What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected অপেক্ষা (1 Viewer)

dukhopakhi

Global Moderator
Staff member
Global Mod
Joined
Mar 3, 2018
Threads
98
Messages
10,982
Credits
103,780
LittleRed Car
LittleRed Car
Camera photo
T-Shirt
Thermometer
Glasses sunglasses
অপেক্ষা

মূল লেখক : আফতাব হোসেন।


টুপ করে এক ফোঁটা পানি পড়ে কুলসুমের চোখের উপর। চোখ খুলে দেখে, ওর ছাপড়া ঘরে টিনের চালে, এখানে সেখানে ফুটো। সেই ফুটো দিয়ে টুপটাপ পড়ছে পানি। এমন আরো অনেক জায়গা দিয়েই পড়ছে। পাশে দুই বছরের ছেলে রশিদ, কেঁদে কেঁদে একটু আগে ঘুমিয়ে পড়েছে। রশিদের ঘুমন্ত শরীরটাকে বুকে টেনে নিয়ে আর একটু সরে শোয় কুলসুম। আর কত সরবে? বাইরে তিনদিন ধরে এক নাগাড়ে পড়ছে বৃষ্টি। আষাঢ় মাস। সেই যে শুরু হয়েছে থামার নাম নেই। কেমন শীত শীত করে কুলসুমের। বুঝি জ্বর আসছে আবার। ঠান্ডা, মোটা কাঁথাটা টেনে গায়ে দেয় কুলসুম।

ছোট্ট এক কামরার ছাপড়া ঘর কুলসুমের। কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে। ঘরে ছোট একটা খাট, খাটের পাশেই চাটাইয়ের বেড়া, বেড়ায় দড়িতে ঝুলানো কিছু ময়লা কাপড়, স্যাঁতস্যাঁতে, ভেজা। আরেক পাশে মাটির চুলা, আগুন ধরেনি কাল থেকে। খাটের নিচে কিছু হাঁড়ি পাতিল, থালা বাসন, চাল ডালের কৌটা, সব খালি। এই একের ভেতরে সব ঘরে, চার বছর ধরে আছে কুলসুম।

হঠাৎ কোথাও বাজ পড়ে। ঠা ঠা শব্দে। ঝনঝন করে কেঁপে ওঠে নড়বড়ে টিনের চাল। ভয় পেয়ে ঘুমের ভেতর আঁকড়ে ধরে রশিদ ওকে। ঘুমের ভেতরই বুকের ভেতর খাবার খোঁজে। সকাল থেকে দানাপানি পড়েনি পেটে ছেলেটার। পড়েনি কুলসুমেরও। পরশু ময়মুনা দু কৌটা চাল দিয়েছিল। কাল রাতে পান্তাটুকুও শেষ হয়েছে। যদিও বেশ ভরাট বুক কুলসুমের। দু'বছর পরও সেখানে সন্তানের জন্য খাবার থাকার কথা নয়। তবুও ঘুমের মধ্যে চোঁচোঁ করে শুকনো বোঁটা চুষে চলে রশিদ। ব্যাথায় বুকের ভেতর টনটন করে ওঠে কুলসুমের। ছেলেটাকে জোর করে ছাড়িয়ে দিয়ে চিৎ হয়ে শোয়।

তেল চিটচিটে বালিশের তলা থেকে হাত বাড়িয়ে ছোট্ট একটা ফোন বের করে কুলসুম। বোতাম টিপে চোখের সামনে ধরে। না, আলো জ্বলছে। তবুও গত সাত দিনে একবারও বেজে ওঠেনি ফোনটা। ময়মুনাকে ফোন দিয়েছিল। বন্ধ কাল। বোধহয় কাজে গেছে। কাজে গেলে ফোন বন্ধ থাকে। আজ তো ফেরার কথা। নাকি আজও কাজ আছে? বেশ চালাক মেয়ে ময়মুনা। তাই ওর কাজের অভাব হয় না। একবার ভাবে, ফোন করি। আবার ভাবে, থাক, আর একটু দেখি। কাজ থেকে ফিরলে নিজেই আসবে। এই বিশাল রোহিঙ্গা শিবিরে ওই তো কুলসুমের একমাত্র ব্যথার সাথী। ওর কষ্ট বোঝে। বিপদে আপদে পাশে দাঁড়ায়। কাজ জোগাড় করে দেয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোনটাকে আবার বালিশের নিচে রেখে দেয় কুলসুম। আর অপেক্ষায় থাকে, কখন ফোনটা বেজে উঠবে।

বৃষ্টি ঝরে চলেছে অঝোর ধারায়, টিনের চালে, খৈ ফোটা শব্দ করে। আশে পাশে অনেকগুলো কোলা ব্যাঙ ডেকে চলে এক নাগাড়ে। ব্যাঙের ডাক শুনতে শুনতে কুলসুম হারিয়ে যায় ছেলেবেলায়। আরাকান রাজ্যে তুলাতুলি গ্রামে ওদের দোতলা টিনের ঘর ছিল। বাবা ছিল প্রাইমারি স্কুলের মাষ্টার। জমিজমাও মন্দ ছিলনা। বাবা মার একমাত্র সন্তান কুলসুম। ওর জন্মের সময়, মা'র কী যে এক অসুখ হল, পেট কেটে বের করতে হয়েছিল ওকে। সেই থেকে মা'র আর কোনো ছেলেপুলে হল না। দাদি কত গুনগুন করত, আর একটা বিয়ে কর, ঘর ভর্তি ছেলেপুলে হোক। ওর বাবা হেসে বলত, মা, অনেকগুলো ছেলেমেয়ে মানুষ করতে কষ্ট। আমার কুলসুম একাই একশ। ওকেই আমি মনের মত করে মানুষ করব।

যেদিন এমন খৈ ফোটা বৃষ্টি নামত, সেদিন দাদি খৈ ভাজত। খৈ নিয়ে দাদি নাতনি দোতলায় উঠে, জানলা খুলে দিয়ে, বৃষ্টি দেখত আর খৈ খেত। খৈ খেতে খেতে দাদি ওকে কত গল্প শোনাত। কেমন করে ডালিম কুমার পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে এসে, রাক্ষসের হাত থেকে রাজকন্যাকে উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর কেমন করে ডালিম কুমার আর রাজকুমারীর ধুমধামে বিয়ে হল। গল্প শুনতে শুনতে কতদিন কুলসুম দাদির কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গিয়েছে। আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ডালিম কুমারকে স্বপ্ন দেখেছে।

বছর পাঁচেক আগের কথা। এক সকালে কুলসুম বাড়ির বাইরে, টাট্টি করতে গেছে। হঠাৎ কী হল, চিৎকার চেচামেচি। গুলির শব্দ। কাঁচা টাট্টির টিনের দরজার ফুটো দিয়ে কুলসুম দেখে, একদল মানুষ। সাথে পুলিশ নাকি মিলিটারি? কাঁধে বন্দুক। ওর বাবাকে ঘর থেকে টেনে এনে বাড়ির উঠোনেই গুলি করে মারল। কুলসুম চিৎকার দিতেও ভুলে গেল। আরেক দল ওর মাকে টেনে এনে উঠোনের পরেই ছিড়েখুড়ে খেল, যেভাবে এক তাল মাংসকে ছিড়েখুড়ে খায় হিংস্র কুকুরের দল। তার পর তাকেও গুলি করে মারল। কুলসুম দাদিকে কোথাও দেখতে পেল না। ঘরের দরজা বন্ধ করে পিশাচগুলো কী যেন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিল। দেখতে দেখতে সেই আগুনের লেলিহান শিখা যখন আকাশ ছুঁলো। বন্ধ ঘরে দাদির চিৎকারে তখন আকাশ ফেটে ফেটে চৌচিড় হয়ে গেল। সেই চিৎকারে অজ্ঞান হয়ে কুলসুম টাট্টির মধ্যেই পড়ে রইল।

যখন জ্ঞান ফিরল, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। তারপর কিভাবে রাতের আঁধারে গাঁয়ের একদল মানুষের সাথে নদী পার হয়ে বাংলাদেশে এলো, সে অন্য ইতিহাস। কুলসুম সে সব আর মনে করতে চায় না। এসে ঠাঁই হল এই কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে। ওদের গ্রামেরই আর একটি পরিবারের সাথে।

সেই পরিবারের কর্তা ফজুল্লাহ। ও ডাকত ফজুচাচা। তার পাঁচ সন্তানের সাথে দিন কেটে যাচ্ছিল কুলসুমের কোনমতে। ফজুল্লাহ ছিল নেতা কিসিমের লোক। তাই রিলিফ রেশনের মাল ভালই পেত। খাওয়ায় কষ্ট ছিল না তেমন। দেখতে দেখতে কুলসুমের শরীরে, এখানে সেখানে, নতুন পাতা, কুঁড়ি, শেকড় গজাতে থাকে। কুলসুম নিজের পরিবর্তনে নিজেই আবাক হয়ে যায়। হঠাৎ খেয়াল করে, ফজু চাচা আগের চাইতে একটু বেশীই আদর করে। চুলের ফিতা, চুড়ি, এটা সেটা কিনে দেয়। কুলসুম যেন ফজুচাচার মাঝে তার বাবাকে খুঁজে পায়।

রোহিঙ্গা শিবিরে একটা পরিবারের জন্য একটাই ঘর বরাদ্ধ। সে যত বড় পরিবারই হোক। একটাই খাট, একটাই মেঝে। সেই খাটে ফজুচাচা, চাচী, দুই সন্তানসহ ঘুমায়। মেঝেতে বাকি তিন মেয়ের সাথে কুলসুম। এক গরমের রাতে, কুলসুমের ঘুম আসে না। বাবাকে খুব মনে পড়ছিল। হঠাৎ দেখে ফজুচাচা উঠে বাইরে গেল। বুঝি টাট্টি করতে। ফিরে আসল চোরের মত। আস্তে করে দরজা বন্ধ করল। অন্ধকার চোখ সহা হয়ে গেলে অনেক কিছুই দেখা যায়। কুলসুম খেয়াল করে ফজুচাচা সবার মুখের কাছে মুখ নিয়ে কি যেন দেখে। কুলসুমের মুখের কাছে আসতেই চোখাচোখি হয়ে যায়। ঠোটে আঙ্গুল ঠেকিয়ে চুপ থাকতে বলে। ফজুচাচার চোখদুটো রাতের শিয়ালের চোখের মত জ্বলছে। কুলসুম সেই চোখ দেখে ভয় পেয়ে যায়। ফজুচাচা ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে হিসহিস করে বলে,
- খবরদার, কথা ক'বি না। মাইরা ফালামু।

কুলসুম ভয়ে আরও কুঁকড়ে যায়। এরপর যা হল, তা কুলসুম স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি কোনদিন। ফজুচাচা এক হাতে কুলসুমের মুখ চাপা দিয়ে ছাগল যেমন কচি লাউয়ের ডগাকে পরমানন্দে চিবিয়ে চিবিয়ে খায়, কুলসুমের তের বছরের শরীরটাকে সেভাবেই রসিয়ে রসিয়ে খেল। কষ্টে, যন্ত্রনায়, ঘৃনায় কুলসুমের দুচোখ দিয়ে শুধু পনি গড়িয়ে পড়ল। মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের করতে পারল না।

সেই থেকে শুরু। প্রায় রাতেই কুলসুমের উপর নরক নেমে আসত। ভয়ে কুলসুম কাউকে কিছু বলতে পারত না। একদিন কী হল, চাচা চাচীর মধ্যে তুমুল ঝগড়া। পাড়া প্রতিবেশীরাও জড়ো হল। ঘরের ভেতর সালিশ বসল। কুলসুমকে ঘরের বাইরেই রাখা হল। সেই রাতেই কুলসুমকে পঞ্চাশ বছরের নাসিরদ্দীর সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়া হল। কেউ কুলসুমের কাছে কিছু শুনল না। কেউ তার মত নেয়ার কোনো প্রয়োজন মনে করল না।

কুলসুম যেন নতুন জেগে ওঠা একখণ্ড পলিমাটির চর। এতদিন ফজুল্লার দখলে ছিল, এখন নাসিরদ্দীর জিম্মায়। সে চরের পেলব জমিনে নাসিরদ্দী যখন খুশি লাঙ্গল চালায়। নাসিরদ্দী ছিল লম্পট বদমাশ কিসিমের লোক। প্রতি রাতে তাড়ি গিলে আসত। ঘন ঘন বিড়ি খেত। মাতাল নাসিরদ্দীর মুখে বিড়ি আর তাড়ির ভকভকে গন্ধে বমি আসত কুলসুমের। কালবোশেখি ঝড় হঠাৎ থামার মত, নাসিরদ্দী যখন ওর শরীরের উপর নেতিয়ে পড়ত, কুলসুমের শরীরে তখন কেবল শরতের মেঘ জমতে শুরু করত। সে মেঘের আর বৃষ্টি হয়ে ঝরা হত না। অতৃপ্ত শরীর নিয়ে বোবা চোখে ছাপড়ার চালের দিকে চেয়ে থাকত কুলসুম। সে চালের ফুটো দিয়ে বিশাল আকাশের দু এক ফোঁটা দেখা যেত। কখনো সখনো দু একটা তারা। শুনেছে, মরে গেলে মানুষ নাকি আকাশের তারা হয়ে যায়। কুলসুম ভাবে, দাদি কি ওই তারাদেরই একজন? আকুল হয়ে সেই তারার কাছে জানতে চাইত কুলসুম,
- দাদি, কোথায় তোমার ডালিম কুমার? কবে এই খোকলা রাক্ষসের হাত থেকে সে আমায় ঊদ্ধার করবে?

ডালিম কুমার না এলেও বছর ঘুরতে না ঘুরতে কোল জুড়ে এলো রশিদ। নাসিরদ্দীও একটু ভাল হল রশিদকে দেখে। তাড়ি খাওয়া কমিয়ে দিল। কুলসুম এই বাপের বয়সী লোকটার মাঝে কেবল ডালিম কুমারকে খোঁজা শুরু করেছে, একদিন নাসিরদ্দী হারিয়ে গেল। আর ফিরে এলো না। কোথায় গেছে কেউ জানে না।

কুলসুম আবার মালিকানাহীন পতিত জমির মত হয়ে যায়। যার সবুজ ঘাসে, যে যেখানে পায়, সুযোগ পেলেই একটু গরু ছাগল চড়িয়ে নিতে চায়। ফজুল্লার বাড়িতে ফিরতে চেয়েছিল কুলসুম, চাচি দুরদুর করে তাড়িয়ে দিল। রিলিফের চাল আনতে গেলেও লোকগুলো বিনিময় চায়। এখানে সেখানে হাত দেয়। মরে যেতে ইচ্ছে করে কুলসুমের। রশিদের মুখের দিকে তাকিয়ে তাও পারে না।

এভাবেই কুলসুম যখন চোখে অন্ধকার দেখছে, তখনই ময়মুনার সাথে পরিচয়। একই পল্লীতে থাকে। বাবা মা ভাই বোনের সাথে। ওর চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়। ভাল কাপড় চোপড় পড়ে। টাকা পয়সার তেমন অভাব আছে বলে মনে হয় না। প্রথম দেখাতেই ময়মুনাকে কুলসুমের ভাল লেগে যায়। একদিন কুলসুম তার সব কাহিনী খুলে বলে ময়মুনাকে। ময়মুনার সাহায্য চায়। বলে,
- বইন, আমারে একটা কাম জোগাড় কইরা দিতে পারবা?
- বার্মাইয়াগো এই দেশে কাম করার আইন নাই।
- তুমি কোনো কাম করো না?
- আমি যেই কাম করি, তুমি হেই কাম পারবা না।
- ক্যান পারুম না? তুমি পারলে আমিও পারমু, পোলাডা লইয়া বাঁচতে তো হইবো।
- তয় হোনো।

ময়মুনা খুলে বলে সে কি কাজ করে। শুনে শিউড়ে ওঠে কুলসুম। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে,
- পাপ হইবো না?
- পাপ? কোনটা পাপ না কুলসুম? এই যে তোমার বাপরে মাইরা ফালাইলো, তোমার মায়ের ইজ্জত নিল, তোমার দাদীরে জ্যান্ত জ্বালাইয়া মারল, এইটা পাপ না? এই যে আমাগো দ্যাশ থাইকা তাড়াইয়া দিল, এইটা পাপ না? এইযে তোমার বাপের মত ফজুচাচা, তোমারে নষ্ট করল, এইটা পাপ না? তোমার মত না নিয়া একটা বুইড়ার লগে বিয়া দিল, হেই বুইড়া তোমারে একদিনও সুখ দিতে পারল না, এইটা পাপ না? রিলিফের চাউল আনতে গেলে যে অজায়গায় কুজায়গায় হাত দেয়, সেইটা পাপ না? এই যে বাংলাদেশের পুলিশ টাকা খাইয়া আমাগো কামে যাইতে দেয়, আর যে ব্যাটারা বৌ মাইয়া থাকতেও আমাগো কাছে আসে, এইটা পাপ না? খালি বাঁচার লাইগা আমরা করলেই পাপ?

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে হাপায় ময়মুনা। অবাক হয়ে কথাগুলো শুনছিল কুলসুম। তাই তো, এত পাপ চারিদিকে, এর মাঝে ও নিস্পাপ থাকবে কেমন করে? রাজি হয়ে যায়। ঠিক হয় কাজ এলে রশিদকে ময়মুনাদের ঘরে রেখে কাজে যাবে।

ময়মুনাই ওকে একটা ফোন, কিছু ভাল কাপড়, একটা বোরখা এনে দেয়। মনে পড়ে, প্রথম কাজের কথা। কুলসুমের কলজে শুকিয়ে কাঠ। ওকে বোরখা পড়িয়ে ঘন্টা দুই গাড়িতে ঘুরিয়ে একটা সুন্দর বাড়িতে নেয়া হয়। রাতের অন্ধকারে কোথায় বুঝতে পারে না। এক মহিলা ওকে সুন্দর সাজানো গোছানো একটা রুমে নিয়ে যায়। কী এক গন্ধে মৌ মৌ চারিদিক। কুলসুমের মনে হয়, ও যেন কোনো এক রাজ প্রাসাদে এসেছে। যেখানে সে যেন দাদির গল্পের সেই রাজকন্যা। মহিলা তাকে রুমের লাগোয়া আরেকটা রুমে নিয়ে যায়। ধবধবে সাদা পাথরে মোড়া। মহিলা তাকে বলে,
- এটা বাথরুম। মানে গোসলখানা। তুমি সাবান দিয়ে ভাল করে গোসল করে ঐ কাপড় গুলো পড়ে নাও।
বলে ওকে কি ভাবে পানি ছাড়তে হয় দেখিয়ে দিল। যাবার আগে সব কাপড় খুলে গোসল করতে বলে গেল। শুনে কুলসুমের কান গরম হয়ে যায়। সব কাপড় খুলে?

মহিলা চলে গেলে কষে দরজা বন্ধ করে কুলসুম। ভাবে, এত সুন্দরও গোসলখানা হয়? এখানে তো মাটিতে রেখেই ভাত খাওয়া যায়। চোখ বন্ধ করে নিজেকে অনাবৃত করে কুলসুম। পাছে নিজেই নিজেকে দেখে ফেলে! পানির কল খুলতেই বৃষ্টির মত পানি পড়ে ছাদ হতে। চোখ বন্ধ করেই ভিজতে থাকে কুলসুম। হঠাৎ শৈশবে উঠোনে বৃষ্টিতে ভেজার কথা মনে পড়ে যায়। ও ভুলে যায়, ও এসেছে আজ নিলাম হতে। ওর ইজ্জত আজ বিক্রি হবে আজ পানির দামে। মনে হতেই ওর দুচোখ ভরে ওঠে জলে। সে জল মিলেমিশে একাকার হয় ঝর্নার জলে। ও ভিজতেই থাকে। কেবলই মনে হয়, অনেক কাদা জমেছে ওর দেহে, অনেক কাদা মনে। আজ ধুয়ে মুছে সব সাফ হয়ে যাক। ও সুগন্ধি সাবান দিয়ে রগড়ে রগড়ে নিজেকে পরিস্কার করে। ওর শরীর ও মন ঠান্ডা হলে তবেই চোখ খোলে। এতক্ষণ খেয়াল করেনি। বাথরুমের একটা দেয়াল পুরা আয়না দিয়ে বাঁধানো। সেই আয়নায় জীবনে এই প্রথম নিজেকে পূর্নাঙ্গ রূপে দেখে কুলসুম। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারেনা। সোনার বরণ শরীরে মুক্তো দানার মত জমে আছে পানির ফোঁটা এখানে সেখানে, শরীরের খাঁজে, পাহাড়ে, উপত্যকায়। নিজেকে দেখে যেন সাধ মেটে না। মুক্তো দানাগুলো টাওয়েল দিয়ে মুছতেও ইচ্ছে করে না। ভাবে, কত পাব আজ এই মুক্তো দানার দাম?

এমন সময় বাথরুমের দরজায় নক হয়। সম্বিত ফিরে পেয়ে তাড়াতাড়ি গা মুছে ওর জন্য আনা কাপড়গুলো পড়ে। এমন কাপড় পড়া তো দুরের কথা, দেখেনি জীবনে। কোথায় দেখবে কুলসুম শার্টিনের স্লিপিং গাউন? লাল স্লিপিং স্যুটে ওকে পরীর মত দেখায়। মনে মনে ভাবে, এক রাতের জন্য এত আয়োজন? তবে যে ময়মুনা বলেছিল কত ভয় ধরাণো সব কথা? কেন জানেনা, কুলসুমের কোনো ভয় করে না। এইটুকু জীবনে এই শরীর কম তো সইলো না। ফজুচাচা কিংবা নাসিরদ্দীর চাইতে বড় হায়না নিশ্চই হবে না।

আবার হালকা নক হয় দরজায়। তাড়াতাড়ি বুকের সিন্দুকে তালা দিয়ে নিজের ঐশ্বর্য্য লুকিয়ে ফেলে। দুরু দুরু বুকে, ভয়ে ভয়ে বেরিয়ে আসে। বাইরে কোন তস্কর বসে আছে, কে জানে। মাথাটা মুছতেও ভুলে যায়। তখনো ভেজা চুল থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে জল। ঘরে ঢুকে চেয়ারে যাকে বসা দেখল, তেমন কাউকে দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলনা মোটেই কুলসুম। এ যেন পুজার মন্ডপে দেখা সাক্ষাত কার্তিক বসে আছেন। এতদিন বার্মিজ পুরষগুলোর কুঁতকুঁতে চোখ, বোঁচা নাক, উঁচু চোয়াল আর শুয়োরের মত গোত্তা শরীর দেখে মনে হত, পৃথিবীর তাবৎ পুরুষগুলো এমনই কুৎসিত। শুধু স্বর্গের দেবতারাই বুঝি পুজার মন্ডপের মূর্তির মত সুন্দর হয়। নোংরামী আর পঙ্কিলতায় ভরা এই পৃথিবীতেও মানুষ যে এত সুন্দর হতে পরে, ধারণা ছিলনা কুলসুমের। যেন দুধে আলতা মেশানো গায়ের রঙ। একটু ছুঁয়ে দিলেই রক্ত বেরিয়ে যাবে। বছর পঁচিশের বেশী হবে না বয়স। ময়মুনা বলেছিল, মধ্য বয়সী বিয়ে করা মানুষরাই এসব চায়। থাকে তাদের নানা রকম বিকৃত চাহিদা। হয় লম্পট প্রকৃতির। যে বসে আছে সামনে ওর, আর যাই হোক, লম্পট মনে হয় না তাকে কুলসুমের। তাদের চোখ দেখলেই চেনা যায়। সামনে বসা লোকটার চোখে কোনো লাম্পট্য নেই, আছে রাজ্যের বিষ্ময়। তখনই মনে হয়, এ আর কেউ নয়, যে সামনে বসে আছে ওর, সে দাদীর বলা গল্পের ডালিম কুমার। স্থান কাল পাত্র ভুলে অনিমেষে তাকে দেখতে থাকে কুলসুম।

- এসো, খাটে বসো। তোমার কোনো ভয় নেই।
যেন দূর দেবলোক থেকে কথা বলল কেউ। কোনো পুরুষ মানুষের গলা এত মোলায়েম হয়? ও গুটিগুটি পায়ে খাটের কিনারে বসে। ভেজা চুল যে ওর বুক পিঠের অনেকটাই ভিজিয়ে ফেলেছে, কুলসুম খেয়াল করে না। লোকটি উঠে গিয়ে আলনা থেকে একটা শুকনো টাওয়েল এনে বলে,
- ভেজা চুলগুলো মুছে ফেলো। ঠান্ডা লেগে যাবে। আর আমাকে ভয় পেও না। আমি কোনো জোর করব না।
বাবার পর এই প্রথম কোনো পুরুষ এমন মমতা ঢেলে কথা বলল কুলসুমের সাথে। কেন জানি খুব কান্না পায় কুলসুমের। ও মাথা মোছার বাহানায় অনেকক্ষণ টাওয়েলটা ধরে রাখে চোখের উপর। যেন ওর চোখের পানি দেখতে না পায় ডালিম কুমার।

কুলসুমকে খাটে বসতে বললেও ডালিম কুমার গিয়ে বসসে সেই চেয়ারে। ওর পাশে বসে না, ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করে না। যেন সিংহাসনে আসীন হয়ে ওর স্বপ্নের রাজকুমার বলে,
- কি নাম তোমার? মানে কি নামে ডাকব?
- কুলসুম।
অস্ফুটে জবাব দেয় কুলসুম। যদিও ময়মুনা বারবার বলে দিয়েছে, খবরদার, আসল নাম ক'বি না। তোর নাম চামেলি। যে ডালিম কুমারকে এতদিন শুধু স্বপ্নেই দেখেছে, তাকে সামনে দেখে কোন প্রানে মিথ্যা বলবে কুলসুম? হোক না সে এক রাতের ডালিম কুমার।

এরপর অনেক রাত অব্দি ডালিম কুমার এটা সেটা জানতে চায়। ওর জীবনের খুঁটিনাটি। কত কী। কোন কৃত্রিমতা নেই। প্রশ্নগুলো খুব আন্তরিক মনে হয়। এ যেন রাজা একটা রাজ্য জয় করার আগে প্রজার মন জয় করার চেষ্টা করছেন। কুলসুম ছোট ছোট কথায় জবাব দেয় সব প্রশ্নের। শুধু দাদির কাছে শোনা ডালিম কুমারের গল্প বাদে। এক সময় সেই ডালিম কুমার জানতে চায়,
- শুধু আমিই প্রশ্ন করছি। তুমি তো কোনো প্রশ্ন করলে না। কিছু জানতে ইচ্ছে করছে না আমার ব্যাপারে?

কেন করবে না? কুলসুমের খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছ করে, ওগো আমার স্বপ্নের রাজকুমার, তোমার মহলে রাণীর তো অভাব হবার কথা নয়। তবু কেন এসেছ এই দাসীর কাছে? শিয়ালে কুকুরে খুবলে খাওয়া এই শরীর কোন সুখ দিতে পারবে তোমাকে, যা তোমার রানীরা দিতে পারবে না? তবে কেন এলে এই পাপের পথে? কেন এলে নিজেকে নষ্ট করে দিতে? এসব কথা যে কুলসুম শুধু ভাবতেই পারে, মুখে আনতে পারে না। আর ও তো অত সুন্দর করে কথাও বলতে পারে না। মাটির দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ বসে থাকে কুলসুম।

চেয়ারটা এবার টেনে কাছে নিয়ে আসে ডালিম কুমার। এইটুকু কাছে আসাতেই কুলসুমের বুকের ভেতর যেন ভূমিকম্প শুরু হয়ে যায়। বাশ পাতার মত থিরথির কাঁপতে থাকে কুলসুমের শরীর। ভয় হয়, কাঁপতে কাঁপতে পড়ে না যায়।
- তুমি কি এখনো ভয় পাচ্ছ কুলসুম?
খুব নরম গলায় জানতে চায় ওর ডালিম কুমার। গলা শুকিয়ে গেছে কুলসুমের। ও জানে গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হবে না। তাই এদিক ওদিক মাথা নাড়ে।
- তবে কাঁপছ কেন?
কি জবাব দেবে এর? ও কী নিজেই জানে, বুকের ভেতর বইছে এ কোন কালবোশেখী ঝড়? কোন ঝড়ে উড়ে যাচ্ছে ওর বুকের বাড়ি ঘর? কোন জবাব দেয় না কুলসুম।
- তুমি কি জানো, কত সুন্দর তুমি?
এ কি হচ্ছে আজ? ও যে দেখতে সুন্দর, কত জনের কাছে, কত ভাবে, কতবার শুনেছে কুলসুম। একই কথা এই মানুষটার মুখে এত মধুর লাগল কেন? ওর সুন্দর শরীরের প্রতি পুরুষ মানুষের লালা ঝরা দৃষ্টিই দেখছে শুধু। এমন মুগ্ধ হয়ে দেখেনি কেউ। ওর মনে হয়, কানদুটা বুঝি পুড়ে যাচ্ছে তাপে। সে তাপ কান থেকে গলা বেয়ে নেমে যাচ্ছে বুকে। নেমে যাচ্ছে আরো নীচে। এবার সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে যায় কুলসুম। মানুষটা কি আগুনের তৈরী? যখন ছুঁয়ে দেবে, পুড়ে ভষ্ম হয়ে যাবে না তো?

তবু জীবনে এই প্রথম বারের মত, কুলসুমের প্রতিটি লোমকুপ উদগ্রীব হয় পূর্ন সমর্পনের জন্য। তৈরি হয় পুড়ে ভষ্ম হবার জন্য। মনে হয় শুধু এই একটি রাতের জন্যই জন্ম কুলসুমের। এই এক রাতের জন্যই বেঁচে থাকা যায় হাজার বছর।

অবশেষে যখন সময় হল, বিজলি চমকে গেল শরীরের প্রতিটি কনায়, জ্বলন্ত লাভা ছুটে গেল শিরায় শিরায়, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতে পুড়ে ভষ্ম হল ওর সোনার শরীর। তখন, জীবনে প্রথম বারের মত, শরীরের সব জমা হওয়া মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরল অঝোর ধারায়। বৃষ্টি শেষে নীল আকাশে যেমন ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘ, কুলসুমের মনের আকাশেও তেমনই ভাসে সাদা মেঘের ভেলা। সে মেঘের ভেলায় ভাসতে ভাসতে কুলসুম পৌঁছে গেল ঘুমের রাজ্যে। সে রাজ্যে ডালিম কুমার তাকে পঙ্খীরাজে বসিয়ে উড়ে চলে দেশ হতে দেশান্তরে।

ঘুম ভেঙ্গে কুলসুম দেখে কেউ নেই। কিছু নেই। রুমে সে একা। খাঁটের পাশে টেবিলে চাপা দেওয়া পাঁচ হাজার টাকা। তখনি কুলসুমের মনে হয়, এই পৃথিবীর কোনো কিছু সত্য নয়। কালকের রাত, সেই রাতের ডালিম কুমার এক দুঃস্বপ্ন মাত্র! সত্য শুধু টেবিলে রাখা পাঁচ হাজার টাকা আর ওর পোড়া শরীর।

তারপর দু'বছর চলে গেছে। এই দু'বছরে কত জায়গা থেকে কাজের কত ডাক এসেছে। হোটেলের কামরা থেকে বস্তি পর্যন্ত কত জায়গায় গিয়েছে। কত মানুষ শকুন হয়ে সামান্য টাকার বিনিময়ে নিষ্ঠুর ঠোঁকরে ছিন্নভিন্ন করেছে ওর সোনার শরীর। তবে সেই বাড়ি থেকে আর ডাক আসেনি। পরে ময়মুনা বলেছে, ওখান থেকে শুধু জীবনে প্রথম কাজের ডাকই আসে।

কেন জানি শরীর ভাঙ্গছে কুলসুমের। জ্বর আসে থেকে থেকে। কাজের চাহিদা কমে গেছে। অপেক্ষায় থাকে কুলসুম। যদি কাজের ডাক আসে, যদি কোনদিন দেখা হয়ে যায়, এক রাতের সেই ডালিম কুমারের সাথে। জানে কোনদিন দেখা হবে না, তবু অন্তহীন এ অপেক্ষা কুলসুমের।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top