বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে যে সব ক্ষতিকারক শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে তা যতদ্রুত সম্ভব সরিয়ে নিতে হবে। তা না হলে সুন্দরবনের অস্তিত্ব প্রতিনিয়তই বিলিন হতে থাকবে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। তারা বলেন, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক শিল্প-কারখানা বাড়তে থাকলে সুন্দরবনই থাকবে না। সুন্দরবনের পরিবেশের কোনো বিপর্যয় না ঘটে সে জন্য আশপাশে নতুন শিল্প স্থাপনের অনুমোদন না দেয়া এবং বর্তমানে যেগুলো আছে সেগুলো বন্ধ করা খুবই জরুরি।
সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক ১৯০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে উল্লেখ করে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় প্রতিবেদন জমা দেয় হাইকোর্টে। এতে লাল শ্রেণিভুক্ত ২৪টি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে যা মাটি, বায়ু ও পানি দূষণে খুবই ক্ষতিকর। এ ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান কোনোভাবেই সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকতে পারে না।
এ বিষয়ে বেলার নির্বাহী পরিচালক রেজওয়ানা হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তা বিস্মিত এবং ক্ষুব্ধ হওয়ার মতোই। বিস্মিত এই কারণে, সরকারের বেশ কয়েকটি তদারকি প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও কিভাবে এতগুলো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠা সম্ভব- যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক হিসেবে লাল শ্রেণিভুক্ত। আর ক্ষুব্ধ এই জন্য, আইন থাকা সত্ত্বেও তার প্রয়োগ না থাকায় দিনেদিনে সুন্দরবন হুমকির মুখে পড়ছে। তিনি বলেন, সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে যতগুলো ক্ষতিকারক শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে তা যতদ্রুত সম্ভব সরিয়ে নিতে হবে। সুন্দরবনকে ধ্বংসের সব আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, সুন্দরবনকে ধ্বংসের এসব শিল্প-কারখানা বন্ধ করতে না পারলে অচিরেই সুন্দরবনের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, বর্তমান সময়ে বিভিন্ন কারণে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে রয়েছে। এরই মধ্যে বনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৯০টি ক্ষতিকারক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তা অত্যন্ত ভয়াবহ। আমরা আশা করি, আদালত এ বিষয়ে কার্যকর আদেশ দেবেন। তিনি বলেন, এই প্রতিষ্ঠানগুলো বহাল থাকলে সুন্দরবনই থাকবে না। সুন্দরবনের পরিবেশের যাতে কোনো বিপর্যয় না ঘটে সে জন্য এর আশপাশে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেয়া চলবে না। যে গুলো আছে সেগুলোও বন্ধ করতে হবে।
হাইকোর্টে জমা দেয়া বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়- খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় সুন্দরবন সংলগ্ন ইসিএ এলাকায় সর্বমোট ১৯০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে বাগেরহাটে ৭৮টি, খুলনায় ৯২টি, সাতক্ষীরায় ২০টি। এগুলোর মধ্যে ৩৬টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান বর্তমানে বন্ধ। এর মধ্যে ২৪টি লাল এবং বাকিগুলো কমলা ও সবুজ শ্রেণির। প্রতিবেদন দাখিলের পর আদালত বলেন, ১৯৯৯ সালের ৩০ আগস্টের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, পরিবেশগত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় লাল শ্রেণির শিল্পপ্রতিষ্ঠান থাকার সুযোগ নেই। কারণ এগুলো মাটি, পানি ও বায়ু ব্যাপকভাবে দূষিত করে।
উল্লেখ্য, সুন্দরবনের আশপাশে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা শিল্পকারখানা অন্যত্র সরিয়ে নিতে সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের সভাপতি শেখ ফরিদুল ইসলাম গত বছরের ৪ এপ্রিল হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেন। রিটে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি), খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও বরগুনা জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং পুলিশ সুপারকে (এসপি) বিবাদী করা হয়। রিট আবেদনে বলা হয়, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ১৯৯৯ সালের ৩০ আগস্ট এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন এবং এর চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকাকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। এ প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকায় ভূমি, পানি, বায়ু ও শব্দ দূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যাবে না।
তবে ওই এলাকাতে এরই মধ্যে প্রায় ১৫০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে প্রকল্প করার জন্য অবস্থানগত ছাড়পত্র দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এর মধ্যে জাহাজ ভাঙা শিল্পসহ পরিবেশ দূষণকারী প্রকল্প রয়েছে বলেও জানা গেছে। এসব শিল্প-কারখানা স্থাপনের অনুমোদন দেয়া সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদ ও পরিবেশ আইন ১৯৯৫-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তা ছাড়া এসব শিল্প-কারাখানা সুন্দরবনের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে রিটে দাবি করা হয়।