প্রাচীন মিশরীয় জাদুবিদ্যা ছিল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং চিকিৎসা পদ্ধতির অংশ। কিন্তু মিশরীয় জাদুবিদ্যা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে আমাদের প্রথমে জানতে হবে যে জাদু বা ম্যাজিক কি সেই বিষয়ে।
এখন পর্যন্ত ম্যাজিক বা জাদুবিদ্যা হিসেবে কোন বিষয়কে গণ্য করা উচিত তা নিয়ে অনেকের অনেক মতবিরোধ আছে, কারণ এক সংস্কৃতির ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান আরেক সংস্কৃতির কাছে বিশ্বাসযোগ্য নাও হতে পারে। কিন্তু সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ম্যাজিক হল-কোন বিদ্যা বা কর্ম যা অতিপ্রাকৃতিক পর্যায়ে পরিবর্তন আনে।
হেকা এবং প্রাচীন মিশরীয় জাদুবিদ্যা
প্রাচীন মিশরীয় জাদুবিদ্যা সাধারণ কোন ভেল্কি বা ভ্রম ছিল না। মিশরীয়দের কাছে জাদু ছিল এমন এক শক্তি যা ছাড়া, তাদের বিশ্বাস ছিল, পৃথিবী অচল। জাদু বা ম্যাজিক ছিল সেই শক্তি, যে শক্তির দ্বারা পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে। অসুস্থ ব্যক্তির সুস্থতা লাভের কারণ, সর্বহারাদের যোগানদাতা এবং মৃত্যুর পর অনন্ত জীবনদাতা শক্তি ছিল ম্যাজিক।
হেকা এর অবকাঠামো - Source: Sea food – seafoodnet
মিশরীয়দের কাছে জাদুবিদ্যা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বুঝাতে ইজিপ্টোলজিস্ট জেমস হেনরি ব্রেস্টেড এর এক বিখ্যাত উক্তি থেকে জানা যায় যে, প্রাচীন মিশরীয়দের জীবন যাত্রায় "ঘুমানো এবং খাদ্য প্রস্তুত" করার মত আবশ্যক ছিল জাদুবিদ্যা। প্রাচীন মিশরীয়দের বিশ্বাস, জন্ম, মৃত্যু, ইহকাল এবং পরকাল- প্রতিটি পদক্ষেপে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান দখল করে ছিল ম্যাজিক বা জাদুবিদ্যা।
আর প্রাচীন মিশরীয়রা জাদুবিদ্যা বর্ণনা করতে যে শব্দটি ব্যবহার করত তা হল "হেকা"। বিশ্বাস করা হত, হেকা হল একটি প্রাকৃতিক শক্তি যা সারা বিশ্ব জগতে উপস্থিত ছিল এবং সৃষ্টিকর্তা হেকাকে ব্যবহার করেছিলেন বিশ্বের সৃষ্টি এবং উদ্দীপনা তৈরির কাজে।
হেকা ছিল একই নামে নামকরণকৃত এক দেবতার ব্যক্তিরূপের প্রকাশক। যেহেতু পৃথিবী সৃষ্টি করতে হেকা সেই শক্তিই ব্যবহার করেছিলেন যে শক্তিকে তিনি ব্যক্তিরূপ প্রদান করেন, সেহেতু হেকাকে ধরে নেয়া হত সকল দ্বৈত সৃষ্টির পূর্বাভাস দাতা। হেকা ছিল সেই শক্তি যা মানব জীবনযাত্রার প্রতিটি ধাপে ভারসাম্য এবং সংগতি বজায় রাখতো। হেকা পৃথিবীকে শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল যা দেব-দেবীদের ক্ষমতায়নের কারণ ছিল। এমনকি, অন্যান্য দেবদেবীরা হেকাকে ভয় পেত। ইজিপ্টোলজিস্ট রিচার্ড এইচ উইল্কিন্সন এর মতে, " তিনি অসীম ক্ষমতাধর এক দেবতা হিসেবে বিবেচিত ছিলেন"। এই ক্ষমতার প্রভাব মিশরীয়দের দৈনন্দিন জীবনে স্পষ্ট ছিল: পৃথিবী তার আপন গতিতে প্রবাহিত হত কারণ হেকার কারণে দেবতারা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে পারত।
বিশ্বাস করা হত যে, জাদুবিদ্যা ছিল এমন কিছু যা মানুষ এবং দেবতাগণ উভয়ই ব্যবহার করতে পারত। মিশরীয়রা মূলত অমঙ্গলের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে জাদুবিদ্যার শরণাপন্ন হত। এছাড়াও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য পূরণেও তারা এই বিদ্যা ব্যবহার করত- তা কোন ব্যক্তিকে প্রেমের জালে আটকানোর কাজেই হোক বা কোন শত্রুর ক্ষতি করার কাজেই হোক। তারপরও, প্রায় সব ধর্মের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানই কোন না কোন ম্যাজিক হিসেবে বিবেচ্য ছিল।
জাদুবিদ্যার এই অনুশীলনকে ধরে নেয়া হত দেবতা এবং প্রাকৃতিক শক্তিকে প্রভাবিত করার প্রতীক হিসেবে। জাদুবিদ্যা অনুশীলনের বেশিরভাগ রীতিনীতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল জাদুমন্ত্রের ব্যবহার। মন্ত্রগুলো দুই ভাগে বিভক্ত ছিল- যেগুলো মুখে উচ্চারিত হত এবং যেগুলো কার্যকলাপে দেখানো হত। মন্ত্রের শব্দ এবং ব্যবহৃত নামগুলো সঠিক ভাবে উচ্চারণ করা জরুরি ছিল।
প্রাচীন মিশরীয় জাদুবিদ্যার ব্যবহার
অনেক অনেক অনেকগুলো ক্ষেত্রে প্রাচীন মিশরীয় জাদু ব্যবহৃত হত। তবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হত সুরক্ষা এবং আরোগ্য লাভের ক্ষেত্রে।
সুরক্ষার ক্ষেত্রে
বেস কবজ - Source: descobriregipto
প্রাচীন মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল, তাদের চারপাশে অনেক অশুভ শক্তি ছড়িয়ে আছে যেগুলো যেকোনো সময় তাদের ক্ষতি সাধন করতে পারে। এই অশুভ শক্তিগুলো আসতো কোন শয়তান, রাগান্বিত দেবতা অথবা কালো জাদু অনুশীলন করা কোন শত্রুর কাছ থেকে। অশুভ এই শক্তিগুলোর হাত থেকে সুরক্ষার জন্য প্রচলিত ছিল জাদুবিদ্যার অনুশীলন এবং তাবিজ কবজ পরিধান, যার ফলে, তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, অশুভ শক্তিরা তাদের কাছে ঘেঁষতে পারতো না। এছাড়াও, শিশুর জন্ম বা কোন ব্যক্তির মৃত্যুর মত সংবেদনশীল মুহূর্তেও সুরক্ষার জন্যে জাদু ব্যবহার করা হত।