মিলা, নীলা, নয়ন ও একজন ভদ্রলোক এর গল্প
মূল লেখক : জনাব আসিফ রহমান জয়
জ্যাম! জ্যাম!! আর জ্যাম!!! ভীষন-জ্যাম! ভয়াবহ-জ্যাম! নাহ... কোন বিশেষনই আসলে উপযুক্ত মনে হচ্ছে না! একটাই হতে পারে "দমবন্ধ" করা জ্যাম!!
জানুয়ারী মাসের ঘটনা।
এ বছরের শুরু থেকেই ঢাকার রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম পড়েছে! একদিকে আন্তর্জাতিক বানিজ্যমেলা, আরেকদিকে মেট্রোরেলের চলমান কাজ – দুইয়ে মিলে শহরটাকে কেমন যেন চেপে ধরেছে। সন্ধ্যা সাতটা মতো বাজে। হোটেল রেডিসনের সামনে সব যানবাহন স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কারো নড়ার উপায় নেই। বাস-গাড়ী-সিএনজি-বাইক সব ইঞ্জিন বন্ধ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কিছু গাড়ী চালককে দেখছি সিটটা ইজি করে পিছনে ঠেলে দিয়ে আয়েস করে রেডিও বা গান শুনছে। কিছু বাদামওয়ালা, চানাচুরভাজা, শসাওয়ালা, পানিবিক্রেতাকে জ্যামের ফাঁকে ফাঁকে হাঁক-ডাক দিতে দেখা যাচ্ছে। এরা সাধারনত রাস্তার সিগন্যালের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এদের মাঝ রাস্তায় দেখা পাওয়া মানেই জ্যাম অবশ্যই ভয়াবহ আকার ধারন করেছে!
আমি বাইক চালাই। রাস্তায় যতই জ্যাম থাকুক, বাম পাশের সরু একটা 'চিপা' জায়গা দিয়ে শম্বুক গতিতে বাইকগুলো চলাচল করতে পারে। অথচ আজ বাইকেরও যাবার কায়দা নেই। বাইকাররা পর্যন্ত বাইক স্ট্যান্ড করে মাথার হেলমেট খুলে মোড়ামুড়ি করছে।
বললাম না, যাকে বলে একেবারে দমবন্ধ করা জ্যাম! এরই মধ্যে হঠাৎই কানে ভেসে এলো অস্থির এক কন্ঠ!
ভদ্রলোক এতোক্ষন তার বাইকের উপর বসে মোবাইলে কথা বলছিলেন। আমার বাইকের ডান পাশেই তার বাইক রাখা। এখন বাইক থেকে নেমে অস্থির ভাবে মোবাইলে কথা বলতে বলতে পায়চারি করছেন-
-'হ্যা আমি অনেকক্ষন ধরেই জ্যামে আটকা পরে আছি, জানু। রেডিসনের ঠিক সামনে... বুঝলে...হ্যা হ্যা অনেক জ্যাম। আরে নাহ... আমি অফিস থেকে ঠিক সময়েই বেরিয়েছি, জানু... একটুও লেট করিনি।'
এভাবে অন্যের কথা কান পেতে শোনা নিশ্চই ঠিক না। কিন্তু কি করবো বলেন? ওই যে বললাম, দমবন্ধ করা জ্যামে আটকা পড়েছি। করার কিচ্ছু নেই। আর ভদ্রলোক যেভাবে জোরে জোরে চিৎকার করে কথা বলছেন, তাতে কান পাতার ও দরকার নেই। এমনিতেই সব শোনা যাচ্ছে।
-'না না...এখানে তো কখনোই এতো জ্যাম পরে না। কিন্তু এখন পরে গেছে...আমি কি করবো বলো জানু? না না...আমি জ্যামের বাহানা করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিনা.. বিলিভ মি জানু...'
(একবার ভাবলাম জিজ্ঞেস করি যে, জানুয়ারী মাস বলেই কি 'জানু'? ফেব্রুয়ারী হলে কি 'ফেবু' বলতেন?)
-'বিশ্বাস করো জানু... পুরা রাস্তাই কমপ্যাক্ট হয়ে আছে। এমনকি ওপাশের রাস্তাতেও সব গাড়ি থেমে আছে।'
-'কি বললে? রাস্তার গাড়ীর আওয়াজ পাচ্ছো না কেন? আরে আওয়াজ পাবে কিভাবে? সব গাড়ীই তো থেমে আছে। না না...আমি কোন রেস্টুরেন্টে আড্ডা দিচ্ছি না। আমি জ্যামের ছবিও তুলে রেখেছি। কিন্তু মোবাইল ডাটা শেষ হয়ে গেছে বলে আমি তোমাকে ছবিও পাঠাতে পারছি না। আমি বাসায় এসেই দেখাচ্ছি...প্লিজ সুইটু বিশ্বাস করো...'
বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, ভদ্রলোক ভালো বিপদেই পড়েছেন। ফোনের ওপাশে নিশ্চই ওনার স্ত্রী অথবা প্রেমিকা। বাসায় যেয়ে যেহেতু ছবি দেখাবেন কাজেই প্রেমিকা না, স্ত্রীই হবে। নিশ্চই সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী, স্বামী দেরী করছে বলে অস্থির হয়ে গেছে। এদিকে উনি যে জ্যামে পড়েছেন এটা মোটেই বিশ্বাস করছেন না। ভেবেছ যে, উনি জ্যামের বাহানা করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছেন। আহারে... মনে মনে মুচকি হাসলাম। কিন্তু কারো বিপদে যে মনে মনে হাসা উচিত না, এটা একেবারেই মনে ছিলো না।
-'আচ্ছা ঠিক আছে...আমার কথা তো বিশ্বাস হচ্ছে না? দাড়াও, আমি আশে-পাশের কাউকে দিয়ে তোমাকে ফোনে ধরাচ্ছি...এই যে ভাই... জি আপনি...আপনাকে বলছি...আমার একটা উপকার করবেন? প্লিজ...'
বলেছিলাম না। কারো বিপদে মনে মনে হাসা ঠিক না। এবার হলো তো? ভদ্রলোক আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমি বললাম-
-'আমাকে বলছেন?
-'জি... ভাই কিছু মনে করেন না। আমার বউ...আই মিন...নতুন বিয়ে করেছি তো... জ্যামে আটকা পড়েছি কিছুতেই বিশ্বাস করছে না।'
-'তো আমি কি করবো?'
-'আপনি আমার হয়ে একটু বলুন না...যে...আমি জ্যামে পড়েছি। গাড়ি-বাস কিছুই নড়ছে না।'
মানুষ আকাশ থেকে পড়ে, আমি তিনতলা থেকে পড়লাম!
-'কি অসম্ভব কান্ড! কি বলছেন এসব? আমি আপনাকে চিনি না...আপনি আমাকে চেনেন না। আর আমি আপনার হয়ে আপনার বউকে কিইবা বলবো?'
-'আরে ভাই যা সত্যি তাই বলবেন। প্লিজ এই উপকারটুকু করেন।'
আমার মাথায় তখন অন্য আর একটা চিন্তা ঢুকে পড়েছে। ব্যাটা ছিনতাইকারী না তো?
-'ওয়েট ওয়েট ওয়েট। ভাই, এই স্টাইলে আজকাল ছিনতাইও হয়। আমি আপনার হয়ে ফোনে কথা বলবো। আশে-পাশের লোকেরা ভাববে যে, আপনি আমার পরিচিত। তারপর জ্যাম ছেড়ে দিলেই আপনি খুব সুন্দর করে আমাকে বলবেন যা আছে সব দিয়ে দে...।'
ভদ্রলোক হেলমেট খুলে ফেললেন। এই শীতের মধ্যেও ঘেমে গেছেন। হাত দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বললেন-
-'ভাই আমাকে আপনার ছিনতাইকারী বলে মনে হয়? সিরিয়াসলি?'
আশে-পাশের আরো দুই-চারজন লোকও এতোক্ষন আমার আর ভদ্রলোকের কথা শুনছিলেন। তারাও দরবার করলেন-
-'বলেন ভাই বলেন...একটু ফোনে কথা বলে দেন। বেচারা বিপদে পড়েছে...'
আমি ঘাড় ঝাঁকিয়ে শ্রাগ করলাম-'ঠিক আছে, করেন ফোন।'
-'হ্যালো জানু...শুনছো? এই যে... তুমি তো আমাকে বিশ্বাস করো না। এই যে, আমার পাশেই একজন ভদ্রলোক বাইকে আছেন, তুমি ওনার সাথে কথা বলো... না না আমার বাইকে থাকবেন কেন? উনি ওনার বাইকে আছেন। কি মডেলের বাইক? কি বাইক জেনে তুমি কি করবে? ওয়ালটন... ওয়ালটন এক্সপ্লোর...১৪০ সিসি? তুমি ওনার সাথে কথা বললেই...বুঝতে পারবে যে, আমি কি ভীষন জ্যামে আটকা পড়েছি... ঠিক আছে জানু...এই নাও...'
আমি ফোন হাতে নিতে নিতে ভদ্রলোককে চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলাম-
-'বাইকের মডেল জিজ্ঞেস করলো কেন?'
ভদ্রলোকও ফিসফিস করে উত্তর দিলো-
-'আরে ভাই নিজের বউ বলে বলছি না, ও হেভী বুদ্ধিমতি মেয়ে। আমরা যদি কোন রেস্টুরেন্টে থাকতাম তাহলে কি ফস করে আপনার বাইকের ডিটেইলস বলতে পারতাম। বলেছে আপনার বাইকের ছবিও যেন উঠাই।'
আমি চট করে আমার বাইকের পিছনে চলে আসলাম। কে জানে, এখনই হয়তো লাইসেন্স নাম্বার জিজ্ঞেস করবে!
কি বলবো...কি বলবো... ভাবতে ভাবতে ভদ্রলোককে আবার ফিসফিসিয়ে বললাম-
-'ইয়ে মানে, আমি কি বলবো?'
-'বলেন জানু...'
-'দূর ভাই... আমি জানু বলবো কেন?'
-'সরি ভাই...একদম মাথা খারাপ হয়ে গেছে... আপনার তো আর জানু না... আপনি ভাবী বলতে পারেন... ওর নাম মিলা...আপনি বলেন মিলা ভাবী।'
-'স্লামালিকুম মিলা ভাবী।'
ওপাশ থেকে একটা রিনরিনি মিষ্টি স্বর ভেসে এলো-
-'ওয়ালাইকুম সালাম...কে আপনি? আর আপনি আমার নাম জানলেন কিভাবে?'
-'জি আপনার নাম এইমাত্র আপনার হাসবেন্ড বললেন।'
-'ও আচ্ছা। তা আপনার নাম কি?'
আমি আমতা আমতা করে বললাম-
-'আমার নাম জয়, আসিফ রহমান জয়... আমি ওয়ালটন বাইক চালাই...'
-'বাইক চালান মানে কি? চাকরি-ব্যবসা কিছু করেন না।'
আসলে আমারই ভুল হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে আমি কি করি সেটা যে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, সেটা মাথায় আসেনি। বাইকের কথাটাই মাথায় এসেছে।
-'জি অবশ্যই করি...ছোট খাটো একটা চাকরী করি।
-'আপনার অফিস কোথায়?'
কি মুশকিল! এ যে দেখছি রীতিমতো জেরা করছে! মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো! আর আমার ভয়ের কি আছে?! আমার তো আর বউ না যে ভয় পেতে হবে, বউ হলো আরেকজনের! আমিও কড়া গলায় বললাম-
-'আমার অফিস কোথায় তা জেনে আপনার কি হবে? আপনি এটুকু জানেন যে, আপনার হাসবেন্ড আমার পাশেই একটা বাইকে আছে। আমরা রেডিসনের সামনে জ্যামে...'
মিলা ভাবী আমাকে কথার মাঝখানেই থামিয়ে দিলেন।
-'অবশ্যই আমার জানতে হবে আপনার অফিস কোথায়। কারন, আমার হাসবেন্ডের অফিস আর আপনার অফিস কি যদি একই এরিয়া বা রাস্তায় না হয়, তাহলে আপনাদের দেখা হবে কি ভাবে?'
আমি ঢোক গিলে ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। ফোনের ওপর একটা হাত রেখে ফিস ফিস করে বললাম-
-'ভাই, উনি কি পুলিশে চাকরী-বাকরী করেন নাকি?'
-'না। কেন? কি জিজ্ঞেস করেছে?'
-'একেবারে পুলিশের মতো জেরা করছেন। বংশে কেউ পুলিশ আছে নাকি?'
-'ওর এক চাচা এএসপি।'
-'বেস্ট অফ লাক! আপনাদের পছন্দের বিয়ে ছিলো?'
-'নারে ভাই...সেটেল্ড ম্যারেজ।'
আমি আর ভদ্রলোক দুজন একসাথে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম-
-'আহারে বিয়ে... আহা বিয়ে...জলে ভাসা...'
ফোনে ওপাশ থেকে বললো-
-'আপনারা এতোক্ষন ফুসুর ফুসুর করে কি বললেন? ও নিশ্চই আপনাকে শিখিয়ে দিচ্ছিলো।'
-'না না কেউ কাউকে কিচ্ছু শেখায়নি। বলছিলাম কি ভাবী...'
মিলা ভাবী আবারো আমাকে থামিয়ে দিলেন-
-'ওহ আচ্ছা...এইবার আপনাকে চিনেছি...আপনি নয়ন ভাই...রাইট? আপনি নয়ন ভাই না? ইয়েস...আপনি নয়ন ভাই...এখন আমি আপনাকে পরিস্কার চিনতে পারছি...গলা শুনে প্রথমেই আমার সন্দেহ হয়েছিলো।'
-'জি না...আমি নয়ন ভাই না। আমার নাম আসিফ রহমান জয়।'
ফোনে হাত চাপা দিয়ে বললাম-
-'নয়ন ভাই কে? আমাকে বলছে আমি নাকি নয়ন ভাই।'
আমার কথা শুনেই ভদ্রলোক মাথায় হাত দিলেন-
-'হায় হায়... ফোনে আপনার গলা শুনে ওর নয়ন ভাই মনে হয়েছে! বলেন কি? এখন তো খবর আছে। নয়ন হলো আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড। আর ও নয়নকে একেবারে দেখতে পারে না।'
-'কেন দেখতে পারে না কেন?' আমার আগ্রহ সীমা ছাড়িয়ে যায়।
ভদ্রলোক এবার কিঞ্চিত লজ্জা পেলেন! রাস্তার সোডিয়ামের লাইটে তার কিঞ্চিত লজ্জিত রাঙ্গা মুখ হলদে-হলদে দেখাচ্ছিলো।
-'ইয়ে মানে আমার আগে যে এক্স ছিলো...নয়ন হচ্ছে তার থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার।'
-'মানে?'
-'মানে আমার এক্স এর সাথে আমার সম্পর্কটা ওই করিয়ে দেয়। আমাদের ম্যাসেজ ওই আদান-প্রদান করতো।'
-'সেটা বুঝলাম। কিন্তু মিলা ভাবী কিভাবে জানে এটা?'
ভদ্রলোক মাথা চুলকাতে চুলকাতে কাঁচুমাচু মুখ করে বললেন-
-'আমিই বলেছিলাম রে ভাই...'
-'আপনাকে কেউ বলেনি, যে নতুন বউকে সব বলতে হয়না...'
ভদ্রলোক মাথার চুল খামচে ধরলো-'উফ...'
আমি ফোন কানে নিলাম-
-'ভাবী আমি কিন্তু আপনার নয়ন ভাই না। আমি হলাম...'
-'না নয়ন ভাই... আপনি প্লিজ আর মিথ্যা বলবেন না। আমি আপনার গলা শুনেই চিনে ফেলেছি। আপনি কি ভেবেছেন? দুই বন্ধু মিলে আড্ডা দিচ্ছেন আর আমাকে বলছেন যে, জ্যামে আটকা পড়েছেন! কি আশ্চর্য্য? কি মনে হয় আমাকে? আমি কি এই মাত্র লঞ্চ থেকে ঢাকায় এসে নামলাম? আমাকে কি ভাবেন আপনারা? আমার তো এখন আরো বেশী সন্দেহ হচ্ছে। আপনারা দু'জন নিলার সাথে আছেন কিনা কে জানে?'
আমি ফোনে হাত চাপা দিয়ে ফিস ফিস করে বললাম-
-'ভাই, নীলা কি আপনার এক্স গার্লফ্রেন্ডের নাম?'
ভদ্রলোক আহলাদে গদ্গদ হয়ে বললেন-'হ্যা হ্যা... ঠিক বলেছেন।' পরক্ষনেই চমকে উঠলেন-'আ-আপনি জানলেন কিভাবে?'
-'আমি জানতাম না, মিলা ভাবীই তো নীলার কথা বলছেন। দূর মিয়া...এক্সের কথা বলেছেন বলেছেন আবার নামও বলেছেন...আপনি তো মহা-বেকুব!'
-'দিন দিন আমাকে দিন। আপনি তো দেখি প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলেছেন।'
লে ঠ্যালা! একেই বলে উপকারের ঘাড়ে লাত্থি। মানুষের উপকার করতে যাওয়াও দেখি বিরাট বিপদ। প্যাঁচ আমি লাগালাম কোথায়? 'মিলা-নীলা'-র প্যাচ তো অনেক আগে থেকেই লেগে আছে।
ভদ্রলোক এবার মাখনের মতো মিহি সুরে বলতে লাগলেন-
-'এই জা---নু... তুমি এসব কি বলছো? নয়ন তো এখানে নাই। নয়ন তো ওর অফিসে। ওর অফিস তো মহাখালিতে, তাই না? আর আমি এখন রেডিসনের সামনের রাস্তায়...আর উনি হলেন জয় ভাই। আর নীলাতো দেশেই থাকে না, নীলা থাকে কানাডায়...'
-'কি?...', ওপাশে নিশ্চই মিলা ভাবি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, 'নীলা কানাডায় থাকে তা তুমি জানলে কি করে? কই আগে তো বলোনি? তোমাদের মধ্যে এখনো যোগাযোগ আছে তাহলে? ছিঃ ছিঃ ছিঃ...'
ভদ্রলোক জিহবায় কামড় দিলেন। আমিও সরল মনে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলাম।
-'কানাডায় থাকে জানেন কিভাবে? ফেসবুকে যোগাযোগ আছে নাকি?'
ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি আমার মুখ চেপে ধরলেন। ফোন নিয়ে একটু দূরে চলে গেলেন। ওপাশে থেকেও নিশ্চই একই কথা জিজ্ঞেস করেছে-
-'নীলার সাথে কি তোমার ফেসবুকে যোগাযোগ আছে?'
এই অবস্থায় যত দোষ নন্দ ঘোষের! সব দোষ নিশ্চই এখন পড়বে নয়নের ওপরে। যা ভেবেছি তাই! ভদ্রলোক বললেন-
-'না না ফেসবুকে যোগাযোগ নেই... বিশ্বাস করো। ওই নয়ন সেদিন কথায় কথায় বলছিলো... বিশ্বাস করো আমি যেচে পড়ে জিজ্ঞেসও করিনি।'
এবার নিশ্চই ওপাশ থেকে মিলা ভাবী কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন-
-'ভালোই তো... নীলা এখন কানাডায় থাকে...তুমিও কানাডা চলে যাও। ওখানেই সুখে থাকবে।'
-'আহা ... আমি কেন কানাডা যাবো...'
-'যাও...'
আমি এর মধ্যে নাক গলালাম। ফোনের সামনে যেয়ে জোরে জোরে বললাম-
-'এখন কিন্তু আমরা রেডিসনের সামনে...কানাডা অনেক দূর...এই প্রসংগ আপাতত থাক।'
ভদ্রলোক হাফ ছেড়ে বাচলেন-
-'হ্যা হ্যা...সেটাই...। আমরা কিন্তু রেডিসনের সামনে তুমি নাহয় আরেকবার ভদ্রলোকের সাথে কথা বলো আর নীলার ব্যাপারটা আমি বাসায় এসে কথা বলছি জানু।'
আমি আবারো ফোন নিলাম। ওপাশ থেকে তখন মিলা ভাবী সমানে বলে চলেছেন-
-'না...আমি আর কারো সাথে কথা বলবো না। তুমি কেন এখনো নয়ন ভাইয়ের সাথে নীলাকে নিয়ে কথা বলো... সেটা আগে বলো... এখনো তোমরা দুই বন্ধু মিলে পুরনো দিনের কথাই গল্প করো। তুমি এখনো নীলাকে ভুলতে পারোনি। তুমি এখন নয়ন ভাইয়ের সাথেই আছো। উনি জয় ভাই না উনিই নয়ন ভাই...'
আমার মাথায় বুদ্ধি এলো। আমি ফোন স্পীকারে দিলাম।
-'আচ্ছা ভাবী, আমি ফোন স্পীকারে দিয়েছি। একটা কাজ করলেই আপনি বুঝে যাবেন যে, আমি নয়ন ভাই না। সেই সাথে এটাও প্রমান হয়ে যাবে যে, আপনার হাসবেন্ড নয়ন ভাইয়ের সাথে আড্ডা দিচ্ছে না।'
স্পীকারের কথা শুনে ভদ্রমহিলা মূহুর্তেই ঘ্যান ঘ্যান থামালেন-'কি কাজ?'
-'আপনাকে আমার ফোন নাম্বার দিচ্ছি। আপনি আমাকে ফোন দেন। তাহলে তো আপনি বুঝতে পারবেন যে, আমি নয়ন ভাই না। আমার নাম জয়।'
-'আমি অপরিচিত কারোর ফোন নাম্বার নেই না।'
আমি ভদ্রলোকের দিকে হতাশ চোখে তাকালাম। ফিসফিস করে বললাম-
-'ভাই, আমি কিন্তু আর সহ্য করতে পারছি না। আপনি এই জিনিষ নিয়ে থাকেন কিভাবে?'
ভদ্রলোক কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললো-
-'জানু, তুমি ওনার কথাটা একবার শোন...'
-'আচ্ছা বলেন শুনি।'
-'খুব সহজ। আপনার কাছে নিশ্চই নয়ন ভাইয়ের নাম্বার আছে। আমার নাম্বার আর নয়ন ভাইয়ের নাম্বার নিশ্চই এক না। কাজেই, আমি যদি নয়ন ভাই হই তাহলে এখন যে নাম্বার আপনাকে দেবো, সেই নাম্বারে আপনি ফোন দিলেই নয়ন ভাইয়ের নাম অবশ্যই আপনার ফোনের ডিসপ্লেতে উঠবে।'
-'হুম...'
-'যদি ওঠে, তাহলে আপনি জিতে গেলেন। আর যদি না ওঠে তাহলে আমি জিতে গেলাম আই মিন আপনার হাসবেন্ড জিতে গেলো। আর তাহলে আপনাকে বিশ্বাস করতেই হবে যে, আমরা জ্যামে আটকা পড়ে আছি।'
-'হুম... আপনার কথায় যুক্তি আছে।'
আমরা হাফ ছেড়ে বাচলাম! কিন্তু সাথে সাথেই মিলা ভাবী ওপাশ থেকে বললেন-
-'এটাও তো হতে পারে যে, আপনি আসলেই নয়ন ভাই এবং আপনার সেকেন্ড আরেকটা সিম আছে।'
অকাট্য যুক্তি!
আমি ফোনে হাত চেপে ফিসফিসিয়ে বললাম-'মিলা ভাবীর বাবা কি উকিল নাকি?'
ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন-'ঠিক ধরেছেন! আপনি জানলেন কি করে?'
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আশে-পাশে সবাই তখন তামাসা দেখছে। আমি বললাম-
-'দেখুন, এটা ছাড়া আপাতত আর কোন উপায় নেই। আপনি আগে চেক করে দেখেন, যে, আমি নয়ন ভাই নাকি? তারপর আজকের মতো ওনাকে মাফ করে দেন। এরপর যেকোন দিন কোন একটা ফোন-ফ্যাক্সের দোকান থেকে এই নাম্বারে ফোন দিলেই শিওর হতে পারবেন যে, আসলেই আমি নয়ন কি না।'
-'আচ্ছা, আপনার নাম্বার দিন। আমি কল করছি।'
আমি নাম্বার দিলাম। হতচ্ছাড়া জ্যাম ছাড়ে না কেন?
ফোন এলো। আমি স্পীকারে ফোন রিসিভ করে সালাম দিলাম।
-'হুম... নয়ন ভাইয়ের নাম উঠলো না। আর এখন আপনার গলাটাও একটু অন্যরকম শোনাচ্ছে। আর নয়ন ভাই কখনো ফোন ধরে সালাম দেয় না। সালাম দেয়াটা কিন্তু উচিত তাই না বলেন?'
-'জি...ঠিক বলেছেন।
আমি খুব দ্রুত একমত হলাম।
-'সরি... আপনাকে হয়তো একটু ডিসটার্ব করলাম। কি করবো বলুন... সময়টাই খারাপ। এ সময় সবারই উচিত হাসবেন্ডকে একটু চোখে চোখে রাখা। ভাবী ও নিশ্চয়ই আপনাকে খুব চোখে চোখে রাখে।'
আমি ঢোক গিলে বললাম-
-'জি... তা রাখে। আপনার মতোই রাখে। আচ্ছা... আপনি এখন আপনার হাসবেন্ডের সাথে কথা বলুন। আমি ফোন রাখছি।'
-'শোনেন... ওর থেকে আমাদের বাসার ঠিকানাটা নিয়ে নেন। অবশ্যই ভাবীকে নিয়ে একদিন আমাদের বাসা থেকে বেড়িয়ে যাবেন।'
-'জি অবশ্যই বেড়াতে আসবো ... রাখি ... ভালো থাকবেন।'
-'বাই।'
আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাকালাম। ভদ্রলোকের মুখে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটে উঠলো। অনেকক্ষন ধরে আমার হাত ধরে ঝাঁকাঝাঁকি করলেন।
-'আসলে নেটের ডাটা শেষ না হয়ে গেলে এসব সমস্যা হতো না। একটা ছবি তুললেই ওকে বোঝানো যেতো। সরি... আপনাকে অনেক বিরক্ত করলাম।'
আমি হাসিমুখে বললাম-'না না...ঠিক আছে।'
-'নতুন নতুন বিয়ে তো! ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে... তাই না?'
আমি আবার জোর করে হেসে বললাম-'অবশ্যই।'
এমন সময় ভদ্রলোকের ফোন বেজে উঠলো। ভদ্রলোক একটু তফাতে সরে গেলেন। এখন খুব হাসি-মুখেই কথা বলছেন। আমি দূর থেকেই শুনতে পাচ্ছি। এক পর্যায়ে বললো-
-'আচ্ছা... এবার তাহলে ফোন রাখো জানু...'
ওপাশ থেকে মিলা ভাবী নিশ্চই বললেন-
-'না...তুমি আগে রাখো...'
-'না তুমি...'
-'না তুমি...'
-'তুমি...'
-'তুমি...'
এভাবেই হয়তো চলতে থাকতো আজীবন। কিন্তু হঠাৎ করেই দমবন্ধ করা জ্যাম ছেড়ে দিলো। আমরা সবাই তাড়াহুড়া করে যে যার বাইকে স্টার্ট দিলাম।
দিন দুই পরের কথা।
অফিস থেকে বাসায় ফিরে হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসেছি। এমন সময় মোবাইল বেজে উঠলো-আননোউন নাম্বার থেকে কল এসেছে। আমি ফোন রিসিভ করলাম।
-'হ্যালো...স্লামালিকুম।'
ওপাশ থেকে মোটা ও ভারী গলায় কেউ বললো-
-'নয়ন সাহেব বলছেন?'
নাম শোনার সাথে সাথেই রেডিসনের সামনের পুরা ঘটনাটা মনে পড়ে গেলো। নিশ্চই মিলা ভাবী চেক করার জন্য ফোন করেছেন। একবার ভাবলাম দেবো নাকি প্যাঁচ লাগিয়ে! এখন শুধু বললেই হবে যে-'জি নয়ন বলছি।' কিন্তু মিলা ভাবীর ভালো মানুষ হাসবেন্ডটার জন্য মায়াই লাগলো। আহারে বেচারা! আমি গম্ভীর গলায় বললাম-
-'জি না... এটা নয়ন সাহেবের নাম্বার না।'
সাথে সাথেই মোটা ও ভারী গলা পালটে সেই মিষ্টি রিনরিনে মেয়েলি গলা শোনা গেলো। তার মানে উনি বুদ্ধি করে গলা চেঞ্জ করে জিজ্ঞেস করেছেন যাতে আমি নয়ন ভাই হলে ধরতে না পারি।
-'জয় ভাই বলছেন? আমি মিলা বলছি। ভাইয়া ভালো আছেন? ভাবী ভালো আছে?'
আচ্ছা মুসিবতে পড়া গেলো! এই মেয়ের থেকে মিনিমাম সত্তর হাত দূরে থাকা দরকার! এই মেয়ে আমার বউয়ের সাথে তিরিশ মিনিট কথা বললে পরবর্তীতে আমার বউ আর বউ থাকবে না, দারোগা হয়ে যাবে। আমি মিহি গলায় বললাম-
-'জি ভালো আছি। কিন্তু আমি একটা জরুরী মিটিং এ আছি। পরে কথা বলবো ...কেমন?'
ফোন রেখে নাম্বার ব্লক করে দিলাম। ভাগ্য ভালো স্মার্ট ফোনে ব্লকের অপশন আছে। তাকিয়ে দেখি আমার বউ কঠিন মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাকাতেই ভুরূ উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
-'কি ব্যাপার? কে ফোন করেছিলো যে, মিটিং এর কথা বললে। মেয়ের গলা বলে মনে হলো...'
আমি দীর্ঘশবাস ফেললাম! ভাত মাখাতে মাখাতে বললাম-
-'আসো, তোমাকে একটা প্রায়-আজগুবি ধরনের গল্প শোনাই। মিলা-নীলা-নয়ন আর একজন ভদ্রলোকের গল্প।'
আমি গল্প বলা শুরু করি। আগ্রহের আতিশয্যে আমার বউয়ের চোখ চকচক করে ওঠে!
মূল লেখক : জনাব আসিফ রহমান জয়
জ্যাম! জ্যাম!! আর জ্যাম!!! ভীষন-জ্যাম! ভয়াবহ-জ্যাম! নাহ... কোন বিশেষনই আসলে উপযুক্ত মনে হচ্ছে না! একটাই হতে পারে "দমবন্ধ" করা জ্যাম!!
জানুয়ারী মাসের ঘটনা।
এ বছরের শুরু থেকেই ঢাকার রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম পড়েছে! একদিকে আন্তর্জাতিক বানিজ্যমেলা, আরেকদিকে মেট্রোরেলের চলমান কাজ – দুইয়ে মিলে শহরটাকে কেমন যেন চেপে ধরেছে। সন্ধ্যা সাতটা মতো বাজে। হোটেল রেডিসনের সামনে সব যানবাহন স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কারো নড়ার উপায় নেই। বাস-গাড়ী-সিএনজি-বাইক সব ইঞ্জিন বন্ধ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কিছু গাড়ী চালককে দেখছি সিটটা ইজি করে পিছনে ঠেলে দিয়ে আয়েস করে রেডিও বা গান শুনছে। কিছু বাদামওয়ালা, চানাচুরভাজা, শসাওয়ালা, পানিবিক্রেতাকে জ্যামের ফাঁকে ফাঁকে হাঁক-ডাক দিতে দেখা যাচ্ছে। এরা সাধারনত রাস্তার সিগন্যালের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এদের মাঝ রাস্তায় দেখা পাওয়া মানেই জ্যাম অবশ্যই ভয়াবহ আকার ধারন করেছে!
আমি বাইক চালাই। রাস্তায় যতই জ্যাম থাকুক, বাম পাশের সরু একটা 'চিপা' জায়গা দিয়ে শম্বুক গতিতে বাইকগুলো চলাচল করতে পারে। অথচ আজ বাইকেরও যাবার কায়দা নেই। বাইকাররা পর্যন্ত বাইক স্ট্যান্ড করে মাথার হেলমেট খুলে মোড়ামুড়ি করছে।
বললাম না, যাকে বলে একেবারে দমবন্ধ করা জ্যাম! এরই মধ্যে হঠাৎই কানে ভেসে এলো অস্থির এক কন্ঠ!
ভদ্রলোক এতোক্ষন তার বাইকের উপর বসে মোবাইলে কথা বলছিলেন। আমার বাইকের ডান পাশেই তার বাইক রাখা। এখন বাইক থেকে নেমে অস্থির ভাবে মোবাইলে কথা বলতে বলতে পায়চারি করছেন-
-'হ্যা আমি অনেকক্ষন ধরেই জ্যামে আটকা পরে আছি, জানু। রেডিসনের ঠিক সামনে... বুঝলে...হ্যা হ্যা অনেক জ্যাম। আরে নাহ... আমি অফিস থেকে ঠিক সময়েই বেরিয়েছি, জানু... একটুও লেট করিনি।'
এভাবে অন্যের কথা কান পেতে শোনা নিশ্চই ঠিক না। কিন্তু কি করবো বলেন? ওই যে বললাম, দমবন্ধ করা জ্যামে আটকা পড়েছি। করার কিচ্ছু নেই। আর ভদ্রলোক যেভাবে জোরে জোরে চিৎকার করে কথা বলছেন, তাতে কান পাতার ও দরকার নেই। এমনিতেই সব শোনা যাচ্ছে।
-'না না...এখানে তো কখনোই এতো জ্যাম পরে না। কিন্তু এখন পরে গেছে...আমি কি করবো বলো জানু? না না...আমি জ্যামের বাহানা করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিনা.. বিলিভ মি জানু...'
(একবার ভাবলাম জিজ্ঞেস করি যে, জানুয়ারী মাস বলেই কি 'জানু'? ফেব্রুয়ারী হলে কি 'ফেবু' বলতেন?)
-'বিশ্বাস করো জানু... পুরা রাস্তাই কমপ্যাক্ট হয়ে আছে। এমনকি ওপাশের রাস্তাতেও সব গাড়ি থেমে আছে।'
-'কি বললে? রাস্তার গাড়ীর আওয়াজ পাচ্ছো না কেন? আরে আওয়াজ পাবে কিভাবে? সব গাড়ীই তো থেমে আছে। না না...আমি কোন রেস্টুরেন্টে আড্ডা দিচ্ছি না। আমি জ্যামের ছবিও তুলে রেখেছি। কিন্তু মোবাইল ডাটা শেষ হয়ে গেছে বলে আমি তোমাকে ছবিও পাঠাতে পারছি না। আমি বাসায় এসেই দেখাচ্ছি...প্লিজ সুইটু বিশ্বাস করো...'
বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, ভদ্রলোক ভালো বিপদেই পড়েছেন। ফোনের ওপাশে নিশ্চই ওনার স্ত্রী অথবা প্রেমিকা। বাসায় যেয়ে যেহেতু ছবি দেখাবেন কাজেই প্রেমিকা না, স্ত্রীই হবে। নিশ্চই সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী, স্বামী দেরী করছে বলে অস্থির হয়ে গেছে। এদিকে উনি যে জ্যামে পড়েছেন এটা মোটেই বিশ্বাস করছেন না। ভেবেছ যে, উনি জ্যামের বাহানা করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছেন। আহারে... মনে মনে মুচকি হাসলাম। কিন্তু কারো বিপদে যে মনে মনে হাসা উচিত না, এটা একেবারেই মনে ছিলো না।
-'আচ্ছা ঠিক আছে...আমার কথা তো বিশ্বাস হচ্ছে না? দাড়াও, আমি আশে-পাশের কাউকে দিয়ে তোমাকে ফোনে ধরাচ্ছি...এই যে ভাই... জি আপনি...আপনাকে বলছি...আমার একটা উপকার করবেন? প্লিজ...'
বলেছিলাম না। কারো বিপদে মনে মনে হাসা ঠিক না। এবার হলো তো? ভদ্রলোক আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমি বললাম-
-'আমাকে বলছেন?
-'জি... ভাই কিছু মনে করেন না। আমার বউ...আই মিন...নতুন বিয়ে করেছি তো... জ্যামে আটকা পড়েছি কিছুতেই বিশ্বাস করছে না।'
-'তো আমি কি করবো?'
-'আপনি আমার হয়ে একটু বলুন না...যে...আমি জ্যামে পড়েছি। গাড়ি-বাস কিছুই নড়ছে না।'
মানুষ আকাশ থেকে পড়ে, আমি তিনতলা থেকে পড়লাম!
-'কি অসম্ভব কান্ড! কি বলছেন এসব? আমি আপনাকে চিনি না...আপনি আমাকে চেনেন না। আর আমি আপনার হয়ে আপনার বউকে কিইবা বলবো?'
-'আরে ভাই যা সত্যি তাই বলবেন। প্লিজ এই উপকারটুকু করেন।'
আমার মাথায় তখন অন্য আর একটা চিন্তা ঢুকে পড়েছে। ব্যাটা ছিনতাইকারী না তো?
-'ওয়েট ওয়েট ওয়েট। ভাই, এই স্টাইলে আজকাল ছিনতাইও হয়। আমি আপনার হয়ে ফোনে কথা বলবো। আশে-পাশের লোকেরা ভাববে যে, আপনি আমার পরিচিত। তারপর জ্যাম ছেড়ে দিলেই আপনি খুব সুন্দর করে আমাকে বলবেন যা আছে সব দিয়ে দে...।'
ভদ্রলোক হেলমেট খুলে ফেললেন। এই শীতের মধ্যেও ঘেমে গেছেন। হাত দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বললেন-
-'ভাই আমাকে আপনার ছিনতাইকারী বলে মনে হয়? সিরিয়াসলি?'
আশে-পাশের আরো দুই-চারজন লোকও এতোক্ষন আমার আর ভদ্রলোকের কথা শুনছিলেন। তারাও দরবার করলেন-
-'বলেন ভাই বলেন...একটু ফোনে কথা বলে দেন। বেচারা বিপদে পড়েছে...'
আমি ঘাড় ঝাঁকিয়ে শ্রাগ করলাম-'ঠিক আছে, করেন ফোন।'
-'হ্যালো জানু...শুনছো? এই যে... তুমি তো আমাকে বিশ্বাস করো না। এই যে, আমার পাশেই একজন ভদ্রলোক বাইকে আছেন, তুমি ওনার সাথে কথা বলো... না না আমার বাইকে থাকবেন কেন? উনি ওনার বাইকে আছেন। কি মডেলের বাইক? কি বাইক জেনে তুমি কি করবে? ওয়ালটন... ওয়ালটন এক্সপ্লোর...১৪০ সিসি? তুমি ওনার সাথে কথা বললেই...বুঝতে পারবে যে, আমি কি ভীষন জ্যামে আটকা পড়েছি... ঠিক আছে জানু...এই নাও...'
আমি ফোন হাতে নিতে নিতে ভদ্রলোককে চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলাম-
-'বাইকের মডেল জিজ্ঞেস করলো কেন?'
ভদ্রলোকও ফিসফিস করে উত্তর দিলো-
-'আরে ভাই নিজের বউ বলে বলছি না, ও হেভী বুদ্ধিমতি মেয়ে। আমরা যদি কোন রেস্টুরেন্টে থাকতাম তাহলে কি ফস করে আপনার বাইকের ডিটেইলস বলতে পারতাম। বলেছে আপনার বাইকের ছবিও যেন উঠাই।'
আমি চট করে আমার বাইকের পিছনে চলে আসলাম। কে জানে, এখনই হয়তো লাইসেন্স নাম্বার জিজ্ঞেস করবে!
কি বলবো...কি বলবো... ভাবতে ভাবতে ভদ্রলোককে আবার ফিসফিসিয়ে বললাম-
-'ইয়ে মানে, আমি কি বলবো?'
-'বলেন জানু...'
-'দূর ভাই... আমি জানু বলবো কেন?'
-'সরি ভাই...একদম মাথা খারাপ হয়ে গেছে... আপনার তো আর জানু না... আপনি ভাবী বলতে পারেন... ওর নাম মিলা...আপনি বলেন মিলা ভাবী।'
-'স্লামালিকুম মিলা ভাবী।'
ওপাশ থেকে একটা রিনরিনি মিষ্টি স্বর ভেসে এলো-
-'ওয়ালাইকুম সালাম...কে আপনি? আর আপনি আমার নাম জানলেন কিভাবে?'
-'জি আপনার নাম এইমাত্র আপনার হাসবেন্ড বললেন।'
-'ও আচ্ছা। তা আপনার নাম কি?'
আমি আমতা আমতা করে বললাম-
-'আমার নাম জয়, আসিফ রহমান জয়... আমি ওয়ালটন বাইক চালাই...'
-'বাইক চালান মানে কি? চাকরি-ব্যবসা কিছু করেন না।'
আসলে আমারই ভুল হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে আমি কি করি সেটা যে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, সেটা মাথায় আসেনি। বাইকের কথাটাই মাথায় এসেছে।
-'জি অবশ্যই করি...ছোট খাটো একটা চাকরী করি।
-'আপনার অফিস কোথায়?'
কি মুশকিল! এ যে দেখছি রীতিমতো জেরা করছে! মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো! আর আমার ভয়ের কি আছে?! আমার তো আর বউ না যে ভয় পেতে হবে, বউ হলো আরেকজনের! আমিও কড়া গলায় বললাম-
-'আমার অফিস কোথায় তা জেনে আপনার কি হবে? আপনি এটুকু জানেন যে, আপনার হাসবেন্ড আমার পাশেই একটা বাইকে আছে। আমরা রেডিসনের সামনে জ্যামে...'
মিলা ভাবী আমাকে কথার মাঝখানেই থামিয়ে দিলেন।
-'অবশ্যই আমার জানতে হবে আপনার অফিস কোথায়। কারন, আমার হাসবেন্ডের অফিস আর আপনার অফিস কি যদি একই এরিয়া বা রাস্তায় না হয়, তাহলে আপনাদের দেখা হবে কি ভাবে?'
আমি ঢোক গিলে ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। ফোনের ওপর একটা হাত রেখে ফিস ফিস করে বললাম-
-'ভাই, উনি কি পুলিশে চাকরী-বাকরী করেন নাকি?'
-'না। কেন? কি জিজ্ঞেস করেছে?'
-'একেবারে পুলিশের মতো জেরা করছেন। বংশে কেউ পুলিশ আছে নাকি?'
-'ওর এক চাচা এএসপি।'
-'বেস্ট অফ লাক! আপনাদের পছন্দের বিয়ে ছিলো?'
-'নারে ভাই...সেটেল্ড ম্যারেজ।'
আমি আর ভদ্রলোক দুজন একসাথে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম-
-'আহারে বিয়ে... আহা বিয়ে...জলে ভাসা...'
ফোনে ওপাশ থেকে বললো-
-'আপনারা এতোক্ষন ফুসুর ফুসুর করে কি বললেন? ও নিশ্চই আপনাকে শিখিয়ে দিচ্ছিলো।'
-'না না কেউ কাউকে কিচ্ছু শেখায়নি। বলছিলাম কি ভাবী...'
মিলা ভাবী আবারো আমাকে থামিয়ে দিলেন-
-'ওহ আচ্ছা...এইবার আপনাকে চিনেছি...আপনি নয়ন ভাই...রাইট? আপনি নয়ন ভাই না? ইয়েস...আপনি নয়ন ভাই...এখন আমি আপনাকে পরিস্কার চিনতে পারছি...গলা শুনে প্রথমেই আমার সন্দেহ হয়েছিলো।'
-'জি না...আমি নয়ন ভাই না। আমার নাম আসিফ রহমান জয়।'
ফোনে হাত চাপা দিয়ে বললাম-
-'নয়ন ভাই কে? আমাকে বলছে আমি নাকি নয়ন ভাই।'
আমার কথা শুনেই ভদ্রলোক মাথায় হাত দিলেন-
-'হায় হায়... ফোনে আপনার গলা শুনে ওর নয়ন ভাই মনে হয়েছে! বলেন কি? এখন তো খবর আছে। নয়ন হলো আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড। আর ও নয়নকে একেবারে দেখতে পারে না।'
-'কেন দেখতে পারে না কেন?' আমার আগ্রহ সীমা ছাড়িয়ে যায়।
ভদ্রলোক এবার কিঞ্চিত লজ্জা পেলেন! রাস্তার সোডিয়ামের লাইটে তার কিঞ্চিত লজ্জিত রাঙ্গা মুখ হলদে-হলদে দেখাচ্ছিলো।
-'ইয়ে মানে আমার আগে যে এক্স ছিলো...নয়ন হচ্ছে তার থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার।'
-'মানে?'
-'মানে আমার এক্স এর সাথে আমার সম্পর্কটা ওই করিয়ে দেয়। আমাদের ম্যাসেজ ওই আদান-প্রদান করতো।'
-'সেটা বুঝলাম। কিন্তু মিলা ভাবী কিভাবে জানে এটা?'
ভদ্রলোক মাথা চুলকাতে চুলকাতে কাঁচুমাচু মুখ করে বললেন-
-'আমিই বলেছিলাম রে ভাই...'
-'আপনাকে কেউ বলেনি, যে নতুন বউকে সব বলতে হয়না...'
ভদ্রলোক মাথার চুল খামচে ধরলো-'উফ...'
আমি ফোন কানে নিলাম-
-'ভাবী আমি কিন্তু আপনার নয়ন ভাই না। আমি হলাম...'
-'না নয়ন ভাই... আপনি প্লিজ আর মিথ্যা বলবেন না। আমি আপনার গলা শুনেই চিনে ফেলেছি। আপনি কি ভেবেছেন? দুই বন্ধু মিলে আড্ডা দিচ্ছেন আর আমাকে বলছেন যে, জ্যামে আটকা পড়েছেন! কি আশ্চর্য্য? কি মনে হয় আমাকে? আমি কি এই মাত্র লঞ্চ থেকে ঢাকায় এসে নামলাম? আমাকে কি ভাবেন আপনারা? আমার তো এখন আরো বেশী সন্দেহ হচ্ছে। আপনারা দু'জন নিলার সাথে আছেন কিনা কে জানে?'
আমি ফোনে হাত চাপা দিয়ে ফিস ফিস করে বললাম-
-'ভাই, নীলা কি আপনার এক্স গার্লফ্রেন্ডের নাম?'
ভদ্রলোক আহলাদে গদ্গদ হয়ে বললেন-'হ্যা হ্যা... ঠিক বলেছেন।' পরক্ষনেই চমকে উঠলেন-'আ-আপনি জানলেন কিভাবে?'
-'আমি জানতাম না, মিলা ভাবীই তো নীলার কথা বলছেন। দূর মিয়া...এক্সের কথা বলেছেন বলেছেন আবার নামও বলেছেন...আপনি তো মহা-বেকুব!'
-'দিন দিন আমাকে দিন। আপনি তো দেখি প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলেছেন।'
লে ঠ্যালা! একেই বলে উপকারের ঘাড়ে লাত্থি। মানুষের উপকার করতে যাওয়াও দেখি বিরাট বিপদ। প্যাঁচ আমি লাগালাম কোথায়? 'মিলা-নীলা'-র প্যাচ তো অনেক আগে থেকেই লেগে আছে।
ভদ্রলোক এবার মাখনের মতো মিহি সুরে বলতে লাগলেন-
-'এই জা---নু... তুমি এসব কি বলছো? নয়ন তো এখানে নাই। নয়ন তো ওর অফিসে। ওর অফিস তো মহাখালিতে, তাই না? আর আমি এখন রেডিসনের সামনের রাস্তায়...আর উনি হলেন জয় ভাই। আর নীলাতো দেশেই থাকে না, নীলা থাকে কানাডায়...'
-'কি?...', ওপাশে নিশ্চই মিলা ভাবি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, 'নীলা কানাডায় থাকে তা তুমি জানলে কি করে? কই আগে তো বলোনি? তোমাদের মধ্যে এখনো যোগাযোগ আছে তাহলে? ছিঃ ছিঃ ছিঃ...'
ভদ্রলোক জিহবায় কামড় দিলেন। আমিও সরল মনে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলাম।
-'কানাডায় থাকে জানেন কিভাবে? ফেসবুকে যোগাযোগ আছে নাকি?'
ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি আমার মুখ চেপে ধরলেন। ফোন নিয়ে একটু দূরে চলে গেলেন। ওপাশে থেকেও নিশ্চই একই কথা জিজ্ঞেস করেছে-
-'নীলার সাথে কি তোমার ফেসবুকে যোগাযোগ আছে?'
এই অবস্থায় যত দোষ নন্দ ঘোষের! সব দোষ নিশ্চই এখন পড়বে নয়নের ওপরে। যা ভেবেছি তাই! ভদ্রলোক বললেন-
-'না না ফেসবুকে যোগাযোগ নেই... বিশ্বাস করো। ওই নয়ন সেদিন কথায় কথায় বলছিলো... বিশ্বাস করো আমি যেচে পড়ে জিজ্ঞেসও করিনি।'
এবার নিশ্চই ওপাশ থেকে মিলা ভাবী কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন-
-'ভালোই তো... নীলা এখন কানাডায় থাকে...তুমিও কানাডা চলে যাও। ওখানেই সুখে থাকবে।'
-'আহা ... আমি কেন কানাডা যাবো...'
-'যাও...'
আমি এর মধ্যে নাক গলালাম। ফোনের সামনে যেয়ে জোরে জোরে বললাম-
-'এখন কিন্তু আমরা রেডিসনের সামনে...কানাডা অনেক দূর...এই প্রসংগ আপাতত থাক।'
ভদ্রলোক হাফ ছেড়ে বাচলেন-
-'হ্যা হ্যা...সেটাই...। আমরা কিন্তু রেডিসনের সামনে তুমি নাহয় আরেকবার ভদ্রলোকের সাথে কথা বলো আর নীলার ব্যাপারটা আমি বাসায় এসে কথা বলছি জানু।'
আমি আবারো ফোন নিলাম। ওপাশ থেকে তখন মিলা ভাবী সমানে বলে চলেছেন-
-'না...আমি আর কারো সাথে কথা বলবো না। তুমি কেন এখনো নয়ন ভাইয়ের সাথে নীলাকে নিয়ে কথা বলো... সেটা আগে বলো... এখনো তোমরা দুই বন্ধু মিলে পুরনো দিনের কথাই গল্প করো। তুমি এখনো নীলাকে ভুলতে পারোনি। তুমি এখন নয়ন ভাইয়ের সাথেই আছো। উনি জয় ভাই না উনিই নয়ন ভাই...'
আমার মাথায় বুদ্ধি এলো। আমি ফোন স্পীকারে দিলাম।
-'আচ্ছা ভাবী, আমি ফোন স্পীকারে দিয়েছি। একটা কাজ করলেই আপনি বুঝে যাবেন যে, আমি নয়ন ভাই না। সেই সাথে এটাও প্রমান হয়ে যাবে যে, আপনার হাসবেন্ড নয়ন ভাইয়ের সাথে আড্ডা দিচ্ছে না।'
স্পীকারের কথা শুনে ভদ্রমহিলা মূহুর্তেই ঘ্যান ঘ্যান থামালেন-'কি কাজ?'
-'আপনাকে আমার ফোন নাম্বার দিচ্ছি। আপনি আমাকে ফোন দেন। তাহলে তো আপনি বুঝতে পারবেন যে, আমি নয়ন ভাই না। আমার নাম জয়।'
-'আমি অপরিচিত কারোর ফোন নাম্বার নেই না।'
আমি ভদ্রলোকের দিকে হতাশ চোখে তাকালাম। ফিসফিস করে বললাম-
-'ভাই, আমি কিন্তু আর সহ্য করতে পারছি না। আপনি এই জিনিষ নিয়ে থাকেন কিভাবে?'
ভদ্রলোক কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললো-
-'জানু, তুমি ওনার কথাটা একবার শোন...'
-'আচ্ছা বলেন শুনি।'
-'খুব সহজ। আপনার কাছে নিশ্চই নয়ন ভাইয়ের নাম্বার আছে। আমার নাম্বার আর নয়ন ভাইয়ের নাম্বার নিশ্চই এক না। কাজেই, আমি যদি নয়ন ভাই হই তাহলে এখন যে নাম্বার আপনাকে দেবো, সেই নাম্বারে আপনি ফোন দিলেই নয়ন ভাইয়ের নাম অবশ্যই আপনার ফোনের ডিসপ্লেতে উঠবে।'
-'হুম...'
-'যদি ওঠে, তাহলে আপনি জিতে গেলেন। আর যদি না ওঠে তাহলে আমি জিতে গেলাম আই মিন আপনার হাসবেন্ড জিতে গেলো। আর তাহলে আপনাকে বিশ্বাস করতেই হবে যে, আমরা জ্যামে আটকা পড়ে আছি।'
-'হুম... আপনার কথায় যুক্তি আছে।'
আমরা হাফ ছেড়ে বাচলাম! কিন্তু সাথে সাথেই মিলা ভাবী ওপাশ থেকে বললেন-
-'এটাও তো হতে পারে যে, আপনি আসলেই নয়ন ভাই এবং আপনার সেকেন্ড আরেকটা সিম আছে।'
অকাট্য যুক্তি!
আমি ফোনে হাত চেপে ফিসফিসিয়ে বললাম-'মিলা ভাবীর বাবা কি উকিল নাকি?'
ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন-'ঠিক ধরেছেন! আপনি জানলেন কি করে?'
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আশে-পাশে সবাই তখন তামাসা দেখছে। আমি বললাম-
-'দেখুন, এটা ছাড়া আপাতত আর কোন উপায় নেই। আপনি আগে চেক করে দেখেন, যে, আমি নয়ন ভাই নাকি? তারপর আজকের মতো ওনাকে মাফ করে দেন। এরপর যেকোন দিন কোন একটা ফোন-ফ্যাক্সের দোকান থেকে এই নাম্বারে ফোন দিলেই শিওর হতে পারবেন যে, আসলেই আমি নয়ন কি না।'
-'আচ্ছা, আপনার নাম্বার দিন। আমি কল করছি।'
আমি নাম্বার দিলাম। হতচ্ছাড়া জ্যাম ছাড়ে না কেন?
ফোন এলো। আমি স্পীকারে ফোন রিসিভ করে সালাম দিলাম।
-'হুম... নয়ন ভাইয়ের নাম উঠলো না। আর এখন আপনার গলাটাও একটু অন্যরকম শোনাচ্ছে। আর নয়ন ভাই কখনো ফোন ধরে সালাম দেয় না। সালাম দেয়াটা কিন্তু উচিত তাই না বলেন?'
-'জি...ঠিক বলেছেন।
আমি খুব দ্রুত একমত হলাম।
-'সরি... আপনাকে হয়তো একটু ডিসটার্ব করলাম। কি করবো বলুন... সময়টাই খারাপ। এ সময় সবারই উচিত হাসবেন্ডকে একটু চোখে চোখে রাখা। ভাবী ও নিশ্চয়ই আপনাকে খুব চোখে চোখে রাখে।'
আমি ঢোক গিলে বললাম-
-'জি... তা রাখে। আপনার মতোই রাখে। আচ্ছা... আপনি এখন আপনার হাসবেন্ডের সাথে কথা বলুন। আমি ফোন রাখছি।'
-'শোনেন... ওর থেকে আমাদের বাসার ঠিকানাটা নিয়ে নেন। অবশ্যই ভাবীকে নিয়ে একদিন আমাদের বাসা থেকে বেড়িয়ে যাবেন।'
-'জি অবশ্যই বেড়াতে আসবো ... রাখি ... ভালো থাকবেন।'
-'বাই।'
আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাকালাম। ভদ্রলোকের মুখে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটে উঠলো। অনেকক্ষন ধরে আমার হাত ধরে ঝাঁকাঝাঁকি করলেন।
-'আসলে নেটের ডাটা শেষ না হয়ে গেলে এসব সমস্যা হতো না। একটা ছবি তুললেই ওকে বোঝানো যেতো। সরি... আপনাকে অনেক বিরক্ত করলাম।'
আমি হাসিমুখে বললাম-'না না...ঠিক আছে।'
-'নতুন নতুন বিয়ে তো! ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে... তাই না?'
আমি আবার জোর করে হেসে বললাম-'অবশ্যই।'
এমন সময় ভদ্রলোকের ফোন বেজে উঠলো। ভদ্রলোক একটু তফাতে সরে গেলেন। এখন খুব হাসি-মুখেই কথা বলছেন। আমি দূর থেকেই শুনতে পাচ্ছি। এক পর্যায়ে বললো-
-'আচ্ছা... এবার তাহলে ফোন রাখো জানু...'
ওপাশ থেকে মিলা ভাবী নিশ্চই বললেন-
-'না...তুমি আগে রাখো...'
-'না তুমি...'
-'না তুমি...'
-'তুমি...'
-'তুমি...'
এভাবেই হয়তো চলতে থাকতো আজীবন। কিন্তু হঠাৎ করেই দমবন্ধ করা জ্যাম ছেড়ে দিলো। আমরা সবাই তাড়াহুড়া করে যে যার বাইকে স্টার্ট দিলাম।
দিন দুই পরের কথা।
অফিস থেকে বাসায় ফিরে হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসেছি। এমন সময় মোবাইল বেজে উঠলো-আননোউন নাম্বার থেকে কল এসেছে। আমি ফোন রিসিভ করলাম।
-'হ্যালো...স্লামালিকুম।'
ওপাশ থেকে মোটা ও ভারী গলায় কেউ বললো-
-'নয়ন সাহেব বলছেন?'
নাম শোনার সাথে সাথেই রেডিসনের সামনের পুরা ঘটনাটা মনে পড়ে গেলো। নিশ্চই মিলা ভাবী চেক করার জন্য ফোন করেছেন। একবার ভাবলাম দেবো নাকি প্যাঁচ লাগিয়ে! এখন শুধু বললেই হবে যে-'জি নয়ন বলছি।' কিন্তু মিলা ভাবীর ভালো মানুষ হাসবেন্ডটার জন্য মায়াই লাগলো। আহারে বেচারা! আমি গম্ভীর গলায় বললাম-
-'জি না... এটা নয়ন সাহেবের নাম্বার না।'
সাথে সাথেই মোটা ও ভারী গলা পালটে সেই মিষ্টি রিনরিনে মেয়েলি গলা শোনা গেলো। তার মানে উনি বুদ্ধি করে গলা চেঞ্জ করে জিজ্ঞেস করেছেন যাতে আমি নয়ন ভাই হলে ধরতে না পারি।
-'জয় ভাই বলছেন? আমি মিলা বলছি। ভাইয়া ভালো আছেন? ভাবী ভালো আছে?'
আচ্ছা মুসিবতে পড়া গেলো! এই মেয়ের থেকে মিনিমাম সত্তর হাত দূরে থাকা দরকার! এই মেয়ে আমার বউয়ের সাথে তিরিশ মিনিট কথা বললে পরবর্তীতে আমার বউ আর বউ থাকবে না, দারোগা হয়ে যাবে। আমি মিহি গলায় বললাম-
-'জি ভালো আছি। কিন্তু আমি একটা জরুরী মিটিং এ আছি। পরে কথা বলবো ...কেমন?'
ফোন রেখে নাম্বার ব্লক করে দিলাম। ভাগ্য ভালো স্মার্ট ফোনে ব্লকের অপশন আছে। তাকিয়ে দেখি আমার বউ কঠিন মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাকাতেই ভুরূ উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
-'কি ব্যাপার? কে ফোন করেছিলো যে, মিটিং এর কথা বললে। মেয়ের গলা বলে মনে হলো...'
আমি দীর্ঘশবাস ফেললাম! ভাত মাখাতে মাখাতে বললাম-
-'আসো, তোমাকে একটা প্রায়-আজগুবি ধরনের গল্প শোনাই। মিলা-নীলা-নয়ন আর একজন ভদ্রলোকের গল্প।'
আমি গল্প বলা শুরু করি। আগ্রহের আতিশয্যে আমার বউয়ের চোখ চকচক করে ওঠে!