কাজী সুলতানা শিমি: পরিমিতি বোধে মনের রং বা আনন্দ প্রকাশ অন্যায় কিছু নয়। কিন্তু বয়স ও পরিস্থিতি অনুযায়ী যথোপযুক্ত আচরণ আজকাল আমাদের সংস্কৃতিতে প্রায় দুর্লভ হয়ে যাচ্ছে। আচরণে দেখা যাচ্ছে এক ধরণের অসামঞ্জস্যতা। এ প্রসঙ্গে যে কোন অনুষ্ঠানের আয়োজনের কথাই বলি। আজকাল বাংলাদেশী কোন অনুষ্ঠানে গেলে অনুষ্ঠান উপভোগ করার চেয়ে ছবি তোলা আর সেলফি পোজ দেয়াটাই মুখ্য হয়ে দাড়ায়। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক এবং শিল্পীকে উপস্থিত দর্শকদের নীরবতার জন্য বার বার অনুরোধ করতে দেখা যায়। এতে শিল্পী ও অনুষ্ঠানের আয়োজকদের যে কতখানি অসম্মান করা হয় তা কি একবার ও মনে হয় আমাদের। আড্ডা ও অনুষ্ঠান এক বিষয় নয়। অনুষ্ঠান বিরতিতে আড্ডা কিংবা সেলফি তোলার যথেস্ট সময় থাকে। নীরব থাকার প্রবণতা অভ্যাস করা হলো মূলত শিল্পীদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা। তাদের গান বা অনুষ্ঠানকে মর্যাদা দেয়া। কিন্তু তা না করে হৈ চৈ বা অহেতুক গল্পে মশগুল হয়ে তাদের প্রতি কি নিদারুণ অসম্মান করছি সেটা একবার ভুলেও ভাবছিনা। অনুষ্ঠান শেষে খাবারের লাইনে ও দেখা যায় এমন অসঙ্গতি। এমনকি শোকের অনুষ্ঠানেও দেখা যায় একই পরিস্থিতি।
কোন অনুষ্ঠানে গেলেই আজকাল শুধু সেলফি তোলার হিরিক। সেইসাথে নিজেদের মধ্যে নৈমত্তিক আলাপনের মহরত। সেলফি-মহড়া' আর মা-বাবাদের গল্পের হল্লা-চিল্লা দেখে ছোট ছোট ছেলেমেরেরাও শুরু করে তাদের মত করে যা খুশি করা। অভ্যাগত মধ্যে কেউ কেউ ইশারায় থামাতে চেষ্টা করলেও থামছেনা এসব হট্টগোল। সেলফি তুলনেওয়ালা কিংবা গল্পকারদের কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। বলা বাহুল্য এরা টিন-এজার নয়। সবাই প্রাপ্তবয়সী, সুশিক্ষিত ও যথেস্ট প্রাজ্ঞ। যারা নিজেরাই অন্যদের নীরব থাকতে উৎসাহিত করার কথা তারাই করছে এই অসঙ্গত ও অসৌজন্যমূলক আচরণ। অথচ যে কোন অনুষ্ঠান চলাকালীন সময় থাকার কথা পিনপতন নীরবতা। এই যে পরিবেশ অনুযায়ী আমাদের যথাযথ আচরণের অভাব তা কি আমাদের সুস্থ সংস্কৃতির অংশ নাকি খাম-খেয়ালী! যথাযথ আচরণের মানসিক দীনতা আমাদের ঘুচবে কবে!
পরিবেশ, পরিস্থিতি ও আনুষ্ঠানিকতা অনুযায়ী যথাযথ ব্যাবহার আমাদের ছেলেমেয়েরা শিখবে আমাদের আচরণ দেখে। আমরা নিজেরাই যদি এসব আচরণের ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন না হই তাহলে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের কি শিখাবো! প্রায় সময় আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে দুঃখবোধ বা অভিযোগ করি তারা বড়োদের সাথে শোভন ও শ্রদ্ধা নিয়ে আচরণ করা জানেনা। কিন্তু আমরা কি শেখাচ্ছি তাদের! বাংলার কৃষ্টি ও আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে আমরা যতোটা না আপ্লুত এরচে আচরণ ও যথাযথ ব্যবহারের ব্যাপারে কতোটা নিষ্ঠাবান ও সৎ তা-কি একবারও ভেবে দেখেছি? সময়ের সাথে পরিবেশ ও বদলায়। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে আচরণের ও পরিবর্তন করা দরকার। দেশ ছেড়ে আমরা প্রবাসে এসেছি। পোশাক-পরিচ্ছেদ, বাড়ি-গাড়ি, পেশা-প্রতিপত্তিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে কিন্তু ব্যাবহার ও আচরণে! এখনো রয়ে গেছি পুরনো পরিচয়ে। আমরা কি ভুলে যাচ্ছি যে আমরা আমাদের আচরণের মাধ্যমে আমাদের পুরো জাতিসত্তাকে তুলে ধরছি। উন্মচন করছি আমাদের মানসিকতা।
যথাযথ আচরণের মাধ্যমে সুন্দরের বিপ্লব ঘটানো সম্ভব। সম্ভব পরিস্থিতি পরিবর্তনে জোরালো ভূমিকা রাখা। সব রকমের মহৎ কাজকে শ্রদ্ধা জানানো যায় আচরণ দিয়ে। ভালো কাজে সবাইকে সম্পৃক্ত করার চমৎকার মাধ্যমও যথোপযুক্ত আচরণ। একটু সচেতনতা ও সহনশীলতাই আনতে পারে বৃহৎ পরিবর্তন। অথচ আমরা কেউ এ ব্যাপারে মনোযোগ না দিয়ে মেতে আছি শুধু নিজেদের নিয়ে আর অপরের দোষারোপে।
ছোট ছোট সচেতনতা আমাদের নিজেদের যেমন পরিবর্তিত হতে সহায়তা করে তেমনি প্রেরণা যোগায় অন্যদেরও। পরিবেশ অনুযায়ী যথাযথ আচরণ চর্চা করা আমাদের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বিবেচ্য হওয়া খুব দরকার। বিয়ের অনুষ্ঠান, গানের অনুষ্ঠান, সভাসমিতিতে বা শোকের পরিবেশে কখন কি আচরণ প্রযোজ্য সেটা আমরা বড়োরাই যদি সচেতন না থাকি তাহলে বাংলাদেশী কালচার বা সংস্কৃতিতে চিরকালই কিছু একটা অপূর্ণ থেকে যাবে। এ অপূর্ণতা দুর করার দ্বায়িত্ব আমাদের সকলের। বিশেষ করে প্রজন্মর কাছে জবাবদিহি না করার মতো কিছু একটা তো অন্তত অর্জন করা যাবে।এ জন্য প্রয়োজন সকলের সদিচ্ছা। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।
কৌতুহল হয় এসব কি আমরা ইচ্ছে করে করছি নাকি বিষয়টি গুরত্বপূর্ণ নয় বলে মনে করছি। এসব খেয়াল না করার কারণে আমরা আসলে অন্যান্য পরিমণ্ডলেও নিজেদের ছোট করছি। বাদামি চামড়া কিংবা এশিয়ান হিসেবে আমরা অন্যদের কাছেও তাচ্ছিল্যর বিষয়ে পরিণত হচ্ছি। কেননা কোন কোন অনুষ্ঠানে অন্যান্য দেশের অতিথিও থাকে তখন তারা এধরণের আচরণ কতোটা নিগ্রহের দৃষ্টিতে দেখে সেটা বিবেচনায় রাখছিনা। অথচ এসব করে পুরো জতিকে জিজ্ঞাসার সম্মুখিন করা ছাড়া মানসিক কোনো প্রশান্তি মেলে না। জাতী হিসেবে ক্ষতিটা হয় মূলত আমাদের সকলের।