে রুমমেট হিসাবে পেয়ে ধন্য।
...
আজ রান্না করতে করতে হঠাৎ ছোট খালার
ফোন। ফোন ধরতেই খালা শুরু করল প্যাচাল, আমি
খোঁজখবর নেইনা, শহরে পড়ালেখা করে পাঙ্খা
গজাইছে, মেয়েমানুষ বেশিদিন বিয়ে না করে
হোস্টেলে থাকলে বেয়াদব হয়ে যায়, এইসব
হাবিজাবি।
কিছুক্ষণ চুপচাপ শুনে জিজ্ঞেস করলাম,
"কিছু বলবা খালা"? খালা তখন ইনিয়ে বিনিয়ে বলল, একটা
চমৎকার ফার্স্ট ক্লাস ছেলের খোঁজ পাইছে
খালা,এমন ছেলে নাকি সারা দুনিয়া খুঁজেও মিলবেনা।
আজ বিকালে সেই রাজপুত্র নাকি আমার সাথে দেখা
করতে চাইছে একটা রেস্টুরেন্টে ।আমি যেন
সুন্দর মত সেজেগুজে ছেলের সাথে দেখা
করতে যাই।
.
মনে মনে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। এই নিয়ে
গোটাপাচেক ছেলের সাথে দেখা করা হয়ে
গেছে। প্রত্যেকবারই ছেলের সামনে গিয়ে
হাজির হই। ছেলে দেখতে যেমনই হোক না
কেন, আশা করে হয়ত একটা ডানা কাটা কিংবা ডানাওয়ালা
পরী হাজির হবে তার সামনে। তার বদলে খাটো,
শুকনা , জৌলুসহীন চেহারার আমাকে দেখে
যারপরনাই হতাশ হয়।
সেই হতাশাটা তাদের চোখে স্পষ্ট দেখতে পাই
আমি। কেউ কেউ ভদ্রতাবশে কিছুক্ষণ এদিক
সেদিকের গল্প করে তাদের সিদ্ধান্ত পরে
জানিয়ে দেবে বলে বিদায় নেয় । আমিও খুব
ভালভাবেই জানি তাদের হ্যাঁ সুচক ফোনকলটার আশা
দুরাশা মাত্র।
আবার কেউ কেউ ভদ্রতার ধারটাও ধারে না। তাদের
হাতে সময় কম বলে উঠে চলে যায়।
...
আনিকাকে আমার সাথে যেতে রাজি করাতে একটুও
বেগ পেতে হয়নি। আনিকাও জানে, আমাদের মত
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের রূপের ধার না
থাকলেও, বিয়ের আগে কতবার যে বাজারের সব্জি
কেনার মত বউ খুঁজতে আসা মানুষগুলোর সামনে
হাজির হতে হয়, তার হিসাব রাখলে চলে না। লাউ
কেনার আগে মানুষ যেমন নখ দিয়ে পরখ করে
দেখে,পছন্দ না হলে মুখ ঘুরিয়ে আরেক
দোকানে চলে যায়, নিজেকে মাঝে মাঝে
সেরকম সব্জির মত লাগে।
...
বিকাল হতেই আনিকাকে নিয়ে খালা যেই
রেস্টুরেন্টে যেতে বলেছিল, ওখানে হাজির
হলাম। তার আগে আনিকা খালার দেয়া ফোন নাম্বারে
কথা বলে নিয়েছে। পাত্রের বোনের সাথে
কথা হয়েছে। পাত্রের বোন বলেছিল, "চারটায়
রেস্টুরেন্টে থাকতে, উনাদের দেরি হলেও
আমরা যাতে মনে না করি উনারা আসবেনা"।
সোজা বাংলায় যাকে বলে, আমাদের ওখানে চারটার
মধ্যে গিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। উনারা যখন
মর্জি আসবেন, এতে উতলা হলে চলবেনা। কারণ,
আমরা মেয়েপক্ষ।
সাড়ে চারটায় পাত্র, পাত্রের বোন আর এক বন্ধু
আসল।পাত্রের বোন আমাদের দুজনকে এক
ঝলক দেখে নিয়ে নিজের আর বাকি দুজনের
পরিচয় দিলেন।
তারপরে আনিকার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস
করলেন,
"তুমিই নিশ্চয় রুমানা?"
আনিকা মাথা নেড়ে "না" জানিয়ে আমাকে দেখিয়ে
দিতেই মজার একটা জিনিস খেয়াল করলাম। হাসি হাসি
মুখের পাত্রের বড়বোনের চেহারা নিমেষেই
কঠিন হয়ে গেল। অনেকটা গম্ভীরভাবে উনি
বললেন,
"ও"...!!
উনার ভ্যাবাচ্যাকা চেহারা দেখে অপমানিত না হয়ে
প্রথম বারের জন্য কেন যেন খুব হাসি পেয়ে
গেল। বুঝেই গিয়েছি আমাকে দেখে উনার
পছন্দ হবার কথা না। হাসিমুখে নিজের পরিচয় দিয়ে
আনিকাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম আমার বান্ধবী
হিসাবে ।
.
সুপাত্রের নাম মাহমুদ। উনার বড়বোন কিছুক্ষণ পর
আমাদের আলাদা কথা বলার জন্য পাশের টেবিলে
পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, "তোমরা নিজেরা কথা
বলে নাও"।
কথা বলে জানলাম মাহমুদ সাহেব আমার চেয়ে বছর
চারেকের বড়, একটা নামকরা প্রাইভেট
কোম্পানীতে চাকরি করেন। উনি নাকি বউ এর
ব্যাপারে খুব "খুতখুতে", তাই দুই এক বছর ধরে
বিয়ের ইচ্ছা থাকলেও ব্যাটে বলে তেমন মিলছে
না। আমি কিছু বলার চেয়ে উনার কথা শুনছিলাম বেশি।
...
যে কয়েকটা ছেলের সামনে গিয়ে বসতে
হয়েছে, প্রত্যেকবার একটা জিনিস খেয়াল করেছি
আমি। আমার চেহারাটা কারো পছন্দ হয়নি বলেই হয়ত
কেউ ঠিক আমাকে জানতে চায়নি। শুধু তারা যে আমার
চেয়ে আরো অনেক "ভাল" মেয়েকে
জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পাওয়ার যোগ্য তার
স্বপক্ষে নিজের গুণগান করে গেছে বেশি।
সেইখানে নিতান্ত "দেখতে তেমন ভাল না" টাইপ
আমাকে দেখে কেউ জিজ্ঞেস করেনি-
"রুমানা,তুমি কি বৃষ্টিতে ভিজতে ভালবাসো?
তুমি কার গান শুনতে পছন্দ করো?
তোমার পছন্দের রঙ কি?
কোন কবিতাটা পড়লে মন বিষণ্ণ হয়?
অধরা কোন স্বপ্ন আছে নাকি"?
.
তার বদলে সবাই জানতে চেয়েছে রাঁধতে পারি কি
না?বিয়ের পর চাকরি করব কি না? বড় ফ্যামিলিতে মানিয়ে
নিতে পারব কি না ! মুখেই জিজ্ঞেস করেছে কি
ধরনের ছেলে পছন্দ কিন্তু নিজেকে তার সাথে
মিলিয়ে দেখার ফুরসত মেলেনি কারোরই ।
আমি জানি, একদিনে দুই এক ঘন্টায় কোন প্রশ্নের
উত্তরেই কাউকে জানা যায়না। কিন্তু দুধে আলতা
গায়ের রঙ, মাপা হাসি, চোখে পড়ার মত হাইট
সর্বোপরি আমার চেহারা পছন্দ না করে যারা ফিরে
গেছে, আমার শিক্ষা, রুচি, সংস্কার যাদের কাছে বাড়তি
একেকটা উপাদান মাত্র, তারা হয়ত ফিরে গিয়ে পরিবার
বন্ধুদের সাথে গল্প করতে গিয়ে বলেছে,-নাহ,
এমন মেয়ে চলবে না।চেহারা পছন্দ হয়নি।
.
তারা কি জানে, প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অপমান কতটা বিঁধে??
সৌন্দর্যের সংজ্ঞাটা তাদের কাছে এমন অদ্ভুত
কেন খুব জানতে ইচ্ছে করে।
...
ছেলেবেলা থেকেই চেহারা খারাপ বলে মা আর
দাদীর আক্ষেপের শেষ ছিলনা। অন্য
ভাইবোনের চেয়ে রেজাল্ট ভাল করে যখন
একটু ভালোবাসা কিংবা বাহবা পাবার আশায় মায়ের সামনে
দাঁড়াতাম, মা পাত্তা না দিয়ে কাঁচা হলুদ আর নিমপাতা বাটা
ধরিয়ে দিয়ে মাখতে বলতেন। তাতে নাকি চেহারায়
জৌলুস আসবে। আমার আচরণ,
সামাজিক অবস্থান, চিন্তাভাবনা, কিচ্ছু না, শুধু এই বাইরের
আমাকে দেখেই কিভাবে কিছু মানুষ বাতিলের
তালিকায় ফেলে দেয় !
এটা চিন্তা করে সেসব কোন রাতেই আমি ঘুমাতে
পারিনি। যারা আমাকে দেখতে এসেছিল, তাদের
মাঝে অনেক কে আমার নিজেরই পছন্দ হয়নি।
কথাবার্তা, আচার আচরণ ঠিক কোনটাই আমার সাথে
মেলেনি। তারপরও তারাই যখন উপেক্ষা করে
গেছে, একটা অপ্রতিরোধ্য অপমানবোধে
বিষাক্ত হয়েছি আমি। আর হিসাব করেছি আরো
কতবার এভাবে সব্জি বাজারের খারাপ সব্জির মত
ক্রেতার পছন্দ না হওয়ায় ফিরে যাবেো!!
.
নির্ঘুম রাতে বারবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে
নিজেকে ধিক্কার দিতে গিয়েও থেমে
গেছি,উপহাস করেছি নিজের প্রতিবিম্ব কে।
তারপরেই একটা নতুন ভোরের আলোতে সব
ভুলে গেছি।
...
"কি হল, কিছু বলছেন না যে" , এই কথা শুনেই সম্বিত
ফিরল। সামনে নিজের গুণগান করতে থাকা মাহমুদ
সাহেবের কথায় মনোযোগ না দিয়ে এতক্ষণ
কিসব চিন্তা করছিলাম! মাহমুদ সাহেব আবার বললেন,
"দেখুন, বিয়ের ডিসিশন টা তো খুব বড় ব্যাপার, আমরা
আপনাকে জানিয়ে দেব আমাদের মতামত। একটু
ধৈর্য ধরবেন। আমাদের বাসায় বারবার ফোন করে
খোঁজ নেয়ার দরকার নেই" ।
তারপরেই তিনি বলা শুরু করলেন, তাদের বাসায়
মেয়ের অভিভাবকরা দিন রাত কত ফোন করেন।
এর আগে কোন একটা মেয়ে দেখতে গিয়ে
ঠিকমত তাদের যত্ন নেওয়া হয়নি বলে তাদের
পরিবারকে উনার খালা কিভাবে টাইট দিয়েছিলেন সেই
গল্প করতেও ভুললেন না।
হঠাৎ আমার কি যেন হয়ে গেল। উনাকে মাঝপথে
থামিয়ে আমার ভেতর থেকে অন্য এক আমি বলা
শুরু করল,
" দেখুন মাহমুদ সাহেব, আমি কিছু কথা বলতে চাই।
বিয়ে তো হয় দুই পক্ষের মতানুযায়ি । আমারো কিছু
মতামত আছে। আমি আপনার মত কাউকে অপেক্ষায়
রাখতে চাইনা। আমার মতামত আজকেই জানিয়ে দিচ্ছি
আপনাকে। আপনার এরকম হাম্বুড়া স্বভাব আমার পছন্দ
হয়নি, আমার এই বিয়েতে মত নেই। আপনি আপনার
পছন্দমত সুন্দরী মেয়ে খুঁজে নিন"।
এই কথা শুনেই মাহমুদ সাহেব বিস্ফোরিত চোখে
আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। মোটামুটি বিচ্ছিরি
দেখতে একটা মেয়ে, যাকে উনি এতক্ষণ উনার
বউ হবার যোগ্য মনে করেন নি বলে ইঙ্গিত
দিয়েছেন, সেই মেয়েটা মুখের উপর এই কথা
বলে বসবে, উনি যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস
করতে পারছিলেন না। উনি তৎক্ষণাৎ বোনের
কাছে গিয়ে ফিসফিস করে কি বললেন আর তাতে
সবাই তাদের শেষ অবলম্বন অগ্নিদৃষ্টিতে আমাকে
ভস্ম করে চলে গেলেন।
আনিকা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
"কি হয়েছে রে"?
ক্রুর একটা হাসি হেসে বললাম, "তেমন কিছু না।
তবে এই লোকটার আজকের রাতের আরামের
ঘুম হারাম করে দিয়েছি "।
...
আমি জানি হোস্টেলে ফেরার আগেই ছোটখালা
ফোন দিয়ে গালিগালাজ করে আমার গোষ্ঠী
উদ্ধার করবে , মা এক প্রস্থ কান্নাকাটি করবে। আবার
দশদিন পরেই এরকম কোন মাহমুদের সামনে
এসে আমাকে বসতে হবে। তাতে কি ! আজ
পৃথিবীর কোনকিছুই কিছু না। আজ রাতটা অন্যবারের
মত আমার নির্ঘুম কাটবেনা।
একগাল হেসে আনিকাকে বললাম, "আনিকা, চল
আজকে আমরা দুজন ঘুরি"।
আনিক মাথা নেড়ে সায় দিতেই বিকেলটা হয়ে গেল
আমার জীবনের সুন্দরতম বিকেল।
.. ..
সেই বিকেলের গোধুলীর আলোতে ছিল বাঁধ
ভাঙ্গার আনন্দ,সেই বিকেলের ভাজে লুকিয়ে
রেখে এসেছি জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস আর সন্ধ্যা
খুঁড়ে ঘরে তুলে এনেছি অন্যরকম একটা
আত্মবিশ্বাস।
... ....
আমি জানি, স্বপ্ন দেখার উপলক্ষ লাগেনা। তবুও
ভাবতে ভীষণ ভাল লাগে, আজ দুঃস্বপ্নের বদলে
আমার ঘুমের আঙিনাতে পা রাখবে অন্য একটা
স্বপ্ন।
যেই স্বপ্নে আসা রাজপুত্র বিষণ্ণ এক বিকেলের
কনে দেখা আলোয় কোন বনলতা সেনের
মুখে খুঁজে ফিরবেনা পাখির নীড়ের মত চোখ !!
....*.*.*.*....