পুরো নাম সৈয়দা তাসলিমা হোসেন, তবে ‘নদী’ নামেই লোকে তাঁকে চেনেন বেশি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে পড়েন শেষ বর্ষে। থিয়েটারকর্মী, ভয়েস আর্টিস্ট, অভিনয়শিল্পী—তাঁর অনেক পরিচয়। সম্প্রতি আলোচনায় এসেছেন বিজয় দিবস উপলক্ষে নির্মিত ফ্রেশ টিস্যুর বিজ্ঞাপনচিত্রে অভিনয় করে। ‘টেরনিং-মেরনিং কিছু না। যে দেশরে ভালোবাইসা যুদ্ধে নামে, তাঁরে কেউ হারাইতে পারে না’—নদীর কণ্ঠে এই সংলাপ দাগ কেটেছে অনেকের মনে।
গত বছরও পড়ালেখা, ভয়েস আর্টিস্ট হিসেবে টুকটাক কাজ, বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি আর মঞ্চে অভিনয় করেই কাটছিল জীবন। কিন্তু ২০২১ সালে নদীর গতিপথ কীভাবে বাঁক নিল, সে গল্পই শুনছিলাম তাঁর কাছে।
বাঁকের দেখা
করোনায় ঘরবন্দী হয়েছে প্রায় সবাই। তবে নদীর কথা আলাদা। কারণ, পাকা ছয় মাস তিনি ঘর থেকে বের হননি। তাঁর ভাষায়, ‘সিঁড়ি পর্যন্তও যাইনি।’ বলছিলেন, ‘২০২০ সালের মার্চে ক্যাম্পাস বন্ধ হলো। আমার মা-বাবা থাকেন নারায়ণগঞ্জে। আমি তাঁদের কাছে চলে গেলাম। ছয় মাস পুরোপুরি বাসায় থাকার পর একটা বিদেশি সিরিজের বাংলা ডাবিংয়ে কণ্ঠ দেওয়ার ডাক পড়ল। নিয়মিত নারায়ণগঞ্জ আর ঢাকা আসা-যাওয়া করতে অসুবিধা হচ্ছিল। তাই ঢাকায় এক বান্ধবীর বাসায় এসে উঠলাম।’
ছোটবেলা থেকে রক্ষণশীল পরিবারে বড় হয়েছেন। এটা করা যাবে না, ওখানে যাওয়া মানা—এমন নানা বিধিনিষেধ ছিল। ঢাকায় এসে প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ পেলেন। শাসন করার কেউ নেই, ক্লাসের চাপ নেই। বান্ধবীদের সঙ্গে দল বেঁধে রাতের ঢাকায় তুমুল ঘোরাঘুরি শুরু করলেন। হঠাৎ বানে নদীর বাঁধ ভাঙলে যা হয়!
এ ধরনের অবাধ স্বাধীনতা সাধারণত চরম বিশৃঙ্খলা দিয়ে শেষ হয়, আমার ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। ২০২০ সালের থার্টি ফার্স্ট নাইটে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে ১২টা বেজে গেল। গেট খোলার কেউ নেই। আমার যাওয়ারও কোনো জায়গা নেই। ভোররাত চারটা পর্যন্ত আমি গেটের কাছে বসে থাকলাম। নতুন বছরের সূর্য যখন উঠছে, মনে মনে ঠিক করলাম, এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। - সৈয়দা তাসলিমা হোসেন নদী
সিজিপিএ–৪.০ ছিল। সেটা এসে ঠেকল ৩.৬-এ। তারপর? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী বলছিলেন, ‘এ ধরনের অবাধ স্বাধীনতা সাধারণত চরম বিশৃঙ্খলা দিয়ে শেষ হয়, আমার ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। ২০২০ সালের থার্টি ফার্স্ট নাইটে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে ১২টা বেজে গেল। গেট খোলার কেউ নেই। আমার যাওয়ারও কোনো জায়গা নেই। ভোররাত চারটা পর্যন্ত আমি গেটের কাছে বসে থাকলাম। নতুন বছরের সূর্য যখন উঠছে, মনে মনে ঠিক করলাম, এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না।’
নদী এখন বিজ্ঞাপনের পরিচিত মুখ
অতঃপর ঢেউ
বড় ভাই ঢাকায় চলে আসায় নদী ভাইয়ের বাসায় গিয়ে উঠলেন। অভিভাবক পেয়ে পথ ঠিক রাখা সহজ হলো। এরই মধ্যে ভয়েস আর্টিস্ট হিসেবে দুরন্ত টিভিতে চাকরি পেয়ে গেলেন। শখ করে নাম লেখালেন ‘মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায়। সেরা ৫০-এ স্থান পেয়েই খুশি ছিলেন তিনি। পড়ালেখা, মঞ্চে অভিনয়, চাকরি—ঠিকঠাক চলছিল সব। কিন্তু মে মাসের শুরুতে হঠাৎ পেটে ব্যথা শুরু হলো। আলট্রাসনোগ্রামের পর চিকিৎসক জানালেন, ওভারিয়ান সিস্টের কারণে নদীর একটা ওভারি (ডিম্বাশয়) ফেলে দিতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব। কেননা আরেকটা ওভারিতেও ক্যানসারের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
নদী বলছিলেন, ‘আমার অবস্থা এত ভয়াবহ ছিল যে কেউ অপারেশন করতে রাজি হচ্ছিল না। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরছিলাম। অবশেষে ডা. চৌধুরী শামীমা সুলতানা রাজি হলেন। টানা আট ঘণ্টা আমার অপারেশন হলো। শেষের দিকে আমার পুরোপুরি জ্ঞান ছিল। নিশ্চিত ছিলাম, আমি আর বাঁচব না। জীবনে কত ছোট ছোট কষ্ট পেয়ে মনে মনে ভেবেছি, এ জীবন আর রাখব না। কিন্তু অপারেশনের দুই দিন পর যখন প্রথম বিছানা থেকে নামলাম, ঠান্ডা মেঝেটা পায়ে অনুভব করলাম, ঠিক সেই মুহূর্তেই বুঝলাম, জীবন কতটা মূল্যবান।’
ঢাকা আর্ট সামিটে নদীর পরিবেশনা
নদী মিলবে সাগরে
পেটে ৩০টি সেলাই পড়েছে। সোজা হয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে শরীরে ঘা হয়ে গেছে। এত বেশি উচ্চমাত্রার ওষুধ খেয়েছেন যে একসময় নিজেকে পাগল মনে হতো। অমন অবস্থায়ও হাল ছাড়েননি নদী। ধীরে ধীরে সেরে উঠেছেন। একাধিক টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন। অ্যাকশন দৃশ্যে অভিনয় করেছেন। পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছেন তাঁর স্বামী সৈয়দ এজাজ আহমেদ। গত জুলাইয়ে তাঁদের বিয়ে হয়েছে।
স্বামী সৈয়দ এজাজ আহমেদের সঙ্গে নদী। গত জুলাইয়ে তাঁদের বিয়ে হয়েছে, ছবি: নদীর ফেসবুক থেকে সংগৃহীত
নদী বলছিলেন, ‘বিয়ের পর আমি জীবনে প্রথম কক্সবাজার গিয়েছি। প্রথম প্লেনে চড়েছি। প্রথম কোনো রিসোর্টে থেকেছি। ছোট বাচ্চারা মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে গেলে যেভাবে আনন্দ করে, আমার মনে হচ্ছে, বিয়ের পর আমার সেই শূন্যস্থান পূরণ হচ্ছে।’
ক্যানসারের আশঙ্কা এখনো পুরোপুরি দূর হয়ে যায়নি। সব সময় সাবধানে থাকতে হয়। কিন্তু নদী প্রাণ খুলে হেসে বলেন, ‘আমার কোনো আক্ষেপ নেই।’ বিজ্ঞাপন আর সিনেমায় ব্যস্ত সময় কাটছে তাঁর। জানালেন, নুহাশ হুমায়ূনের পরিচালনায় একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে কক্সবাজার ঘুরে তিনি বান্দরবান যাচ্ছেন। বলছিলেন, ‘সবকিছু ঠিক থাকলে এ বছর থার্টি ফার্স্টে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে বসে আমি নতুন বছরের সূর্যোদয় দেখব।’
[FA]pen[/FA] লেখক: মো. সাইফুল্লাহ