What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

ওয়াহ্হাবী আন্দোলন : উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ এবং মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব (1 Viewer)

arn43

Co-Admin
Staff member
Co-Admin
Joined
Mar 2, 2018
Threads
1,641
Messages
124,404
Credits
291,592
Coca Cola Can
SanDisk Sansa
DVD
Whiskey
SanDisk Sansa
SanDisk Sansa
ওয়াহ্হাবী আন্দোলন : উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ এবং মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব

মধ্য আরবের প্রাচীন উচ্চভূমি অঞ্চল ‘নাজদ’। অষ্টাদশ শতকে এভূখন্ডে ঘটে যায় এক অসাধারণ ইসলামী বিপ্লব। ইসলাম আগমনের পূর্বে অজ্ঞতার তিমির প্রহেলিকা আরব জাতিকে যেমন আচ্ছাদিত করে রেখেছিল, ঠিক তেমনি আববাসীয় শাসনামলের পতনের পর থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী অবধি পুনরায় খোদ ‘অহি-র অবতরণ স্থল’ আরবের বুকে ধীরে ধীরে জমাট বেঁধেছিল জাহেলিয়াতের গাঢ় তমিস্রা। শিরক-বিদ‘আতের ভয়াবহ আগ্রাসনে অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েছিল ইসলামের ব্যক্তি, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতির আদি কাঠামো। এমনই এক ক্রান্তিলগ্নে বলা যায় ইসলামের পুনর্জন্মবার্তা নিয়েই ‘ওয়াহ্হাবী আন্দোলন’ তথা ইসলামের বিশুদ্ধ রূপের দিকে প্রত্যাবর্তনবাদী ও সংস্কার-অনুবর্তী এই আন্দোলনের জন্ম হয়। বৈশিষ্ট্যগত কারণে এ আন্দোলনকে সালাফী আন্দোলন বা মুওয়াহ্হিদীন আন্দোলন বলে আখ্যা দেয়া হয়। এ আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন সালমান বিন আলী আত-তায়মী (১৭০৩-১৭৬১ খৃঃ) রাহিমাহুল্লাহ। অহী নাযিলের পবিত্র ভূমি আরবের বুকে এই মহান যুগসংস্কারক কেবল রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের পুনরুজ্জীবনই ঘটাননি; বরং নাজদ থেকে এমন এক ইসলামী সমাজের উত্থান ঘটান যা খুলাফায়ে রাশেদীনের পর অহি-র প্রাণকেন্দ্রে পুনরায় তাওহীদ ও সুন্নাতের উপর ভিত্তিশীল একটি বৃহত্তর আরব রাষ্ট্র গঠনে সক্ষম হয়েছিল। যার বিকীর্ণ আলোকচ্ছটা আরব মরুর দিকচক্রবাল পেরিয়ে পরবর্তীতে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এ আন্দোলন ছিল মুসলিম বিশ্বে শিরক, বিদ‘আত অর্থাৎ ইসলামী শরী‘আতের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট নবসৃষ্ট বিধি-বিধান, বিজাতীয় সংস্পর্শ থেকে আগত যাবতীয় শিরকী ও বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজ ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম একটি সংগঠিত ও সফল আন্দোলন, যা মধ্যযুগীয় অবক্ষয়কালীন দুর্যোগ কাটিয়ে ইসলামের নবতর বিকাশের জন্য এক যুগান্তকারী মাইল ফলকে পরিণত হয়। আধুনিক যুগের সকল ইসলামী সংস্কারবাদী আন্দোলনের আদর্শিক প্রেরণা এই আন্দোলন। সৈয়দ আব্দুল কুদ্দূস যথার্থই বলেন, ‘আধুনিক যুগে ইসলামী রেঁনেসার উৎপত্তি মূলতঃ অষ্টাদশ শতকের ‘ওয়াহ্হাবী’ আন্দোলন থেকে। দার্শনিক ও আদর্শগত দিক থেকে এই রেঁনেসার ইতিহাস মূলতঃ ওয়াহ্হাবী আন্দোলনেরই ধারাবাহিকতা’। (Syed Abdul Quddus, The Challenge of Islamic Renaissance, (Dehli : Adam Publishers, 1990), P. 17. ) মহাকবি ইকবাল এই আন্দোলনকে আখ্যা দিয়েছেন- ‘‘The first throb of life in modern Islam" অর্থাৎ ‘আধুনিক ইসলামের প্রথম হৃদস্পন্দন’ হিসাবে। (প্রাগুক্ত, ১৭ পৃঃ।) আল্লামা যিরিকলী বলেন, ‘এই দাওয়াত ছিল সমগ্র মুসলিম বিশ্বের আধুনিক নবজাগরণে সর্বপ্রথম বিচ্ছুরিত আলোকধারা। যার প্রভাবে ভারত, মিসর, ইরাক ও সিরিয়ার সংস্কারবাদীগণ উদ্বুদ্ধ হন’। (খায়রুদ্দীন আয-যিরিকলী, আল-আ‘লাম (বৈরূত : দারুল ইলম লিল মালায়ীন, ১৫ তম প্রকাশ : ২০০২ খৃঃ), ৬/২৫৭ পৃঃ।)
 
মুহাম্মাদ যিয়াউদ্দীন আর-রীস বলেন, ‘এ আন্দোলন এমন দু’টি মূলনীতিকে ধারণ করেছিল, মুসলিম বিশ্বের অগ্রযাত্রায় যার প্রভাব সর্বাধিক। এক.পবিত্র কুরআন ও হাদীছ- এই দু’টি মূলসূত্রের উপর নির্ভরতা এবং সালাফে ছালেহীনের অনুসৃত নীতিমালার দিকে প্রত্যাবর্তনের আহবান ও দুই. ইজতিহাদের নীতি প্রবর্তন। এই দু’টি নীতি হ’ল মুসলিম সমাজে আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক জাগরণের ভিত্তি। বলা বাহুল্য, এই দু’টি নীতি অবধারণের জন্য ঊনবিংশ শতাব্দীতে আবির্ভূত হওয়া প্রাচ্যের সকল সংস্কারবাদী আন্দোলনই ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের কাছে সর্বৈব ঋণী। এ আন্দোলনের সাথে অন্যান্য সব আন্দোলন দৃঢ়ভাবে সম্পর্কিত, হয় সরাসরি গ্রহণের মাধ্যমে অথবা অনুসরণের মাধ্যমে, নতুবা অন্ততঃ প্রভাবিত হওয়ার মাধ্যমে। (আহমাদ বিন হাজার আলে বুত্বামী, শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব, আক্বীদাতুহুস সালাফিয়্যাহ ওয়া দা‘ওয়াতুহুল ইছলাহিয়্যাহ ওয়া ছানাউল উলামা আলাইহে (কুয়েত : আদ-দারুস সালাফিয়্যাহ, ৪র্থ প্রকাশ, ১৯৮৩ খৃঃ), পৃঃ ১৩৫। )
মুসলিম সমাজে এ আন্দোলনের প্রভাব কিরূপ ছিল সে সম্পর্কে মরক্কোর স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা প্রখ্যাত শল্যবিদ ও দার্শনিক আব্দুল করীম আল-খাত্বীব (১৯২১-২০০৮ খৃঃ) বলেন,والذيلاشكفيه،أنالدعوةالوهابيةكانتأشبهبالقذيفةالصارخة،تنفجرفيجوفالليلوالناسنيام- كانتصوتاقويارائداأيقظالمجتمعالإسلاميكله،وأزعجطائرالنومالمحومعليأوطانهممنذأمدبعيد- ‘নিঃসন্দেহে ওয়াহ্হাবী আন্দোলন ছিল এক প্রচন্ড নিনাদ সম্পন্ন মিসাইলের মত; যা বিস্ফোরিত হয়েছিল এক গভীর রাতের অমানিশার মাঝে, যখন মানুষ ছিল নিদ্রামগ্ন। এর আওয়াজ ছিল এমনই তীব্র ও সুদূরপ্রসারী যে তা সমগ্র মুসলিম সমাজকে জাগিয়ে তুলেছিল এবং তা যেন সুদীর্ঘকাল পর নিদ্রাচ্ছন্ন বুভুক্ষ পাখীকে আপন বাসস্থানে চঞ্চল করে তুলেছিল’। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩৫। ) ড. আমীনুল ইসলাম বলেন, এ আন্দোলন আরবদের শুধু আত্মসমালোচনা ও আত্মানুসন্ধানের জন্যই সজাগ করে দেয়নি, একই সঙ্গে তাদের জাগিয়ে দিয়েছে সেই মোহনিদ্রা থেকে, যা কিনা নিহিত ছিল তাদের অবক্ষয়ের মূলে। এ আন্দোলন তাদের মনে যে শক্তি ও গতি সঞ্চার করে, সেটিই তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল একাধিক সংস্কারধর্মী কর্মসূচি গ্রহণে।’ (ড. আমীনুল ইসলাম, ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম দর্শন (ঢাকা : উত্তরণ, ১ম প্রকাশ, ২০০৪ ইং) পৃঃ ২৩০। ) ইয়াহইয়া আরমাযানী বলেন, ‘উদ্দেশ্য ও প্রক্রিয়ার দিক থেকে এ আন্দোলন ৭ম শতাব্দীতে পরিচালিত নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আন্দোলনের সাথে এমনই সাদৃশ্যপূর্ণ যে, কেউ কেউ একে ইসলামের দ্বিতীয় আবির্ভাব বলে বিবেচনা করে থাকেন। (ইয়াহইয়া আরমাজানী, মধ্যপ্রাচ্য অতীত ও বর্তমান, মূল : Middle East past and present, মুহাম্মাদ ইনাম-আল-হক অনূদিত (ঢাকা : জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ২০০০), পৃঃ ২৬০। ) এ আন্দোলনের যুগান্তকারী প্রভাবকে খৃষ্টসমাজের প্রটেস্ট্যান্টদের (প্রটেস্টানিজম হ’ল ষোড়শ শতকে ইউরোপীয় খৃষ্ট সমাজে পরিচালিত একটি বিখ্যাত ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন, যা খ্যাতনামা সংস্কারক মার্টিন লুথার কিং তৎকালীন ক্যাথলিক চার্চের পোপদের দুর্নীতি ও তাদের প্রবর্তিত ভ্রান্ত রীতি-নীতির বিরুদ্ধে শুরু করেছিলেন। ১৫১৭ সালে শুরু হয়ে ১৬৪৮ সাল পর্যন্ত সারা ইউরোপ জুড়ে ছিল এ আন্দোলনের ব্যাপ্তি, যাতে এক বিরাট ধর্মীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। ) উত্থানের সাথে তুলনা করে T.P.Huges বলেন, ‘ওয়াহ্হাবীজমকে কখনও কখনও ইসলামের প্রটেস্ট্যানিজম বলা হয়; আর বাস্তবিকই তাই, যদিও এখানে বড় পার্থক্য হ’ল খৃষ্টান প্রটেস্ট্যান্টরা তাদের পবিত্র গ্রন্থগুলোকে যথাযথ সম্মান করলেও প্রথাগত ধর্মীয় রীতি নীতিকে স্বীকার করে না। আর ওয়াহ্হাবীজম পবিত্র কুরআনের সাথে হাদীছের শিক্ষাকেও দৃঢ়ভাবে ধারণ করে’। (Thomas Patric Huges, Dictionary of Islam (Delhi : Rupa & Co. 1988), P. 661. )
 
বিগত দু’শত বছরের ইসলামী ইতিহাসে ওয়াহ্হাবী আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। অথচ ইতিহাসে এ আন্দোলন যেমন একটি ইতিবাচক সংস্কারবাদী আন্দোলন হিসাবে নন্দিত হয়েছে, তেমনি শুরু থেকে অদ্যাবধি এ আন্দোলন মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে একটি বড় অংশের তীব্র বিরোধিতা ও শত্রুতার শিকার হয়েছে। একদিকে একদল নামধারী মাযহাবী, পীরপন্থী আলেম-ওলামা এ আন্দোলনকে ইসলাম বহির্ভূত প্রমাণ করার জন্য প্রাণান্ত সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে; অন্যদিকে পশ্চিমারা ও তাদের খুদ-কুড়ো খাওয়া এক শ্রেণীর মুসলমান তাদের ‘মুক্তবুদ্ধি’ দর্শনের জন্য বিপজ্জনক চিহ্নিত করে। এ আন্দোলনকে পশ্চাদমুখী, চরমপন্থী, মৌলবাদী, জঙ্গীবাদী ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে মুসলিম বিশ্বকে এর প্রভাবমুক্ত রাখার অপপ্রয়াস চালিয়ে আসছে। অধুনা পশ্চিমা বিশ্বের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যু্দ্ধে’র প্রধান টার্গেট হ’ল এই আন্দোলনের ভাবানুকূল বিশ্বের বিভিন্ন আদর্শিক আন্দোলন সমূহ। যাকে তারা ‘ওয়াহ্হাবীজম’ ও ‘সালাফীজম’ বলে আখ্যায়িত করে। এসকল প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে আলোচ্য নিবন্ধে এআন্দোলনের পরিচিতি ও মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব আলোচনা করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, একে মানুষের চোখে হীনকর ভাবে দেখানোর জন্য বিরুদ্ধবাদীদের পক্ষ থেকে এ আন্দোলনকে ‘ওয়াহ্হাবী’ (এটি একটি অপপ্রয়োগ (misnomer)। কেননা আন্দোলনের উদ্গাতা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের নামেই যদি এই নামকরণ করা হয়ে থাকে, সে হিসাবে বড়জোর একে ‘মুহাম্মাদী আন্দোলন’ বলা যেত। কিন্তু অযৌক্তিকভাবে তাঁর পিতার নামানুসারে ‘ওয়াহ্হাবী আন্দোলন’ নামকরণ করা হয়েছে। মাসউদ আলম নাদভীর মতে, প্রথম এ ভুলটি করেন John Lewis Burkhardt (১৭৮৪-১৮১৭ খৃঃ) নামক এক ইউরোপীয় পর্যটক। এরপর তা বিভিন্ন লেখকদের মাধ্যমে জনসমাজে প্রচার পায় (দ্রঃ মাসঊদ আলম নাদভী, মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব : মুছলিহুন মাযলূমূন ও মুফতারা আলাইহ, উর্দূ থেকে আরবী অনুবাদ: আব্দুল আলীম আল-বাসতুভী (রিয়াদ : ১৪২০ হিঃ) পৃঃ১৯৪; এ.জেড.এম শামসুল আলম, প্রবন্ধ : ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব ও ওয়াহ্হাবী মতবাদ’, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, ঢাকা : ৪৪ বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা, এপ্রিল-জুন ২০০৫, পৃঃ ২১০। ) আন্দোলন নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে, যা পরে ইউরোপীয়দের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পায় (একই উদ্দেশ্যে এ নামটি পাক-ভারত উপমহাদেশের ‘তরীকায়ে মুহাম্মাদিয়া’ আন্দোলনের সাথেও জুড়ে দেয়া হয়েছিল)। এতদসত্ত্বেও সমধিক প্রসিদ্ধির কারণে বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে প্রচলিতএই নামটিই অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
 
ওয়াহহাবী আন্দোলনের পরিচয় :নামকরণ :
আগেই বলা হয়েছে, ‘ওয়াহ্হাবী আন্দোলন’ নামকরণটি এ আন্দোলনের উদ্গাতা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব বা তাঁর অনুগামীদের প্রবর্তিত নয়। পরবর্তী ঐতিহাসিকরা ভুলক্রমে হোক কিংবা বিদ্বেষ বশতঃ হোক এ আন্দোলনকে এই নামে পরিচিত করে তুলেছেন। এটা মূলতঃ এ আন্দোলনের বিরোধীদের পক্ষ থেকে গালিস্বরূপ ব্যবহার করা হয়। হাসান বিন আব্দুল্লাহ আলে শায়খ এসম্পর্কে বলেন, ‘ওয়াহ্হাবিয়্যাহ বিশেষণটি এ আন্দোলনের অনুগামীরা সৃষ্টি করেনি। বরং তাদের বিরুদ্ধবাদীরা তাদেরকে পৃথক করার জন্য এটা ব্যবহার করে যেন মানুষ তাদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকে এবং শ্রোতারা মনে করে যে, এ আন্দোলন প্রচলিত বড় বড় চারটি মাযহাবের বিপরীতে পঞ্চম একটি মাযহাব নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। তবে এআন্দোলনের কর্মীরা নিজেদেরকে ‘সালাফী’ এবং তাদের দাওয়াতকে ‘সালাফী দাওয়াত’ বলে আখ্যায়িত করাকেই অধিক পসন্দ করতেন।’’ (হাসান বিন আব্দুল্লাহ আলে শায়েখ, প্রবন্ধ :আল-ওয়াহ্হাবিয়াহ ওয়া যাঈমুহা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব, গৃহীত : ফরীদ ওয়াজদী, দায়েরাতুমা‘ আরিফিল ক্বারনিল ইশরীন (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ, ৩য় প্রকাশ), পৃঃ ৮/৮২১। ) এই ঐতিহাসিক ‘ভুল’ অথবা ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ অভিধাটি সারাবিশ্বে আজও পাকাপোক্তভাবে বিদ্যমান। ফলে দেখা যায়, বর্তমান বিশ্বের যে দেশেই ইসলামী সংস্কারবাদী আন্দোলন তথা নিখাদ তাওহীদের দিকে প্রত্যাবর্তনের আহবানকারী আন্দোলন পরিদৃষ্ট হয়, সেখানেই বিরুদ্ধবাদীরা তাদেরকে পথভ্রষ্ট ও বিচ্ছিন্ন দল হিসাবে দেখানোর জন্য ‘ওয়াহ্হাবী’ ট্যাগ লাগিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালায়। বর্তমান ওবামা প্রশাসনের কাউন্টার টেরোরিজম উপদেষ্টা Quintan Wiktorowicz তাঁর সাম্প্রতিক গবেষণা পেপার Anatomy of the Salafi Movement-এ লিখেছেন, ‘সালাফী মতবাদের বিরোধীরা প্রায়ই এ মতবাদকে বহিরাগত প্রভাবজাত মতবাদ হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য ‘ওয়াহ্হাবী’ বলে সম্বোধন করে। তাদের উদ্দেশ্য এই মতাবলম্বীদেরকে ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের অনুসারী’ হিসাবে পরিগণিত করা। সাধারণতঃ যেসব দেশে সালাফীগণ সংখ্যায় স্বল্প এবং স্থানীয় অধিবাসীরা ধীরে ধীরে তাদের মতবাদের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে, সেসব দেশে তাদেরকে ‘ওয়াহ্হাবী’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। (Quintan Wiktorowicz, "Anatomy of the Salafi Movement" in "Studies in Conflict & Terrorism" USA, Vol. 29, Issue. 3 (2006), P. 235. ) অনুরূপভাবে A. J. Arberry, George Rentz প্রমুখ প্রাচ্যবিদের গবেষণায় এবং স্বীকৃত কয়েকটি বিশ্বকোষে এই ষড়যন্ত্রের কথা স্বীকার করা হয়েছে। (Encyclopedia of Islam and the Muslim World, Editor in Chief Richard C. Martin, V-2 (New York : Macmillan Referance, 2004), P. 727. ) প্রকৃতপক্ষে এ আন্দোলনের বিশেষ কোন নাম ছিল না। তবে সালাফে ছালেহীনের অনুসৃত পথের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের আহবানকারী হিসাবে এটি পরবর্তীতে ‘সালাফী আন্দোলন’ নামে খ্যাতি লাভ করেছে।
 
পরিচয় :
১৭০৩ খৃষ্টাব্দে আরব উপদ্বীপের কেন্দ্রভূমি নাজদ অঞ্চলে জন্ম নিয়েছিলেন ক্ষণজন্মা যুগসংস্কারক মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব (রহঃ)। আরবের বুকে দীর্ঘকাল ব্যাপী জেঁকে বসা শিরক ও বিদ‘আতের বিপুল আস্ফালনকে রুখে দিয়ে অমাবস্যা রাতে ধূমকেতুর মতই চমক জাগিয়ে তিনি যে দুঃসাহসী আন্দোলন শুরু করেছিলেন; তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল আরবের বুকে আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত এবং সালাফে ছালেহীনের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের ভিত্তিতে রাসূল (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া নির্ভেজাল ইসলামের পুনর্জাগরণ ঘটান এবং একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দান। স্মর্তব্য যে, এটি আকস্মিক আবির্ভূত কোন আন্দোলন ছিল না; বরং ইসলামের ইতিহাসে অনুরূপ আন্দোলনের দৃষ্টান্ত অনেক। ইরাকে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (৭৮০-৮৫৫ খৃঃ), সিরিয়াতে ইমাম আহমাদ ইবনে তায়মিয়া (১২৬৩-১৩২৮ খৃঃ), মিসরে ইয্ বিন আব্দুস সালাম (১১৮১-১২৬১ খৃঃ), মরক্কো ও স্পেনে ইমাম শাত্বেবী (১৩৮৮ খৃঃ), ইয়ামনে ইমাম ছান‘আনী (১৬৮৮-১৭৬৮ খৃঃ) প্রমুখ মহান যুগসংস্কারকবৃন্দ প্রত্যেকেই হক্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অনুরূপ আন্দোলন-সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন এবং খারেজী, মু‘তাযিলী সহ পথভ্রষ্ট আক্বীদা সমূহের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। মুসলিম বিশ্বে যুগান্তকারী প্রভাব বিস্তারের কারণে এ আন্দোলন বিশ্ববাসীর নযরে বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে। মুসলিম-অমুসলিম, শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে জ্ঞানী মহল এ আন্দোলনের উপর বিশেষ গবেষণা চালিয়েছেন। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হ’ল, সংস্কারধর্মী ও বিশুদ্ধবাদী বৈশিষ্ট্যের কারণে এ আন্দোলনের উপর পাশ্চাত্যের সেক্যুলার বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সমূহে নেতিবাচক বা ইতিবাচক যত গবেষণা হয়েছে, সম্ভবতঃ মুসলিম বিশ্বের ইসলামী কেন্দ্রগুলোতেও তত হয়নি। নিম্নে এ আন্দোলনের পরিচয় সম্পর্কে কয়েকজন বিখ্যাত পন্ডিতের বক্তব্য তুলে ধরা হ’ল-
১- মিসরীয় পন্ডিত ড.ত্বহা হুসাইন (১৮৮৯-১৯৭৩ খৃঃ) বলেন, ‘এই নতুন মাযহাবটি বাহ্যত নতুন মনে হ’লেও মর্মগত ভাবে এটি সনাতনই। অর্থাৎ সমকালীন পেক্ষাপটে নবীন হ’লেও মৌলিকত্বের দিক থেকে এটি প্রাচীন। কেননা এ দাওয়াত ছিল বিশুদ্ধ, অবিমিশ্র এবং শিরক ও পৌত্তলিকতা মুক্ত আদি ইসলামের দিকে ফিরে যাওয়ার এক শক্তিশালী দাওয়াত। ... এটি ছিল স্বয়ং ইসলামের দিকেই দাওয়াত, যে দাওয়াত নিয়ে নবী করীম (ছাঃ) আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত প্রাণ হয়ে দুনিয়ার বুকে আগমন করেছিলেন। আল্লাহ ও বান্দার মাঝে শীর উঁচু করে থাকা যাবতীয় তথাকথিত মাধ্যম সমূহ উচ্ছেদের লক্ষ্যে। এ দাওয়াত পরিচালিত হয়েছিল আরবীয় ইসলামকে পুনরুজ্জীবন দান এবং অজ্ঞতা-মূর্খতা ও অনারব সংস্পর্শের প্রভাবজাত সৃষ্ট যাবতীয় ময়লা-আবর্জনাকে পরিশোধনের জন্য’। (ত্বহা হুসাইন, আল-হায়াতুল আরাবিয়্যাহ ফি জাযীরাতিল আরাব (দামেশক : ১ম প্রকাশ, ১৯৩৫ খৃঃ), পৃঃ ১৩। গৃহীত : প্রবন্ধ ‘‘হাক্বীকাতুশ শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব’’, ড.মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আস-সালমান, মাজাল্লাতুল বুহূছ আল-ইসলামিয়াহ (রিয়াদ :১৪০৮ হিঃ, ২১ তম সংখ্যা), পৃঃ ১২৭। )
 
২- লেবাননী লেখক আমীর শাকীব আরসালান (১৮৬৯-১৯৪৬ খৃঃ) বলেন, ‘এই আন্দোলন ছিল সঠিক আক্বীদা, সালাফে ছালেহীনের নীতিমালা এবং রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবাদের পদাংক অনুসরণের দিকে প্রত্যাবর্তনে আহবানকারী একটি আন্দোলন। যা কুসংস্কার, বিদ‘আত, গায়রুল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা বা আনুগত্য প্রকাশ, কবরের প্রতি শ্রদ্ধা দেখান, আওলিয়ায়ে কেরামের অবস্থানস্থলে ইবাদত করা ইত্যাকার কার্যকলাপকে সর্বতোভাবে প্রত্যাখ্যান করে। (হাযেরুল ‘আলামিল ইসলামী, আরবী অনুবাদ : উজাজ নুয়াইহিয, সম্পাদনা : আমীর শাকীব আরসালান, মূল ইংরেজী : Lothrob Stoddard, The New World of Islam (P.1921) (বৈরূত : দারুল ফিকর, ৪র্থ প্রকাশ, ১৯৮৩ইং), ১/২৬৪ পৃঃ। )
৩- আমেরিকান পন্ডিত লোথ্রোব স্টোডার্ড (১৮৮৩-১৯৫০ খৃঃ) চমৎকারভাবে এর পরিচয় দিয়েছেন, ‘ওয়াহ্হাবী দাওয়াত একটি বিশুদ্ধ ও পূর্ণাঙ্গ সংস্কারবাদী দাওয়াত। যার উদ্দেশ্য ছিল অলৌকিকতার ধারণাকে পরিশুদ্ধ করা, যাবতীয় অস্পষ্টতা, সন্দেহ ও কুসংস্কারের অবসান ঘটান। মধ্যযুগে ইসলামের মধ্যে তথাকথিত মুসলিম পন্ডিতরা যেসব বৈপরিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা ও পরস্পর বিরোধী সংযোজন ঘটিয়েছিলেন তা নাকচ করা এবং যাবতীয় বিদ‘আতী কর্মকান্ড ও ওলী-আওলিয়ার উপাসনাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করা। সর্বোপরি ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন করা এবং আদি ও মৌলিক উৎসগুলোর মাধ্যমে ইসলামকে ধারণ করার আহবানই ছিল ওয়াহ্হাবী দাওয়াতের সারনির্যাস।
৪. ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের উপর প্রথম তথ্যসমৃদ্ধ বর্ণনাদাতা সুইস পর্যটক জন লুইস বারখাডট (John Lewis Burkhardt) তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে লিখেছেন, ‘ওয়াহ্হাবীদের ধর্মীয় বিশ্বাস সমূহ নব্য কোন ধর্মবিশ্বাস ছিল না।...তাদের এবং সুন্নী তুর্কীদের মধ্যে পার্থক্য ছিল এই যে, ওয়াহ্হাবীরা শরী‘আতকে কঠোরভাবে অনুসরণ করত, যখন অন্যরা তা অবহেলা করত অথবা পূর্ণাঙ্গভাবে তা অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকত’।
(John Lewis Burckhardt, Notes on the Bedouins and Wahabys, (London : 282 Henry Colburn and Richard Bentley, 1830), P.275. গৃহীত : ‘আশ-শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব হায়াতুহু ওয়া দা‘ওয়াতাহু ফির রু’য়াতিল ইসতিশরাক্বিয়া, নাছের বিন ইবরাহীম আত-তাওভীম (রিয়াদ : ১ম প্রকাশ, ২০০২খৃঃ), পৃঃ ২৬। )
মোটকথা প্রাচ্য-পাশ্চাত্য নির্বিশেষে সর্বত্র একথা সাধারণভাবে স্বীকৃত যে, ওয়াহ্হাবী আন্দোলন মূলতঃ এমন একটি সংস্কারপন্থী ও বিশুদ্ধবাদী আন্দোলন, যা শিরককে সর্বতোভাবে বর্জনের মাধ্যমে নির্ভেজাল তাওহীদের প্রতিষ্ঠাদানে সফল সংগ্রাম চালিয়েছিল এবং পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছভিত্তিক প্রকৃত ইসলামী শিক্ষাকে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে যথার্থভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছিল। যদিও নামধারী আলেম-ওলামা এবং বিদ্বেষী মহল প্রথম থেকেই হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এ আন্দোলনের বিরূদ্ধে কদর্যপূর্ণ অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। তবুও এ আন্দোলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মসূচীকে তারা বিন্দুমাত্র প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেনি। বরং এ আন্দোলন বিগত তিন শতকে ইসলামকে শিরক ও বিদ‘আতের অশুভ ছায়া থেকে উদ্ধার এবং আদি ইসলামের বিশুদ্ধ শিক্ষাকে পুনরায় বিশ্বের বুকে জাগ্রত করার এক অনন্য দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে। সারা বিশ্বের বুকে এআন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছে নির্ভেজাল তাওহীদ তথা অভ্রান্ত সত্যের একমাত্র উৎস পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনাবিল সুবাতাস। বাতিলের কোটি কণ্ঠের সমবেত গর্জন, শত বাধার বিন্ধ্যচল এর অগ্রযাত্রায় যে কোনরূপ বাধা হ’তে পারেনি সেটাই সতত দৃশ্যমান।
 
ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের উৎপত্তি ও সমসাময়িক মুসলিম বিশ্ব :
শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের এই বরকতময় আন্দোলনের উৎপত্তি ঘটেছিল মূলতঃ ১১৪৩ হিঃ মোতাবেক ১৭৩১ খৃষ্টাব্দে। অতঃপর ১৭৫০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে তাঁর আন্দোলন সারা আরবে প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং ক্রমশঃ জনমনে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। (শায়খ সালমান বিন সাহমান, আয-যিয়া আশ-শারেক ফি রাদ্দি শুবহাতিল মাযেক আল-মারেক (রিয়াদ :ইদারাতুল বুহূছ, ৫ম প্রকাশ, ১৯৯৪ খৃঃ), পৃঃ ১০। )তিনি তাওহীদের পবিত্র দাওয়াত নিয়ে যখন আরব সমাজে নেমেছিলেন, সমগ্র মুসলিম বিশ্বে তখন মুসলমানদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অতীব নাজুক। সার্বিক অবস্থা ছিল এতই দুর্দশাগ্রস্ত ও কলুষিত যে, বহু ক্ষেত্রে তা আইয়ামে জাহেলিয়াতকেও হার মানিয়েছিল। নিম্নে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিস্থিতি সংক্ষিপ্তাকারে পেশ হ’ল।
রাজনৈতিক অবস্থা :
অষ্টাদশ শতকের শুরুতে মুসলিম বিশ্বের পূর্বাঞ্চলে নেতৃত্ব দিচ্ছিল তুরস্কের ওছমানীয় খেলাফত, পারস্যের ছাফাভী এবং ভারতের মোগল-এ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সাম্রাজ্য। (ড. মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আস-সালমান, প্রবন্ধ : হাক্বীক্বাতু দাওয়াতিশ শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব ওয়া আছরুহা ফিল ‘আলামিল ইসলামী, মাজাল্লাতুল বুহূছ আল-ইসলামিয়াহ, পৃঃ ১২৮ । )
ওছমানীয় সাম্রাজ্য :
প্রতাপশালী ওছমানীয় সাম্রাজ্যের শাসকগণ তখন এতই দুর্বল হয়ে পড়েন যে, তারা মন্ত্রী পরিষদ ও ভঙ্গুর সেনাবাহিনী প্রধানদের হাতের পুতুলে পরিণত হন, যারা রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে মোটেও অভিজ্ঞ ছিলেন না। বিভিন্ন অঞ্চলে যারা গভর্নর হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন তারাও ছিলেন দুর্বলচেতা ও প্রশাসন পরিচালনায় অদক্ষ। জনগণের কাছ থেকে কর আদায় ছাড়া তাদের আর কোন চিন্তা ছিল না। সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ায় ওছমানীয় সাম্রাজ্য প্রায় সর্বদিক থেকে ইউরোপীয়দের কব্জাভূত হয়ে পড়ে এবং একের পর এক অঞ্চল ইউরোপীয়দের ভাগবাটোয়ারার শিকার হ’তে থাকে। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ওছমানীয় সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত তিউনিসিয়া, আলজেরিয়াতেও বিরাজ করছিল একই অবস্থা। মরক্কোতে চলছিল সা‘দ বংশের শাসন। তারাও স্প্যানিশ ও পর্তুগীজদের হামলার ভয়ে সবসময় তটস্থ থাকত। আর আরব ও বার্বার সহ বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে গৃহযুদ্ধ তো লেগেই ছিল।
 
ছাফাভী সাম্রাজ্য :
প্রায় আড়াইশ বছর রাজত্ব করার পর পারস্য তথা ইরানের ছাফাভী সাম্রাজ্য তখন আফগানদের দখলে চলে যায়। ১৭২৯ সালে ক্ষমতায় আরোহন করেন আফগান শাসক নাদির শাহ। তিনি নিজেকে সাম্রাজ্যের রাজা হিসাবে ঘোষণা করে রাজত্বের সীমানা বাড়াতে থাকেন এবং আরব সাগর থেকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত তাঁর রাজত্বের সীমানা বিস্তৃত করেন। ১৭৪৭ তাঁর মৃত্যু হ’লে সাম্রাজ্য জুড়ে শুরু হয় বিশৃংখলা। ১৭৮৮ সালে কাজার বংশ ক্ষমতা দখলের আগ পর্যন্ত এই অরাজক অবস্থা চলতে থাকে।
মোগল সাম্রাজ্য :
মোগল সাম্রাজ্যের অবস্থাও ছিল তথৈবচ। আমীর-ওমারাদের গৃহযুদ্ধে সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হ’তে থাকে। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পরই মূলতঃ বৃটিশদের হাতে এর চূড়ান্ত পতন ঘটেছিল।
ধর্মীয় অবস্থা :
মুসলমানদের ধর্মীয় অধঃপতনের সূচনা অবশ্য আরো কয়েকশত বছর পূর্বেই হয়েছিল, যখন মুসলিম সমাজে যিন্দীক তথা অন্তরে কুফরী গোপন রেখে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণকারী সম্প্রদায়ের উদ্রব ঘটে। ইসলামী খিলাফতের স্বর্ণযুগে এসব ভিন্ন সংস্কৃতি ও সভ্যতার ব্যক্তিদের গোপন ষড়যন্ত্র এবং তাদের আমদানী করা বিষাক্ত চিন্তা-দর্শন ইসলামী আক্বীদা-আমলের উপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব বিস্তার করে। ফলে মুসলিম সমাজ নানা ফেরকা ও মাযহাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তার পর থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনে এই অধঃপতনের ধারা অব্যাহত থাকে। বিশেষ করে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ওছমানীয় সাম্রাজ্যের পতন যখন আসন্ন হয়ে উঠে, তখন পরিস্থিতি হয়ে পড়ে আরো নাজুক। বিশেষতঃ আলেম-ওলামার মন-মগজে চেপে বসে এক ধরনের জমাটবদ্ধতা, কূপমন্ডকতা আর এক অন্ধ ঐতিহ্যপ্রিয়তা। আযহারী হোক বা হেজাযী হোক অধিকাংশ ওলামা এই দুর্দশায় নিপতিত ছিলেন।
 
ধর্মীয় এই অধঃপতনের পিছনে শাসক সমাজের ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য। তারা কোনরূপ সংস্কারধর্মী ও সংশোধনমূলক চিন্তাকে স্বাগত জানাতেন না; বরং এরূপ চিন্তাধারার লোকদের তারা প্রায়শই কাফের বলে সাব্যস্ত করতেন। যেমনভাবে তারা ওয়াহ্হাবী আন্দোলনকেও ইসলাম বহির্ভূত সাব্যস্ত করেছিলেন। অথচ অপরদিকে তারা বিদ‘আতী ও ছূফীদের বিশেষভাবে প্রশ্রয় দান করেন, যাতে ছূফীদের প্রতি অনুরক্ত জনগণের কাছে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। ফলে ছূফীবাদীরা একইসাথে শাসক ও জনগণের প্রশ্রয় পেয়ে তাদের বিদ‘আতী আক্বীদা ও আমল প্রচারের উর্বর ক্ষেত্র পেয়ে যায়। এমনকি তাদের কেউ কেউ আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার দায়িত্বও পেয়ে যায়। এভাবে তাদের দৌরাত্ম্যে ওছমানীয় খেলাফতের সর্বত্র শিরক ও বিদ‘আতের বাধাহীন প্রসার ঘটে। ফলশ্রুতিতে ইসলামী রাষ্ট্রগুলো থেকে তাওহীদ ও সুন্নাহ ভিত্তিকআক্বীদা-আমল বিলীন হ’তে থাকে। বিভিন্ন দেশে একের পর এক গড়ে উঠতে থাকে ওলী-আওলিয়াদের সুরম্য মাযার। এসব কবর-মাযারের প্রাচুর্য মানুষকে আল্লাহর ইবাদত থেকে সরিয়ে নিয়ে ওলী-আওলিয়ামুখী করে তুলে। আল্লাহর পরিবর্তে মাযারের ওলীর উপরই তারা সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং সেখানে গিয়ে দো‘আ-দরূদ, নযর-নেওয়ায, কুরবানী ইত্যাদি পেশ করতে থাকে। আর নানা অলীক ধ্যান-ধারণা, কুসংস্কারের তো কোন ইয়ত্তা ছিল না। ফলে কবর-মাযার সংস্কৃতির প্রভাব হেজায ও ইয়েমেন থেকে শুরু করে সিরিয়া, ইরাক, মিসর, পশ্চিম আফ্রিকা ও পূর্বপ্রাচ্য পর্যন্ত ইসলামী বিশ্বের সর্বত্রই বাধাহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ে। (হুসাইন বিন গান্নাম, রাওযাতুল আফকার ওয়াল আফহাম (বাবাত্বীন : ১ম প্রকাশ, ১৩৬৮ হিঃ), ১/১০ পৃঃ। ) মানুষ শিরক ও বিদ‘আতকেই ইসলাম ভেবে একনিষ্ঠতার সাথে পালন করতে থাকে। ফলে তাদের জীবনাচরণে তাওহীদ ও সুন্নাতের খুব সামান্য নিদর্শনই অবশিষ্ট ছিল। (হাকীকাতু দা‘ওয়াতিশ শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব ওয়া আছরুহা ফিল ‘আলামিল ইসলামী, পৃঃ ১২৯। )
লোথ্রোব স্টোডার্ড সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়কে এভাবে চিত্রিত করেছেন, ‘দ্বীনে ইসলাম তখন হারিয়ে গিয়েছিল কৃষ্ণ আবরণীর অন্তরালে। ইসলামের বার্তাবাহক রাসূল (ছাঃ) দুনিয়ার বুকে যে একত্বের নীতি বাস্তবায়ন করেছিলেন, তা আবৃত হয়ে পড়েছিল ছূফীবাদের খোলসে ও কুসংস্কারে বিস্তৃত চাদরে। মসজিদগুলো হয়ে পড়েছিল মুছল্লীশূন্য। সমাজে মূর্খ দ্বীন প্রচারক ও ফকীর-দরবেশের দল ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল, যারা গলায় তাবীয-কবজ-তসবীহ ঝুলিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াত। তারা মানুষের মধ্যে মিথ্যা- অলীক, রহস্যময় সব কুসংস্কার ঢুকিয়ে দিয়ে তথাকথিত ওলী-আওলিয়াদের কবরে তীর্থযাত্রার জন্য প্ররোচিত করত এবং কবরে দাফনকৃত মানুষগুলোর শাফা‘আত বা সুফারিশ লাভের মিথ্যা প্রলোভন দেখাত।...খোদ মক্কা ও মদীনার অবস্থাও ছিল মুসলিম বিশ্বের আর সব এলাকার মতই। যে পবিত্র হজ্জকে আল্লাহ সামর্থ্যবানদের উপর অপরিহার্য করেছিলেন, তা নিছক এক ঠাট্টা-বিদ্রূপের অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। মোটকথা মুসলমানরা আত্মপরিচয় হারিয়ে যেন পরিণত হয়েছিল অমুসলিমে। পতিত হয়েছিল অধঃপতনের অতল তলে। যদি ইসলামের বার্তাবাহক এই যুগে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসতেন এবং ইসলামের এই দুরবস্থা দেখতেন, তবে অবশ্যই তিনি ক্রোধে ফেটে পড়তেন এবং এসবের জন্য যারা দায়ী, তাদেরকে মুরতাদ ও মূর্তিপূজকদের মতই লা‘নত করতেন। (হাযেরুল ‘আলামিল ইসলামী, ১/২৫৯ পৃঃ। )
ড. মুহাম্মাদ আশ-শুওয়াঈর বলেন, এ আন্দোলন ছিল পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ এবং এ দুইয়ের বিপরীত যাবতীয় কিছু প্রত্যাখ্যানের নীতিতে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রাচীন আন্দোলন।
(ড. মুহাম্মাদ আশ-শুওয়াঈর, তাছহীহু খাতাইন তারিখি ইন হাওলাল ওয়াহ্হাবিয়া, পৃঃ ৬। )
 
নাজদের অবস্থা :
ভৌগলিকভাবে জাযীরাতুল আরবের এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকলেও নাজদের রাজনৈতিক ইতিহাস অতীতে তেমন সমৃদ্ধ ছিলনা। হিজরী তৃতীয় শতকে আব্বাসীয় আমলে সর্বপ্রথম নাজদ একটি স্বতন্ত্র রাজ্য হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ২৫৩ হিজরীতে মুহাম্মাদ আল-উখায়যির এ রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। তখন একে ‘দাওলাতুল উখায়যিরিয়াহ’ নামে অভিহিত করা হ’ত। কিন্তু হিজরী পঞ্চম শতকের মাঝামাঝিতে নাজদের রাষ্ট্রীয় পরিচয় পুনরায় অবলুপ্ত হয়ে যায় এবং তা পার্শ্ববর্তী রাজ্যসমূহের অংশবিশেষে পরিণত হয়। ওছমানীয় শাসনামলে পর্বতময় নজদ অঞ্চল রাজনৈতিকভাবে আরো গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। সেখানকার অধিবাসীরা অভ্যন্তরীণ গোলযোগ নিয়েই ব্যস্ত থাকত। ক্ষমতা দখলের দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ে বিশৃংখল নাজদ অঞ্চল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চারটি রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে বাইরের দুনিয়ার সাথে তাদের তেমন সম্পর্ক ছিল না। (ড. মুনীর আল-আজলানী, তারীখুল আরাবিয়াহ আস-সঊদিইয়াহ (বৈরূত : দারুল কিতাব আল আরাবী, তাবি) পৃ: ১/২৮-৩৬; ড. মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আস-সালমান, প্রাগুক্ত, ১২১ পৃঃ।) সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার সাথে পাল্লা দিয়ে সেখানকার ধর্মীয় আচার-আচরণেও নেমে এসেছিল দুর্যোগের ঘনঘটা। শিরক ও বিদ‘আতের নোংরা আবর্জনায় হারিয়ে গিয়েছিল তাওহীদ ও সুন্নাতের মর্মবাণী। বিভ্রান্ত ছূফীবাদীদের আধিপত্যে আদি ইসলামের দিশা পাওয়া ছিল নিতান্ত ভাগ্যের ব্যাপার। মানুষ আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে কবর, খানক্বাহ, গাছ, পাথর, ওলী নামধারী মুর্খ পাগল-ফকীরের ইবাদতে লিপ্ত ছিল। তারা তাদের নামে পশু কুরবানী করত ও নযর-নেয়াজ পাঠাত। সমাজে গণক ঠাকুর ও জাদুকররা লাভ করেছিল বিশেষ কদর। মানুষ তাদের কথা নির্বিবাদে বিশ্বাস করত। জ্বিনের পূজায় তারা বিশেষ অর্ঘ্য নিবেদন করত এবং তার অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য নানা শিরকী উপায়-উপকরণের আশ্রয় নিত। যদিও ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাতের মত মৌলিক ইবাদত তারা পুরোপুরি ছেড়ে দেয়নি, কিন্তু তাদের জীবনাচরণ একজন আল্লাহবিমুখ দুনিয়া পূজারী লম্পটের চেয়ে ভিন্নতর ছিল না। (শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দিল্লাহ বিন বায, আল ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহ্হাব : দাওয়াতুহুও সীরাতুহু (রিয়ায : ইদারাতুল বুহূছ আল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা ওয়াদ দাওয়াহ ওয়াল ইরশাদ, ২য় প্রকাশ : ১৪১১ হিঃ), ২৩ পৃঃ।) তাদের অবস্থা ছিল প্রায় জাহেলী যুগের মুশরিকদের মতই। অজ্ঞতার নিকষ কালো আঁধার তাদের অন্তর থেকে হেদায়াতের নূর নিভিয়ে দিয়েছিল। পথভ্রষ্ট, আর খেয়াল-খুশীর অনুসারী লোকেরা ছিল তাদের নেতৃত্বে। তারা আল্লাহর কিতাব, রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের ধার ধারত না। পূর্বপুরুষদের বিদ‘আতী আচার-অনুষ্ঠানকেই তারা ইবাদত মনে করত এবং তাদেরকেই সর্বাধিক জ্ঞানের অধিকারী বিবেচনা করত। (হুসাইন বিন গান্নাম, রাওযাতুল আফকার ওয়াল আফহাম, তাহক্বীক: ড.নাছেরুদ্দীন আল আসাদ (বৈরূত : দারুশ শুরূক্ব, ৪র্থ প্রকাশ :১৯৯৪ খৃঃ) ১৩পৃঃ।)
 

Users who are viewing this thread

Back
Top