জোড়া ভ্রূ'র একটি তরুণী হরিণ তার শরীরে নয়টি তীরে ক্ষত বিক্ষত হয়ে বিধ্বস্ত অবস্থা নিয়ে দাড়িয়ে আছে , তার চার পাশের লালাভ রংয়ের মাটিতে ঝরা পাতার মৃত বৃক্ষ সারি ও অদূরে আশা জাগানিয়া নীল আকাশ । কথা হচ্ছে উনিশ শতকের বিখ্যাত নারী চিত্রশিল্পী ফ্রিদা কাহলোর অনবদ্য সৃষ্টি 'দ্যা ওয়ান্ডার্ড ডিয়ার' নিয়ে । নিজের মানসিক অবস্থা ও শারীরিক অসুস্থতা নিয়েই ফ্রিদার সারা জীবনের চিত্রকলা । এই 'বিস্মিত হরিণী' তার মধ্যে অন্যতম চিত্রকর্ম । মানসিক পরিস্থিতি নির্ভর 'সেলফ পোট্রেট' চিত্রকলায় নিজেকে তুলে আনার অনন্য ক্ষমতার জন্য ফ্রিদা কাহলো মডার্ন আর্টসের শিল্পীদের মধ্যে স্বকীয় অবস্থান নিয়ে আছেন ।
1946 সালে কাহলোর আঁকা আহত হরিণ - source : study
ফ্রিদার জন্ম ১৯০৭ সালের জুলাইয়ে মেক্সিকোর মেক্সিকো সিটির কোইয়ানে, পারিবারিক নাম মাগদালেনা কারমেন ফ্রিদা কাহলো ই কালদেরন । ফ্রিদার পিতা গুইলেরমো কাহলো (১৮৭২-১৯৪১) ছিলেন জার্মান ইহুদী বংশদ্ভুত মেক্সিকান আলোকচিত্রী; তিনি মেক্সিকো শহরের আর্কিটেক্ট সম্পর্কিত আলোকচিত্রের জন্য সুপরিচিত আর মাতা মাতিলদে কালদেরন ই গঞ্জালেজ (১৮৭৪-১৯৩২) ছিলেন ধর্মভীরু রক্ষণশীল । শিশুকাল থেকেই শারীরিক অসুস্থতায় দিনপাত করতে হয় ফ্রিদাকে, ছয় বছর বয়সে পলিও আক্রান্ত হওয়ার ফলে তার ডান পা বাম পা থেকে অপেক্ষাকৃত সরু আকৃতির হয়ে যায় । জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোই কেটেছে হাসপাতালের বিছনায়, ফ্রিদার যতো আলোকচিত্র এখন পাওয়া যায় তার অধিকাংশই ফটোগ্রাফার পিতার ধারণ করা । এক দিকে পিতার ধর্ম বিমুখী দর্শন ও অন্যদিকে মায়ের ধর্মভীরু জীবনবোধ মিলে ফ্রিদার শিশু কাল ছিলো অনেকটাই ডানপিটে স্বভাবের ।
ফ্রিদার পেইন্টিং ও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি দর্শনের প্রতি আগ্রহের জন্ম হয় ১৯২২ সালে স্কুলে পড়ার সময়টায় । মেক্সিকো সিটির ন্যাশনাল প্রিপেরাটরী স্কুলে পড়ার সময়ে সরকারি খরচে চার্চ, স্কুল, লাইব্রেরী ও অন্যান্য সরকারি ভবনে ভাস্কর্য, পেইন্টিং করার কাজ শুরু হয় । সেই সূত্রেই বিখ্যাত ভাস্কর 'দিয়াগো রিভেরা' আসেন ফ্রিদার স্কুলে, ভাস্কর্য করার সময়েই স্কুল পড়ুয়া ফ্রিদার সাথে দিয়াগোর প্রথম দেখা ও এই বছরেই ফ্রিদার সাথে রাজনীতির দেখা অর্থাৎ, ১৯২২ সালে ফ্রিদা কাহলো সমাজতান্ত্রিক সংঘটন 'লস কাচোচাস'এর সদস্য হন । এই সংঘটনের নেতা ছিলেন স্কুলের সহপাঠী 'আলেজান্দ্রো গোমেজ আরিয়াস'। যার সাথে ফ্রিদার ১৯২৫ এর বাস দুর্ঘটনা পর্যন্ত প্রণয়ের সম্পর্ক ছিলো । ১৯২২ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত সময় কেটেছে স্কুলে, রাজনীতিতে ও তার পিতার কাছে আলোকচিত্র শিখার মধ্যদিয়েই ।
The Two Fridas' সাথে ফ্রিদা কাহলো - source : biography
১৯২৫ এর সেপ্টেম্বরে স্কুল থেকে আরিয়াস ও ফ্রিদার বাড়ি ফিরার পথে তাদের বাসের সাথে একটি ট্রেনের দুর্ঘটনা ঘটে । এই দুর্ঘটনায় ফ্রিদা মারাত্মকভাবে আহত হন । তার পা , কোমর ও মেরুদণ্ডের হাড় ইঞ্জোর্ড হয়, ফলশ্রুতিতে ফ্রিদা দাঁড়ানোর ক্ষমতা হারায় । হাসপাতালের বিছানায় কাটতে থাকে তার সময়, এমতাবস্থায় জানতে পারেন মা হওয়ার ক্ষমতাও হারিয়েছেন । ইতোমধ্যে, এই খবর শোনে ফ্রিদা 'লিওনার্দো' নামে এক ইমেজিনারী সন্তানের 'বার্থ সার্টিফিকেট' করিয়ে ছিলেন ! এহেন পরিস্থিতিতে প্রচণ্ড মানসিক অবসাদ গ্রাস করতে থাকে ফ্রিদাকে । প্রচণ্ড শারীরিক ব্যথা ও একাকীত্ব কাটাতেই হাসপাতাল ও পরবর্তীতে বাড়ীতে ফ্রিদার চিত্রকর্মের শুরু । নিজের চিত্রের সাবজেক্ট নিজেই, এই থেকে তার 'সেলফ পোট্রেট' সিরিজের সুত্রপাত, এ নিয়ে ফ্রিদার মতামত ছিলো এমন –
"I paint myself because I am often alone and I am the subject I know best"